রেগে সংগীতের ফিরে আসা
কিংস্টনের ট্রেঞ্চটাউন বস্তির রুড বয়রা খ্যাপা সুরের মূর্ছনা আর রাস্তাফারাই আন্দোলনে দুনিয়াজুড়ে যে আগুন ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সে তো সত্তরের দশকের কথা। কিন্তু এখনো সাদা-কালো, ধনী-গরিব আর নারী-পুরুষের বিভেদে ব্যথা আর ক্ষোভে অনেকেই গেয়ে ওঠেন ‘বাফালো সোলজার্স’, ‘নুহ উইমেন নুহ ক্রাই’ কিংবা ‘গেট আপ স্ট্যান্ড আপ, স্ট্যান্ড আপ ফর ইউর রাইটস’। এদিকে, দৃশ্যপট খানিকটা ভিন্ন হলেও জ্যামাইকার রাজধানী কিংস্টন দৃশ্যতই আবারও জ্বরে কাঁপছে! জ্বরের নাম ‘রেগের পুনর্জন্ম’! বব মার্লি আর তাঁর সহযোদ্ধাদের রেগে সংগীতের উত্তাপ কি নতুন করে ফিরে আসছে? বার্তা সংস্থা রয়টার্স কিংস্টনের সেই গল্প তুলে ধরেছে।

রেগের পুনর্জন্ম আন্দোলন
কিংস্টনে জ্যামাইকার জাতীয় স্টেডিয়ামের ইনডোর গ্যালারি কানায় কানায় পূর্ণ। এই ভিড়ে তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে মিলেমিশে আছেন বয়স্করাও। আয়োজনটা জনপ্রিয় বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপের। কিন্তু রেগে শিল্পী তারুস রাইলি যখন মঞ্চে উঠছিলেন, তখন উল্লসিত দর্শক-শ্রোতাদের চিত্কারে কানে তালা লাগার অবস্থা। রাইলির গান শেষ না হওয়া পর্যন্ত গ্যালারিজুড়ে শ্রোতাদের কণ্ঠের কোরাস আর হল্লা চলছিলই।
কেবল কিংস্টন নয় জ্যামাইকাজুড়েই আবার বইতে শুরু করেছে রেগে সংগীতের দমকা হাওয়া। ‘রেগে রিভাইভাল’ বা ‘রেগের পুনর্জন্ম’ নামে চলছে এক নতুন আন্দোলন। দুই দশক ধরে জ্যামাইকার সংগীত মানচিত্রে রেগের ‘ডান্সহল’ ঘরানা রাজত্ব করলেও এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ফিরে আসছে রেগের সোনালি যুগ—সত্তরের দশক আর কিংবদন্তি শিল্পী বব মার্লির ধারা। বব মার্লি ও তাঁর সহযোদ্ধা শিল্পীরাই সে সময়ে রেগে সংগীতকে বিশ্ব মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
বব মার্লির গানের দল ‘বব মার্লি অ্যান্ড দ্য ওয়াইলার্স’-এর প্রথম অ্যালবামের প্রকাশক আইল্যান্ড রেকর্ডসের প্রতিষ্ঠাতা ক্রিস ব্ল্যাকওয়েল সম্প্রতি রয়টার্সের মুখোমুখি হয়েছিলেন। জ্যামাইকার রেগের পুনর্জন্ম নিয়ে তিনি বলেন, ‘রেগে আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এটা (রেগে) যেভাবেই হোক নেতিবাচক আর সহিংস দিকে চলে গিয়েছিল। কিন্তু এখন এটা আবার নিজেকে খুঁজে পাচ্ছে।’
রেগের পুনর্জন্ম নিয়ে আশাবাদী এখনকার জ্যামাইকান লেখক-শিল্পীরাও। শিকড়ে ফিরে যাওয়ার বাসনা নিয়ে শুরু হওয়া এই আন্দোলনকে কেবল সংগীত নয়; বরং জ্যামাইকার একটা সামাজিক পুনরুত্থানের আন্দোলন হিসেবেও দেখছেন লেখক ডাটি বুকমান। তিনি বলেন, ‘ভালোবাসা, ঐক্য, ইতিবাচকতা ও সত্যানুসন্ধানের বাসনা এই আন্দোলনের ভিত্তিমূল গঠন করেছে।’ সংগীতের বাইরেও এ আন্দোলনকে এ সময়ের জ্যামাইকান তরুণ-তরুণীরা ‘আরব বসন্তের’ মতো কিছু একটা মনে করছে বলেও মন্তব্য করেন এই লেখক।
রেগে সংগীতের চর্চায় রত বব মার্লির সন্তানদের একজন জিগি মার্লি। তিনি এখন ‘ফ্লাই রাস্তা’ নামে নিজের নতুন অ্যালবামের প্রচারে গানের দল নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। জিগি বলেন, ‘রেগে জ্যামাইকার হূত্স্পন্দন। বিগত বছরগুলোতে অনেক তরুণ শিল্পীই রেগে থেকে খানিকটা বেরিয়ে ডান্সহলের ঘরানায় গিয়েছে। কিন্তু জ্যামাইকা রেগেকে মিস করে। রেগে দরকার। কেননা সংগীত আমাদের সমাজকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।’

রেগের ডান্সহল ঘরানা
১৯৮১ সালে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে বব মার্লির মৃত্যুর পরই রেগের সোনালি যুগের পতন শুরু হয়। রেগে সংগীতের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ‘রাস্তাফারাই’ নামের রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক আন্দোলনেরও মোড় পরিবর্তন হয় এ সময়েই। রাস্তাফারাই মতবাদের অনুসারীরা বা রাস্তারা গাঁজা খাওয়াকে আধ্যাত্মিক সাধনার অংশ হিসেবে দেখলেও সোনালি যুগ-পরবর্তী রেগে শিল্পীরা সে জায়গা থেকে সরে যান।
জ্যামাইকা মিউজিক মিউজিয়ামের পরিচালক হার্বি মিলার বলেন, ‘গাঁজা ছেড়ে কোকেইনসহ নানা সিনথেটিক ড্রাগসের দিকে ঝুঁকে পড়া এবং যৌনতা ও সহিংসতায় মেতে থাকাই যেন রেগে শিল্পীদের সাধারণ আচারে পরিণত হয়। আর এসবের ভেতর দিয়েই গড়ে ওঠে রেগের ডান্সহল ঘরানা।’
ডান্সহল ঘরানার রেগে সংগীতে অতি-উন্মাদনাময় তীব্র শব্দের ব্যবহার, সহিংস ভাব এবং ক্ষোভের প্রকাশে নির্বিচার গালাগালের সঙ্গে মিশতে থাকে উগ্র যৌনতায় ভরপুর গানের কথা। এক দশকের মধ্যেই জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে যেতে থাকে ডান্সহল। ১৯৯১ সালে রেগে সংগীতের জনপ্রিয় উত্সব ‘রেগে সানপ্লাশ’-এর আসরে রেগে গানের মূল ধারাকে ছাপিয়ে নিজেদের আসন করে নেন শাববা র্যাঙ্কস, ইয়োলোমান, বুজু ব্যানটন এবং নিনজামানের মতো ডান্সহল শিল্পীরা। ডান্সহল ঘরানা আসলে রেগেকে বেস্ট সেলিং র্যাপার স্নুপ ডগদের মতো শিল্পীদের নেতৃত্বে চলতে থাকা আমেরিকান গ্যাংস্টার র্যাপ ধারার কাছাকাছি নিয়ে যায়। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই অমিতচারী জীবনচর্চায় মেতে থাকা ডান্সহল শিল্পীরা নানা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়তে থাকেন এবং তাঁদের জনপ্রিয়তায়ও ভাটা পড়তে থাকে।

রেগের ফিরে আসা
‘রুটস রেগে’ বা রেগের সোনালি যুগের ধারা যতটাই বিবর্ণ হয়ে যাক না কেন মূলধারার আমেরিকান পপ মিউজিকে এর প্রভাব কিন্তু কখনোই হারিয়ে যায়নি। আর নতুন শতকের প্রথম দশকজুড়েই বরং তা নতুন চেহারা নিতে থাকে। ২০১২ সালে বুনো মার্সের ‘লকড আউট অফ হেভেন’ শুনলেই সেটা বোঝা যাবে। ২০১৩ সালের গ্র্যামি আসরকালীন এক আয়োজনে মার্লিকে সম্মান জানিয়ে রিয়ান্না আর মার্লির দুই ছেলে জিগি ও ডামিয়ানকে নিয়ে মার্লির ’৮০ সালের গান ‘কুড ইউ বি লাভড’ পরিবেশন করেন বুনো।
এই সময়ে রেগের ফিরে আসাটা আরও স্পষ্ট হবে স্নুপ ডগের জ্যামাইকা সফর দিয়ে। আমেরিকায় তাঁর র্যাপ গানই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। ২০১২ সালে জ্যামাইকা সফর থেকে ফিরে স্নুপ ডগ রাস্তাফারাই আন্দোলনের সঙ্গে আলোচনায় বসার কথা ঘোষণা করেন এবং নিজের নাম পাল্টে স্নুপ ডগ থেকে স্নুপ লায়ন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁর ২০১৩ সালের অ্যালবাম ‘রিইনকারনেটেড’ রুটস রেগে ও ডান্সহল ঘরানার মিশেলে রেগেকে নতুন রূপে হাজির করে।
চলতি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে জনপ্রিয় সংগীতের টপচার্ট প্রকাশকারী ‘বিলবোর্ড’-এর র্যাঙ্কিংয়ে জিগি মার্লির ‘ফ্লাই রাস্তা’ অ্যালবামটি তৃতীয়, রেগে শিল্পী ক্রনিক্সের ‘ড্রেড অ্যান্ড টেরিবল’ চতুর্থ এবং স্নুপ লায়নের ‘রিইনকারনেটেড’ ষষ্ঠ স্থান অধিকার করে নেয়। পাশাপাশি এখনকার সময়ে জ্যামাইকার গুরুত্বপূর্ণ শিল্পীদের সবাইকে দেখা যাচ্ছে রাস্তাফারাই মতবাদ থেকে রসদ নিয়ে সেই ধারাটির পুনরুত্থানের লক্ষ্যেই কাজ করে চলেছেন। এঁদের মধ্যে তারুস রাইলি, প্রোতোজে, ক্রনিক্স, জিগি মার্লি, জাহ-নাইন এবং কাবাকা পিরামিডের মতো জ্যামাইকার আলোচিত সংগীতশিল্পীদের সবাই আছেন। এদের হাত ধরে ফিরে আসছে রেগে সংগীতের সামাজিক সচেতনতা আর আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়াও।