রেসিপি দেখার নেশা থেকে রান্নার পেশা

পত্রিকার যে পাতায় রান্নার রেসিপি থাকে, সেই পাতা আলেয়ার। টেলিভিশনের যে চ্যানেলে যখন রান্নার অনুষ্ঠান, সেই সময় আলেয়ার আর কোনো কাজ নেই। রান্নার এ অনুষ্ঠান তাঁকে দেখতেই হবে। পত্রিকার রেসিপির পাতা জমতে জমতে স্তূপ হয়ে গেছে। আর টেলিভিশন অনুষ্ঠানের রেসিপি খাতায় লিখতে লিখতে ঢাউস পাণ্ডুলিপি হয়ে গেছে। এসব দেখে দেখে খাবার তৈরি করা ছিল নেশা। স্কুল-কলেজে পড়ার সময় থেকেই তাঁর এ নেশা। তিনি কি তখন বুঝতে পেরেছিলেন, এ নেশাই একদিন তাঁর পেশা হয়ে উঠবে? দিনরাত রান্নাঘরেই তাঁকে ব্যস্ত সময় পার করতে হবে। একটি বিভাগীয় শহরের প্রশাসনিক দপ্তরের বড় বড় ফরমাশ তিনি পেতে থাকবেন নিয়মিত, সেটাই–বা কবে ভেবেছেন! সেই না ভাবা বিষয়গুলোই ঘটেছে আলেয়া আক্তারীর জীবনে। সাধারণ গৃহিণীর পরিচয় থেকে আলেয়া আক্তারী এখন রাজশাহী শহরের এক আলোচিত উদ্যোক্তা।

মাঝে মাঝে নানা রকম রান্নার প্রশিক্ষণ নিতে ঢাকা আসেন আলেয়া আক্তারী। তেমনই এক প্রশিক্ষণে শেফ ড্যানিয়েলের সঙ্গে আলেয়া
ছবি: সংগৃহীত

আলেয়া আক্তারী বরিশালের বিএম কলেজে সমাজকল্যাণ বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেছেন। স্বামীর কাজের সুবাদে ২০১০ সাল থেকে রাজশাহী শহরে বাস। দুই সন্তানের মা আলেয়ার মেয়ে পড়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে আর ছেলে তৃতীয় শ্রেণিতে। এদের ঘিরেই একসময় ব্যস্ত ছিলেন আলেয়া।

করোনার সময় সন্তানদের স্কুল বন্ধ ছিল। হাতে অলস সময়। জমানো রেসিপির ভান্ডার খুলে বসলেন। তৈরি করতে শুরু করলেন মজার মজার খাবার। পরিবারের লোকজনকে খাওয়ান, বন্ধুবান্ধবকে উপহার পাঠান। চারদিক থেকে প্রশংসা আসতে থাকে। এসব দেখে সন্তানেরা তাকে ফেসবুকে পেজ খুলতে বলেন, কিন্তু তিনি আরও একটু সময় নিতে চান। এর মধ্যেই রান্নার ওপরে দুটি কোর্স করে ফেলেন আলেয়া। একজন কোর্স কো-অর্ডিনেটর তাঁর দক্ষতা দেখে ফেসবুকে পেজ খুলে দেন। তাঁর নাম অনুসারে পেজের নাম দেওয়া হয় আলেয়াস বেকারি (Aleya’s bakery)। সেই শুরু। আলেয়া ফেসবুক পেজে তাঁর পণ্যের প্রস্তুত প্রণালিসহ পোস্ট দেন।

আলেয়ার তৈরি কেক
ছবি: সংগৃহীত

২০২১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী নগরের গণকপাড়ার একটি রেস্তোরাঁয় ‘হোমমেড পেস্ট্রি অ্যান্ড ফুডস ফেয়ার ২০২১’ নামে দুই দিনের একটি মেলার আয়োজন করে রিনিস কিচেন নামের অনলাইনভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান। এ মেলায় তাঁর বিচিত্র খাবারের পদ দেখে হুমড়ি খেয়ে পড়েন দর্শনার্থীরা। সবাইকে তাক লাগিয়ে আলেয়া সেবার ৬৬ হাজার টাকার পিঠা বিক্রি করেন। এরপর আর তাঁকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এখন তাঁর তালিকায় আছে ৪৯টি পণ্য। তাঁর ফেসবুকে পেজে ঢুঁ মেরে যে কেউ দেখতে পারেন কত রকমের কেক হতে পারে। যেকোনো কেকই তাঁর হাতের নকশায় হয়ে ওঠে ভিন্ন রকম। এমনকি ক্রিকেট মাঠের আদলও উঠে এসেছে কেকে।

১১ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী নগরের কাজীহাটা এলাকায় তাঁর বাসায় গিয়ে দেখা যায়, তাঁর সেই রেসিপিওয়ালা পত্রিকার কাটিংয়ের স্তূপ। তখন চকলেট ডোনাট তৈরি করছিলেন আলেয়া। তাঁকে সহযোগিতা করছেন বড় বোন শিউলি ও দুই ভাগনি। দেখে দেখে তাঁরাও এ কাজে পারদর্শী হয়ে উঠেছেন। আলেয়া বাইরে থাকলে ফরমাশ অনুযায়ী তাঁরা এখন খাবার সরবরাহ করতে পারেন।

আলেয়া কিন্তু বসে নেই। তিনি একাডেমিকভাবে নিজেকে সমৃদ্ধ করার জন্য ঢাকার বিভিন্ন কর্মশালায় নিয়মিতভাবে অংশ নিচ্ছেন। আলেয়া বলেন, ‘শুধু দেখে শেখা নয়, একাডেমিকভাবেও নিজেকে সমৃদ্ধ করতে চাই। এতে ক্রেতাদের জন্য মানসম্মত নতুন নতুন খাবার তৈরি করতে পারব।’