লাশের পাশে গোলাপ পেয়েছিলেন আছমা

রানা প্লাজা ট্রাজেডির পর মাকে হারানো ভাইবোন ইয়ানুর ও সবুজকে এভাবেই আপন করে নিয়েছিলেন আছমা আক্তারসংগৃহীত

ঢাকার সাভারের অধরচন্দ্র বিদ্যালয়ের মাঠ লোকারণ্য। লাশ খুঁজছে মানুষ, প্রিয়জনের লাশ। মানুষের আর্তি ও আহাজারিতে ভারী হয়ে আছে বাতাস। উদ্বেগ-উত্কণ্ঠায় একটা দমবন্ধ পরিবেশ। ধসে পড়া নয়তলা ভবনের ভগ্নস্তূপ থেকে উদ্ধার করে এখানে এনে রাখা হচ্ছে এক একটা ক্ষতবিক্ষত, বিকৃত লাশ। আর সেই লাশ নিজের মা-বাবা, ভাই-বোনের কি না, দেখার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছে মানুষ। সেটা ২০১৩ সালের ঘটনা। ২৪ এপ্রিল ঘটে গেছে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম শিল্প-দুর্ঘটনা রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি। নিহত হয়েছেন অন্তত ১ হাজার ১৩৬ জন শ্রমিক, যার অধিকাংশই নারী। আহত আরও ২ হাজার।

আহত-নিহতদের উদ্ধারপর্ব চলছিল বেশ কিছুদিন ধরে। সে রকম একটি দিনে অধরচন্দ্র বিদ্যালয়ের মাঠে ৯-১০ বছরের একটি ছেলে এসে স্বেচ্ছাসেবী ও উদ্ধারকর্মী আছমা আকতারকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। এত মানুষের ভিড়ে তাঁকেই কেন নিরাপদ আশ্রয় মনে হয়েছিল ক্লান্ত-বিপর্যস্ত ছেলেটার, কে জানে। কিন্তু সেদিন থেকে মা ও ছেলের সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল আছমা ও সাকিবের। ‘লাশের পাশে সেদিন যেন গোলাপ পেয়েছিলাম আমি।’—বলছিলেন আছমা।

ছেলেটিকে সেদিন নিজের লালমাটিয়ার বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন তিনি। খাইয়ে-দাইয়ে শান্ত করে জানতে চেয়েছিলেন তার দুর্ভাগ্যের কথা। রানা প্লাজার একটি তৈরি পোশাক কারখানায় (গার্মেন্টস) কাজ করত সাকিবের মা ও বড় বোন। দুর্ঘটনার দিনই রাত ১২টার পর গুরুতর আহত অবস্থায় পাওয়া গেছে বড় বোনকে। কিন্তু মাকে পাওয়া যায়নি তখনো, শেষ পর্যন্ত সেই লাশ পাওয়া গিয়েছিল ১৭ দিন পরে।

রানা প্লাজার কাছেই একটি বস্তিতে থাকে সাকিবদের পরিবার। সেখানে শোকের মাতম। সাকিবের সবচেয়ে ছোট ভাই তিন-চার বছর বয়সী সবুজ তাঁর কোলে উঠে এমনভাবে বুকে মুখ গুঁজে ছিল, সে কথা এত দিন পর বলতে গিয়ে আবারও অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন আছমা, ‘আমি তো ওর আম্মাকে দেখিনি, সবাই বলছিল ওনার সঙ্গে আমার চেহারার অনেক মিল।’

আছমা আক্তারের একটি ছেলে জন্মানোর পর মারা গিয়েছিল। আর কোনো সন্তান নেই। সেই অতৃপ্ত মাতৃহৃদয় যেন জেগে উঠেছিল সাকিব, সজীব ও সবুজকে দেখে। সেদিন থেকে আছমা আক্তারের শুরু হলো সাকিবের আপু ইয়ানুরকে বাঁচানোর যুদ্ধ। মেয়েটার অবস্থা খুব খারাপ ছিল। বাঁচার সম্ভাবনা কম, বাঁচলেও পা কেটে বাদ দিতে হবে। চিকিত্সকদের এসব কথা শুনে এই নিয়তিই যেন মেনে নিয়েছিলেন মেয়ের বাবাও। কিন্তু দমে যাননি আছমা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে ইয়ানুরকে আনা হলো অ্যাপোলো হাসপাতালে। লাইফ সাপোর্টে ছিল দুদিন। কিন্তু ডাক্তারদের পেছনে পাগলের মতো ছুটেছেন আছমা আকতার, ‘আমার মেয়েটাকে যেভাবেই হোক বাঁচান…। ’

আছমা আকতার একজন থিয়েটার কর্মী

শেষ পর্যন্ত অনেকটা অবিশ্বাস্যভাবেই যেন জীবন ফিরে পেল ইয়ানুর। ডা. জুবায়ের নামের একজন চিকিত্সক সেদিন তাঁকে বলেছিলেন, ‘আপনাকে দেখে বুঝলাম পৃথিবীতে মায়ের শক্তির চেয়ে বড় কোনো শক্তি নেই।’ সে কথা ভেবে এখনো কেঁদে বুক ভাসান আছমা।

আছমা আকতার একজন থিয়েটার কর্মী। নাটক লেখেন, মঞ্চে অভিনয় করেন। ‘নাটনন্দন’ নামের একটি নাট্যদলের সঙ্গে সম্পৃক্ত তিনি। পারিবারিক সহিংসতার ওপর লেখা তাঁর নাটক নারী ও রাক্ষুসীর ২০০ প্রদর্শনী হয়েছে। দেশের বাইরে কলকাতা ও লন্ডনেও প্রদর্শনী হয়েছে এ নাটকের।

আছমা আক্তারের আরেকটা পরিচয় তিনি একজন স্বেচ্ছাসেবী। খুব কম বয়সে বাবার উত্সাহে তিনি ফায়ার সার্ভিসের স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। সব সময় দুর্গত মানুষের জন্য, নির্যাতিত নারীর জন্য কিছু একটা করার তাগিদ বোধ করেছেন ভেতর থেকে। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির সংবাদ টেলিভিশনের স্ক্রলে দেখেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন উদ্ধার প্রক্রিয়ায় শামিল হবেন তিনি। একটি শাবল কিনে নিয়ে তখনই ছুটে গিয়েছিলেন ঘটনাস্থলে। নিজের গয়না বিক্রি করে ১০০ গজ কাফনের কাপড়ও কিনেছিলেন।

১০-১২ জনের একটি দল হয়ে গিয়েছিল তাঁদের। ক্রলিং করে ভাঙা ভবনটির ভেতরে ঢোকা, সেখানে জীবিত, অর্ধমৃত বা মৃতব্যক্তির খোঁজ করা, পাওয়া গেলে বের করে আনা—সে এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। দলের সবাই ট্রমায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। প্রতিদিনই কেউ না কেউ জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন। বাবু নামের একজন ২২-২৩ বছরের তরুণ তো মানসিক ভারসাম্যই হারিয়ে ফেলেছিলেন।

পরে এই সাহস, সেবা ও স্বেচ্ছাশ্রমের জন্য বিভিন্ন সংগঠন থেকে পুরস্কৃত হয়েছিলেন আছমা। কিন্তু সেই পুরস্কারের চেয়েও ইয়ানুরকে সুস্থ করে তুলতে পারা, সাকিব, সজীব ও সবুজের মুখ থেকে ‘মা’ ডাক শোনা অনেক বড় পুরস্কার বলে মনে করেন তিনি।

সাকিব, সজীব ও সবুজ এখন থাকে চট্টগ্রামে ওল্ড রাজশাহী ক্যাডেট অ্যাসোসিয়েশনের শিশু নিকেতন অরকা হোমসে। বাংলাদেশ নৌবাহিনী স্কুলে যথাক্রমে দশম, ষষ্ঠ ও তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে তিন ভাই।

‘আছমা আক্তারকে চেনো?’—এ কথা জিজ্ঞেস করতেই একগাল হাসিতে মুখ ভরিয়ে সাকিব বলল, ‘আমার আম্মু।’

এ কথা আছমাকে জানালে তিনি বললেন, ‘চট্টগ্রামে যাওয়ার সুযোগ তো পাচ্ছি না। আমার ছেলেগুলোকে একটু দেখে রাখবেন।’ বলতে বলতে গলা ধরে আসছিল তাঁর।