লুঙ্গি পরা সাহেব

জন উইলিয়াম হুড–এর আবাস অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে। তবে বাংলা সাহিত্যচর্চায় নিয়মিত বিচরণ কলকাতা ও ঢাকায়। ছয় দশকে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেছেন বিখ্যাত বেশ কিছু বাংলা বই। তাঁর গল্প শুনলেন কাউসার খান

সকালে ফোন করতেই ‘সুপ্রভাত’ শব্দটা শুনে মনটা ভরে গেল। সিডনি থেকে মেলবোর্ন। অস্ট্রেলিয়ার দুই শহরে আমাদের দুজনের বাস। করোনাকাল বলে মুঠোফোনেই আলাপ। বিদেশি হয়েও চমৎকার বাংলা বলেন জন উইলিয়াম হুড। বছর তিনেক ধরে ফেসবুকসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে বাঙালি-বাংলা নিয়ে তাঁর বিচরণ দেখছিলাম। বাংলা সাহিত্য, চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতির নানা বিষয়ে গভীরভাবে জানেন এবং চর্চা করেন। তাঁর সম্পর্কে জানার আগ্রহ থেকেই আলাপ।

‘বাংলার সঙ্গে পথচলা কীভাবে শুরু?’ আলাপচারিতার শুরুতেই জানতে চাইলাম। নিজেকে মেলে ধরলেন জন হুড, ‘আমি সিরিয়াস পড়ুয়া ছিলাম না। মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পড়তে যাই। প্রথমে যে বিষয় নিয়ে শুরু করেছিলাম, মাসখানেক যেতেই বুঝেছি, সে বিষয় আমাকে দিয়ে হবে না। তো এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, কী নিয়ে পড়ব? সে আমাকে সব বিষয়ের একটা তালিকা দিয়ে বলল, চোখ বন্ধ করে আঙুল দে, যেটাতে আঙুল পড়বে, সেটাই পড়বি।’ মজার ছলে জন হুড তা–ই করলেন। আর তাঁর আঙুল পড়ল ভারততত্ত্ব বিষয়ের ওপর।

জন উইলিয়াম হুড
ছবি: সংগৃহীত

ভবিষ্যতের কথা খুব একটা না ভেবেই পড়তে শুরু করলেন ভারততত্ত্ব। ‘তবে একসময় মনে হয়েছে, বিষয়ের নাম ভারততত্ত্ব না হয়ে বাংলাতত্ত্ব হওয়া উচিত ছিল। কারণ, যা-ই পড়েছি, সবই ছিল বাংলা, বাংলা সাহিত্যসংক্রান্ত,’ যোগ করেন জন হুড।

১৯৬৬ সালে স্নাতক সম্পন্ন করেন জন হুড। এর মধ্যে কলকাতায় এসে ছয় সপ্তাহ থাকেন। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি টান অনুভব করেন তখনই। সে টানে তিনি বারবার আসেন কলকাতায়।

কলকাতা থেকে ঢাকায়

ভারতের পুনেতে একবার চলচ্চিত্রবিষয়ক একটা সেমিনারে গিয়েছিলেন জন হুড। সেখানেই চলচ্চিত্রকার তানভীর মোকাম্মেলের সঙ্গে পরিচয়। তাঁর আমন্ত্রণেই প্রথম বাংলাদেশে আসেন হুড। সে–ও অনেক আগে বলে সময়টা ঠিক মনে করতে পারলেন না তিনি।

ঢাকায় এসে নতুন আরেক বাংলার সঙ্গে পরিচয় হলো। অল্প কদিনেই অনেক বন্ধু জুটে গেল। এরপর অনেকবার এসেছেন বাংলাদেশে। ঘুরেছেন ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা। এমনই এক যাত্রায় রাজশাহীতে প্রয়াত লেখক হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে দেখা। শুধু সাক্ষাৎ নয়, তৈরি হয়ে যায় হৃদ্যতা। পরে হাসান আজিজুল হকের উপন্যাস সাবিত্রী উপাখ্যান অনুবাদ করেন। বইটি বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশের অপেক্ষায় আছে বলে জানালেন হুড। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নিয়ে লিখেছেন দ্য ব্লিডিং লোটাস: নোশনস অব নেশন ইন বাংলাদেশি সিনেমা নামের একটি বই। জন হুড বলছিলেন, ‘বাংলাদেশের ক্ল্যাসিক সাহিত্যের ওপর আমি বই লিখেছি। ফোকাস অন বাংলাদেশ: ডকুমেন্টারি ফিল্মস অব তানভীর মোকাম্মেল নামে বইটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বাংলা সাহিত্য, ঢাকাই চলচ্চিত্র নিয়ে হলেও বইটিতে এসবের বাইরে আরও অনেক কথা আছে।’

সাহেবি পোশাক ছেড়ে জন হুড প্রায়ই পরেন লুঙ্গি, ফতুয়া, পাঞ্জাবি
ছবি: সংগৃহীত

বাংলার মুখ তিনি দেখিয়াছেন

ঢাকায় এলেই বাংলার নানা প্রান্তর চষে বেড়ান জন হুড। অনুভব করেছেন শ্যামল বাংলার রূপ। অথচ একসময় অন্য পশ্চিমা তরুণের মতো তাঁর কাছেও বাংলা সাহিত্য মানেই ছিল খুব বড়জোর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি যেমনটি বলেন, ‘ষাটের দশকে যখন ভারততত্ত্ব পড়তে শুরু করি, তখন শুধু মহাত্মা গান্ধী আর জওহরলাল নেহেরুর কথা জানতাম। রবীন্দ্রনাথের নামও শুনিনি। বাংলা সাহিত্যকে আমি ধীরে ধীরে চিনেছি।’

এ প্রসঙ্গে ঢাকার একটি গল্প শোনালেন হুড, ‘ঢাকায় একদিন রিকশায় কোথাও যাচ্ছিলাম। চিরচেনা ট্রাফিক জ্যামে আটকে আছি। রিকশাচালক আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে হঠাৎ বলল, তুমি কি লেখক?’ দম নেন হুড। আবার বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়ায় আমার বেশভূষা দেখে কেউ এমন প্রশ্ন করলে হয়তো জিজ্ঞেস করত, আমি ক্রিকেটার বা ফুটবলার কি না। কিন্তু বাঙালির দেখার ভঙ্গিও কতটা ভিন্ন, সেটাও আমাকে অভিভূত করেছে।’

বাংলার পথে ঘুরতে ঘুরতেই একদিন লালনের সন্ধান পেয়ে যান, ‘আমি যখন প্রথম “খাঁচার ভেতর অচিন পাখি” গানটি শুনি, তখন ভীষণ অবাক হই। যদিও শুনেই বুঝতে পারিনি, ইংরেজি অনুবাদ করে বুঝেছি। তখন আমার ভাবনায় এল, কত আগে বিচ্ছিন্ন প্রত্যন্ত এক জায়গায় বসে প্রায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদীক্ষা ছাড়াই একজন বাঙালি কত গভীর একটা দার্শনিক চিন্তা করে গেছেন। এগুলো ভেবে ভেবে চলতে চলতেই আমার এক বন্ধুর মাধ্যমে রাজা সেন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, সন্দীপ রায়ের নির্মিত বাংলা সিনেমার ইংরেজি সাবটাইটেল লেখার সুযোগ পেয়েছি। পাশাপাশি সত্যজিৎ রায়ের সিনেমাজীবনের ওপর একটা বইও লিখি। নাম বিয়ন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড অব অপু: ফিল্মস অব সত্যজিৎ রায়।’

জন হুড ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেছেন বিখ্যাত বেশ কিছু বাংলা বই

অনারারি বেঙ্গলি

নীহাররঞ্জন রায়ের বাঙালির ইতিহাস, বুদ্ধদেব গুহর কোজাগর, প্রফুল্ল রায়ের কেয়া পাতার নৌকো, সিন্ধুপারের পাখি প্রভৃতি বইয়ের অনুবাদসহ তাঁর লেখা ২২টি গ্রন্থ ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। প্রফুল্ল রায়ের স্নেহধন্যও হুড। শুধু প্রফুল্ল রায় নন, পেয়েছেন বিপ্লবী বিনোদবিহারী চৌধুরী, চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর সান্নিধ্য। দুই বাংলার সাহিত্য ও চলচ্চিত্রপাড়ায়ই তাঁর যেমন আলাদা পরিচিতি রয়েছে, তেমনি আছে অসংখ্য শুভাকাঙ্ক্ষী ও বন্ধু।

প্রফুল্ল রায় তাঁকে ভালোবেসে ‘অনারারি বেঙ্গলি’ বলে অভিহিত করেন। এমন অভিধার কারণও অবশ্য আছে। তিনি যে সাহেবি শার্ট-প্যান্ট ছেড়ে প্রায়ই পরেন বাঙালি পোশাক লুঙ্গি, ফতুয়া, পাঞ্জাবি। বেশভূষা আর মননে জন উইলিয়াম হুড বাঙালির চেয়েও বেশি বাঙালি।

এখনো তিনি সাহিত্যকর্ম নিয়েই আছেন। প্রকাশের অপেক্ষায় বেশ কিছু বই। করোনাকালে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নেই আছেন। জানালেন, কোভিড শেষের দিকে, শিগগিরই আসছেন বাংলায়।