শরীরে শর্করা কম থাকলে আরও বেশি ক্ষতি

ডায়েটের ক্ষেত্রে একেবারেই ভাত খাওয়া যাবে না, এমন ধারণা মোটেই সঠিক নয়। প্রথম আলো ফাইল ছবি
ডায়েটের ক্ষেত্রে একেবারেই ভাত খাওয়া যাবে না, এমন ধারণা মোটেই সঠিক নয়। প্রথম আলো ফাইল ছবি

ওজন অনেকটাই বেড়ে গেছে বা বেড়ে যাচ্ছে? আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজেকে অনেকটা বেঢপ লাগছে? বিশেষ করে পেটের দিকে জামাটা আঁটো হয়ে উঁকি দিচ্ছে। পছন্দের জামাটা পরতে গিয়েও আবার আলমারিতে রেখে দিতে হচ্ছে। চোঁ করে চাঁদি গরম। কিড়বিড়ে রাগের সঙ্গে ধনুক-ভাঙা পণ—আজ থেকে কম খেতে হবে।

সবার আগে কাটছাঁটের কাঁচি চালানো হয় শর্করার (কার্বোহাইড্রেট) ওপর। অনেকে ভাত, রুটি, চিনি খাওয়া একেবারে বন্ধ করে দেন। অনেকে এর পরিমাণ একেবারে কমিয়ে দেন। অনেকে শর্করাবর্জিত শুধু প্রোটিন ও ফ্যাটজাতীয় খাবার খাওয়া শুরু করেন। হয়তো দু-চার দিন এ ধরনের খাবার গ্রহণ করা যায়, দিনের পর দিন নয়। ভাবুন তো ভাত, রুটি বা কার্বোহাইড্রেট খাবারের অভাবে আয়ু কমে যাচ্ছে।

পুষ্টিবিজ্ঞানের মতে, শর্করা হচ্ছে শরীরে শক্তির মূল জোগানদাতা। শর্করা ভেঙে গ্লুকোজ তৈরি হয়। এই গ্লুকোজ একাই স্নায়ুতন্ত্রের শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করে। তাই মানুষের প্রতিদিনের খাবারে মোট ক্যালরির ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ শর্করা থাকা উচিত। চাল ও আটাজাতীয় খাবার হলো শর্করা মূল উৎস।

ভাতজাতীয় খাবার হলো শর্করার মূল উৎস। সাদা ভাতের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (জিআই) বেশি বলে এটি শর্করা বাড়ায়। প্রথম আলো ফাইল ছবি
ভাতজাতীয় খাবার হলো শর্করার মূল উৎস। সাদা ভাতের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (জিআই) বেশি বলে এটি শর্করা বাড়ায়। প্রথম আলো ফাইল ছবি

সম্প্রতি প্রকাশিত মার্কিন নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, লো-কার্ব ডায়েট বা খুব কম শর্করা খেলে আয়ু চার বছরের মতো কমে যেতে পারে। লন্ডনভিত্তিক প্রভাবশালী চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য-বিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেটে গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয়, যুক্তরাষ্ট্রে ২৫ বছর ধরে এ নিয়ে গবেষণা চলেছে। এতে ২০টি দেশের প্রায় হাজার ৪০০ মানুষ অংশ নেন। তাঁরা কী কী খাবার ও পানীয় কী পরিমাণে গ্রহণ করেছেন, এ ব্যাপারে তথ্য নেওয়া হয়। সেই পরিমাণ খাবার থেকে কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট এবং প্রোটিন থেকে কী পরিমাণে ক্যালরি পাওয়া গেছে, তারও হিসাব করেন গবেষকেরা।

গবেষকেরা প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, যাঁরা শর্করা থেকে দৈনিক ৫০-৫৫ শতাংশ ক্যালরি গ্রহণ করেন (খাদ্যগ্রহণে যুক্তরাজ্যের নির্দেশিকা ও মাঝারি মাত্রায় শর্করা খাওয়া), তাঁদের মৃত্যুঝুঁকি অন্যদের (যাঁরা খুব কম বা বেশি কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ করে) তুলনায় কম।

এ প্রসঙ্গে বারডেম হাসপাতালের প্রধান পুষ্টিবিদ শামছুন্নাহার বলেন, শর্করার কাজ হলো শরীরের শক্তি তৈরি করা। আর একজন মানুষের দৈনন্দিন ক্যালরির ৫০ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট থাকা দরকার। কেউ কেউ কার্বোহাইড্রেট কমাতে কমাতে একপর্যায়ে ৫ শতাংশে নামিয়ে আসে, যা একেবারেই ঠিক নয়। কারণ, শর্করার সঙ্গে ভিটামিন ও মিনারেলসের সম্পর্ক থাকে। অনেকে শর্করা কমিয়ে প্রোটিন ও ফ্যাটজাতীয় খাবার খায়। এই খাবারগুলো তখন শর্করার ঘাটতি পূরণে লেগে যায়, তখন প্রোটিনের অভাবও তৈরি হয়। নিত্যদিনে প্রয়োজনীয় পরিমাণ ক্যালরি কিংবা প্রোটিন না খেলে মস্তিষ্ক, চোখ সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। এমনকি ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা এবং হরমোনের ঘাটতি দেখা দেয়। ফলে মানুষ ধীরে ধীরে কর্মশক্তি হারায়, ভিটামিন মিনারেলেসের অভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, নিস্তেজ হতে থাকে, মাংসপেশি ক্ষয় হয়। অন্যান্য রোগের ঝুঁকি বাড়ে। দীর্ঘায়ু হওয়ার সম্ভাবনা কমে।

যাঁরা শর্করা থেকে দৈনিক ৫০-৫৫ শতাংশ ক্যালরি গ্রহণ করেন, তাঁদের মৃত্যুঝুঁকি অন্যদের (যাঁরা খুব কম বা বেশি কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ করেন) তুলনায় কম।
যাঁরা শর্করা থেকে দৈনিক ৫০-৫৫ শতাংশ ক্যালরি গ্রহণ করেন, তাঁদের মৃত্যুঝুঁকি অন্যদের (যাঁরা খুব কম বা বেশি কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ করেন) তুলনায় কম।

একই কথা বললেন আরেক পুষ্টিবিদ আখতারুন নাহার। তিনি বলেন, পর্যাপ্ত শর্করার অভাবে ব্লাড সুগার কমে যায়। মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ কমে যায়। মানুষের ভুলে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ে।

যে শর্করা যত দ্রুত রক্তে মেশে, তত খারাপ

কথায় বলে, আমরা ভেতো বাঙালি। ভাত না হলে আমাদের চলেই না। পেট ভরে গেলেও তরকারিটা মজাদার হয়েছে—এমন অজুহাতে আর এক চামচ ভাত তুলে নিই প্লেটে। আসলে ভাতই হলো শর্করার মূল উৎস। সাদা ভাতের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (জিআই) বেশি বলে এটি শর্করা বাড়ায়। সে হিসাবে সাদা ভাত, সাদা ময়দার তৈরি খাবার, আলু, পাউরুটি ইত্যাদি তুলনামূলক দ্রুত শোষিত হয়ে রক্তে মেশে। যে শর্করা যত দ্রুত রক্তে মেশে, তত খারাপ। আর এসব খাবারে আঁশের পরিমাণও কম।

সুস্থ থাকতে অবশ্যই ব্যায়াম করতে হবে। প্রথম আলো ফাইল ছবি
সুস্থ থাকতে অবশ্যই ব্যায়াম করতে হবে। প্রথম আলো ফাইল ছবি

শামসুন্নাহার নাহিদ বলেন, ভাত খেতে হবে সাইড ডিশ হিসেবে। অর্থাৎ, রাতের খাবারের তালিকায় ডিমের সাদা অংশ, রঙিন সবজির সঙ্গে সামান্য পরিমাণে ভাত রাখা যায়। মূল খাবার হিসেবে কিন্তু কখনোই ভাত খাওয়া যাবে না। অর্ধেক কাপ সাদা ভাতে রয়েছে ২২ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, যা ১৭ শতাংশ পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে। সাদা ভাত ইনসুলিনের পরিমাণ ঠিক রেখে রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখে। চাইলে স্বাদে ভিন্নতাও আনতে পারেন। ভাতের সঙ্গেই লেবুর রস, গুল্ম বা সবজি যেমন: ধনেপাতা, লেটুস, ক্যাপসিকাম এগুলো একসঙ্গে খাওয়া যেতে পারে। তাই ডায়েটের ক্ষেত্রে একেবারেই ভাত খাওয়া যাবে না, এমন ধারণা মোটেই সঠিক নয়।

পুষ্টিবিদ আখতারুন নাহার বলেন, ‘আপনি যদি ভাত খেতে না চান, তবে নুডলস, চিড়া, মুড়ি, ওটমিল কিংবা লাল আটার রুটিও খেতে পারেন। আর আপনি এই শর্করা কতটুকু খাবেন, তা সম্পূর্ণ নির্ভর করবে আপনার বয়স, উচ্চতা ও ওজনের ওপর। তবে সব সময়ই খাদ্যতালিকায় পরিমিত পরিমাণে শর্করা, প্রোটিন রাখা চাই।’

এক মার্কিন গবেষণা বলছে, কার্বোহাইড্রেটের পরিবর্তে বেশি পরিমাণে মাংস খেলে মৃত্যুঝুঁকি বাড়ে। প্রথম আলো ফাইল ছবি
এক মার্কিন গবেষণা বলছে, কার্বোহাইড্রেটের পরিবর্তে বেশি পরিমাণে মাংস খেলে মৃত্যুঝুঁকি বাড়ে। প্রথম আলো ফাইল ছবি

সুস্থ থাকতে ও ওজন কমাতে যা করতে হবে
পুষ্টিবিদেরা বলছেন, সুস্থ থাকতে হলে সুষম খাবার খেতে হবে। নিজে নিজে কিছু করা যাবে না। অবশ্যই পুষ্টিবিদের সঙ্গে পরামর্শ করে তা করতে হবে। তিনি পরামর্শ দেন, সুস্থ জীবনের জন্য প্রয়োজন তিনটি জিনিস। দিনের ঘুম বাদ দিতে হবে, রাতে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা ঘুমাতে হবে। একবারে বেশি না খেয়ে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে দিনে পাঁচ থেকে ছয়বার খাবার খেতে হবে। আর অবশ্যই ব্যায়াম করতে হবে। অল্প খেয়ে শুয়ে-বসে থাকলে লাভ হবে না। ক্যালরি বার্ন করতে হবে। বাইরে হাঁটার সুযোগ না থাকলে ঘরে কায়িক পরিশ্রম করতে হবে। খেলাধুলা ও নাচ করলেও প্রচুর ক্যালরি দহন হয়। পুষ্টিবিদ শামসুন্নাহার বলছেন, লো ক্যালরির ডায়েট হতে পারে অবশ্যই লো-কার্ব ডায়েট নয়।

খাদ্যতালিকায় থাকতে হবে সব ধরনের খাবার। প্রথম আলো ফাইল ছবি
খাদ্যতালিকায় থাকতে হবে সব ধরনের খাবার। প্রথম আলো ফাইল ছবি

গবেষণার কিছু ফলাফল
গবেষকেরা দেখেছেন, ৫০ বছর বয়স থেকে মাঝারি মাত্রার কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ করলে আয়ু আরও ৩৩ বছর বেড়ে যেতে পারে। যাঁরা অতিরিক্ত কম কার্বোহাইড্রেট থেকে দৈনিক ৩০ শতাংশ বা এর কম ক্যালরি গ্রহণ করেন, তাঁদের চেয়ে ২৯ বছর বেশি বাঁচা যাবে। কম কার্বোহাইড্রেট থেকে ৩০-৪০ শতাংশ ক্যালরি গ্রহণকারীদের তুলনায় ২ বছর ৩ মাস বেশি বাঁচা যাবে। আর প্রচুর পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট থেকে যাঁরা ৬৫ শতাংশ ক্যালরি গ্রহণ করেন, তাঁদের চেয়ে এক বছর এক মাস বেশি আয়ু হবে।

শাকসবজি, ফল ও চিনিতেও কার্বোহাইড্রেট পাওয়া যায়। তবে এর মূল উৎস আলু, রুটি, ভাত ও কর্নফ্লেক্সের মতো খাদ্যশস্য রয়েছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, কার্বোহাইড্রেটের পরিবর্তে বেশি পরিমাণে গরু, ভেড়া, শূকর ও মুরগির মাংস এবং পনির খেলে মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায়। এর বদলে প্রচুর উদ্ভিজ্জ প্রোটিন ও ফ্যাট (ডাল ও বাদাম) গ্রহণ করলে এই মৃত্যুর ঝুঁকি কিছুটা কম। কারণ, এগুলোতে অল্প পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট আছে।

এই গবেষণার নেতৃত্বদানকারী সারা সেইডেলমান বলেন, সুস্বাস্থ্য এবং ওজন কমানোর কৌশল হিসেবে বর্তমান বিশ্বে লো-কার্ব, প্রোটিন ও ফ্যাট গ্রহণ বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তথ্য-উপাত্ত বলছে, প্রাণিজভিত্তিক কার্বোহাইড্রেট কম গ্রহণ করলেও আয়ু কমে। তাই এটিকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। আর কেউ যদি কম কার্বোহাইড্রেট খেতেই চান, তাহলে উদ্ভিজ্জ ফ্যাট ও প্রোটিন বেশি নিলে দীর্ঘায়ু হবেন।

ভিটামিন সি থাকায় শর্করার চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি আলু শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। কারণ, আলুতে থাকা ভিটামিন সি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। প্রথম আলো ফাইল ছবি
ভিটামিন সি থাকায় শর্করার চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি আলু শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। কারণ, আলুতে থাকা ভিটামিন সি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। প্রথম আলো ফাইল ছবি


ভাতের পরিবর্তে অন্যান্য শর্করা খাবার
চাইলে ব্রাউন রাইস কিংবা বাদামি রঙের চালের ভাত খেতে পারেন। কেননা, এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, খনিজ ও আঁশ রয়েছে। শুধু এক কাপ ব্রাউন রাইসের মধ্যে রয়েছে ২২০ ক্যালরি এবং ৪ গ্রাম ডায়েটের উপযুক্ত আঁশ। গ্রামে অনেকে ভাতের বদলে মিষ্টি আলু সেদ্ধ খান। এ আলু শর্করা হলেও এতে প্রচুর আঁশ থাকায় জিআই কম।

সাদা ভাতে ব্রাউন রাইসের (ঢেঁকিছাঁটা লাল চাল) তুলনায় ফ্যাট ও কার্বোহাইড্রেট বেশি থাকে, তাই এটি খেতে হবে স্বল্প পরিমাণে। শামসুন্নাহার নাহিদ বলেন, ‘আপনার যদি ৬০ শতাংশ শর্করার প্রয়োজন থাকে, তাহলে আপনি সেটি প্রতি বেলার খাবারে ভাগ করে নিন। ধরা যাক, দিনে ৭ থেকে ৮ বার খাবারে ৬ শতাংশ করে শর্করা ভাগ করে নিলেন।’

শর্করা হিসেবে ক্যালরির মান ভাত, রুটি, নুডলস ইত্যাদিতে প্রায় সমান। যেমন: ১২০ গ্রাম ভাতে আছে ১৪০ ক্যালরি, দুটো রুটিতে ১৫০ ক্যালরি। এক কাপ মুড়িতে ১১০ ক্যালরি, আধা কাপ নুডলসে ১০০ ক্যালরি। দুই টুকরো পাউরুটিতে একটু বেশি—১৫৬ ক্যালরি। এক কাপ সেদ্ধ আলুতে ৮৫ ক্যালরি, ৩৫ গ্রাম ওটমিলে ১৩৬ ক্যালরি থাকে। তাই ভাতের বদলে সমপরিমাণ ক্যালরি হিসাব করে যেকোনো বিকল্প শর্করা খাওয়া যাবে।

পুষ্টিবিদ আখতারুন নাহার বলেছেন, শর্করা বাদ দেওয়া যেমন খারাপ, তেমনি অতিরিক্ত শর্করা খাওয়াও ক্ষতিকর। কেননা, অতিরিক্ত শর্করা শরীরে চর্বি তৈরি করে। ফলে ওজন বেড়ে যায় এবং অন্ত্রকে উত্তেজিত করে। এ জন্য শর্করা খেতে হবে সীমিত পরিমাণে, একেবারে বর্জন নয়।