শাড়ির বুননে স্বপ্ন আঁকেন ফরিদা

বেনারসি নিয়ে ফরিদা রহমানের উদ্যোগ। ছবি: মঈনুল ইসলাম
বেনারসি নিয়ে ফরিদা রহমানের উদ্যোগ। ছবি: মঈনুল ইসলাম

বিয়ের পর শাড়ি কেনার জন্য বিদেশফেরত একজন আত্মীয় পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছিলেন তাঁকে। সেই টাকায় তিনি শাড়ি কেনেননি। কিনলেন নানা রঙের সুতা। এরপর স্বজনদের কাছ থেকে আরও ৪০ হাজার টাকা ঋণ নেন। এই টাকা ও সুতা দিয়ে পরিবারের দেওয়া দুটি তাঁতযন্ত্রে শাড়ি বুননের কাজ শুরু করলেন। সময়টা ২০০৫ সাল। সেই থেকে শুরু তাঁতশিল্পে শাড়ি বুননের যাত্রা। ১৩ বছরের ব্যবধানে একে একে গড়ে তুলেছেন ৩০টি তাঁতযন্ত্র।

রংপুরের এমনই একজন নারী উদ্যোক্তা হলেন ফরিদা রহমান। বয়স ৩৫ বছর। বাড়ি রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার গজঘণ্টা ইউনিয়নের তালুক হাবু গ্রামে। তাঁর তাঁতশিল্পে অনেক নারী-পুরুষের হয়েছে কর্মসংস্থানও।

ফরিদা রহমানের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিনি বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন থেকে তাঁতশিল্পের ওপর তিন মাসের প্রশিক্ষণ নেন ২০০৫ সালে। প্রশিক্ষণের পর থেকেই তাঁর চিন্তা তাঁতশিল্প কারখানা গড়ে তুলবেন। নিজে স্বাবলম্বী হবেন এবং সেই সঙ্গে হতদরিদ্র পরিবারের নারী-পুরুষদের কর্মমুখী করে তুলবেন।

এমন সময় যৌথ পরিবার থেকে ফরিদা ও তাঁর স্বামী আবদুর রহমানকে পৃথক করে দেওয়া হয়। তবে ওই সময় পরিবারের পক্ষÿ থেকে দুটি তাঁতযন্ত্র তাঁদের দেওয়া হয়। শুরু হয় স্বপ্নপূরণের যাত্রা। সেই যন্ত্রে ফরিদা শাড়ি বুননের কাজ শুরু করেন। সঙ্গে তাঁর স্বামী আবদুর রহমান সহযোগিতা করেন।

তাঁদের উৎপাদিত পণ্য বেনারসি শাড়ির বাজার ওই সময় রংপুরে ছিল না। তখন তাঁরা নিজেরাই ঢাকার মিরপুরে বাসে করে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করতেন। ধীরে ধীরে লাভ হতে থাকে। বাড়তে থাকে পুঁজি।

ঢাকা যাওয়া-আসা কষ্টের কারণে এরপর রংপুরে নিজ বাড়ির ঘরেই গড়ে তুললেন শাড়ির দোকান। ওই ঘরে তাঁরা রাতে ঘুমান। আর দিনের বেলা শাড়ি বিক্রি করেন। একসময় প্রচার পায়। শহরের মানুষজন শাড়ি কিনতে যায়। ক্রেতাদের চাহিদামতো নকশা নিয়ে তাঁদের শাড়ির অর্ডারও নেন। বাড়তে থাকে বিক্রি।

দুটি তাঁতযন্ত্র থেকে এক বছরের মাথায় আরও দুটি তাঁতযন্ত্র স্থাপন করেন। আস্তে আস্তে তাঁতযন্ত্র আরও বাড়াতে থাকেন। সেই সঙ্গে শ্রমিকের সংখ্যাও বাড়ে। এখন তাঁর নিয়মিত নারী-পুরুষ শ্রমিক রয়েছেন ১০০ জন।

এ ছাড়া তাঁর নিজের তাঁতযন্ত্রে কাজ ছাড়াও অন্য তাঁতযন্ত্র থেকেও শাড়ি তৈরি করে নেন। এভাবে শ্রমিকদের কর্মমুখী করে গড়ে তুলতে কাজ করে চলেছেন অবিরাম। এতে তাঁর চেষ্টার কমতি নেই। গ্রামের নারীদের তাঁতশিল্পের নানা কাজ শিখিয়ে পারদর্শী ও স্বাবলম্বী করে তোলার পেছনে এখনো অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন তিনি।

‘ফাইয়াজ বেনারসি’ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। তাঁতশিল্পের পাশাপাশি গ্রাম-শহরে তাঁর চারটি শোরুম। সেখানে তাঁতে তৈরি শাড়ি ও থ্রিপিস বিক্রি করা হচ্ছে। এসব পণ্য চলে যাচ্ছে রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। তাঁর উৎপাদিত শাড়ি-থ্রিপিস ক্রেতাদের আকৃষ্ট করে তোলে। পণ্যের চাহিদাও বাড়তে থাকে। এতে করে তাঁর উৎসাহ উদ্দীপনা আরও বেড়ে যায়।

রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার গজঘণ্টা ইউনিয়নের তালুক হাবু গ্রামের প্রেক্ষাপট এখন বদলে গেছে। সেখানে দিনভর ক্রেতাদের আনাগোনাও রয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীরা পাইকারি মালামালও কিনতে এখানে ছুটে আসেন। পাইকারি বিক্রি ছাড়াও চারটি শোরুম থেকে প্রতিদিন শাড়ি-থ্রিপিস দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা বিক্রি হয়ে থাকে।

৩ সেপ্টেম্বর সরেজমিনে দেখা যায়, তাঁতের কাপড় বুননে পর্যবেক্ষণ করছেন ফরিদা। শ্রমিকেরা কাজ করছেন। কর্মরত নারী শ্রমিক সাহেরা খাতুন বললেন, ‘গ্রামে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করেছেন আমাদের আপা।’

এরপর সাজানো গোছানো পরিপাটি শোরুমে কথা হলো ফরিদার সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘অনেক কষ্ট করেছি। অজগ্রামে দুটি তাঁতযন্ত্র বসিয়ে বেনারসি শাড়ি ও থ্রিপিস তৈরির কাজ শুরু করি। নিজের চেষ্টায় অক্লান্ত পরিশ্রম করে এখন ৩০টি তাঁতযন্ত্র হয়েছে।’ ফরিদা আরও বলেন, ‘ক্রেতাদের নজর কাড়তে নিজেই কাপড়ের নকশা করেছি। আমার এই কাজের সঙ্গে স্বামী আবদুর রহমানও সহযোগিতা করে থাকেন।’ আবদুর রহমান এসএসসি পাস। তাঁদের এক মেয়ে এক ছেলে।

ফরিদা বানু বিএ পাস করে বিএড করেছেন। শাড়ির বুননের সঙ্গে সাজিয়ে চলেছেন নিজের স্বপ্ন।