শিক্ষার শক্তি নিয়ে ঊর্মি চাকমার গবেষণা

অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটি থেকে সম্প্রতি পিএইচডি শেষ করেছেন ঊর্মি চাকমা
ছবি: সংগৃহীত

অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটি থেকে সম্প্রতি পিএইচডি শেষ করেছেন ঊর্মি চাকমা। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরা কীভাবে বাধা পেরিয়ে নিজের স্বপ্নের পথে এগিয়ে যেতে পারেন, তা অনুসন্ধানেই চার বছর ধরে কাজ করেছেন তিনি। সংক্ষেপে তাঁর পিএইচডির বিষয়, ‘শিক্ষাই হলো নিপীড়িত, শোষিত ও সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর উত্তরণের উপায়’।

মুঠোফোনে কথা হয় ঊর্মির সঙ্গে। ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার উপাচার্য অমিত চাকমার প্রসঙ্গ টেনে আলাপ শুরু করলেন। ঊর্মি বললেন, ‘ষাটের দশকে কাপ্তাইয়ে বাঁধ দিয়ে পানির গতিপথ আটকে দেওয়া হয়েছিল। তাতে রাঙামাটির চাকমা রাজার রাজবাড়িসহ ৫৪ হাজার একর আবাদি জমি রাতারাতি পানিতে তলিয়ে যায়। সেদিন যে লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়েছিল, তাদের মধ্যে একজন আজ অস্ট্রেলিয়ার প্রথম বাংলাদেশি উপাচার্য অমিত চাকমা।’

ঊর্মি চাকমা মনে করেন, শিক্ষার মাধ্যমেই সমাজে উত্তরণের পথ পাওয়া যায়। অমিত চাকমারই একটি কথা উদ্ধৃত করলেন তিনি, ‘সব যখন পানিতে তলিয়ে গেল, কিছুই রইল না; তখন আমাদের সম্বল ছিল কেবল শিক্ষা, পড়ালেখা। এই সম্বল আঁকড়ে ধরেই নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করতে চেষ্টা চালিয়ে গেছি।’

গবেষণাপত্রটি বই আকারে প্রকাশ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন ঊর্মি চাকমা। বইটির পর্যালোচনা করছেন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞানের একাডেমিক প্রকাশক রাউটলেজ। নিজের জীবন থেকে কীভাবে গবেষণার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন, সে কথা বলছিলেন এই গবেষক—‘যত দূর মনে পড়ে, হঠাৎ হঠাৎ আক্রমণের ভয়ে ছোটবেলায় আমরা পুরো পরিবার জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নিতাম। আমি যখন নবম শ্রেণিতে পড়ি, আমাদের গ্রামে মানুষের ঘরবাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এ রকম ভয়ার্ত অভিজ্ঞতা পেরিয়ে আমি অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে এসে থাকতে পারছি। শিক্ষার মাধ্যমে আমার সম্প্রদায়কে একটা উপহার দেওয়ার চিন্তা থেকেই পিএইচডি শুরু করি।’

স্বামী ও সন্তানদের সঙ্গে ঊর্মি চাকমা
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ি উপজেলার মাইসছড়ি গ্রামে জন্ম ঊর্মি চাকমার। মা স্কুলশিক্ষক কণিকা চাকমা ও বাবা অধ্যাপক ড. সুধীন কুমার চাকমার সন্তান তিনি। তিন বোনের মধ্যে সবার বড় ঊর্মি। খাগড়াছড়ি সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাস করে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করেছেন ঢাকার ইডেন মহিলা কলেজ থেকে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন তিনি। স্বামী অধ্যাপক রকিব চৌধুরী এবং দুই মেয়ে রীহা ও ইয়ারাকে নিয়ে বর্তমানে বাস করছেন অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে।

অগ্রযাত্রার পুরোটাই নিজের দাদি বিরঙ্গনা চাকমাকে উৎসর্গ করতে চান ঊর্মি চাকমা। দাদিকে ‘রত্নগর্ভা’ বলে আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার দাদা রাজাকারদের হাতে নিহত হন। তাঁর মরদেহও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এরপর আমার দাদি শক্ত মনোবল নিয়ে সব সামলে নিয়েছেন। আমার দাদি নিজের নামটা লিখতে পারতেন শুধু। অথচ চার সন্তানকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করিয়েছেন। আমার চাচা অধ্যাপক ড. নীরু কুমার চাকমাও পিএইচডি সম্পন্ন করেছিলেন। অবসরে যাওয়ার আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক হন। এরপর আমার বাবাও পিএইচডি করলেন। এসব কিছুই আমার দাদির অনুপ্রেরণায় সম্ভব হয়েছে।’

শিক্ষিত হওয়ার জন্য বয়স, জাতি কিংবা পরিস্থিতি কোনো বাধা নয়, নিজের মেয়েদের এই বার্তাই দিতে চেয়েছেন ঊর্মি। বললেন, ‘যেকোনো বিষয়ে যদি কারও লক্ষ্য থাকে, আর লক্ষ্যের পেছনে সাহস আর উদ্যম থাকে, তাহলে অবশ্যই তাকে দিয়ে সম্ভব।’