শিশু কি বেশি চঞ্চল

প্রাণচঞ্চল শিশুই পরিবারের প্রাণভোমরা
মডেল: আহিল, ছবি: সুমন ইউসুফ

প্রাণচঞ্চল শিশুই পরিবারের প্রাণভোমরা। হইচই, খেলাধুলা, হুটোপাটি—সব মিলিয়ে হুলুস্থুল। ঘর এলোমেলো, কাগজ ছিঁড়ে কুচি কুচি, ময়লা-ধুলায় মাখামাখি, জানালা দিয়ে টুকিটাকি জিনিস ফেলা—কত কাণ্ডকীর্তি শিশুদের! কড়া গলায় কথা বললেই ঠোঁট ফুলিয়ে কান্না, খানিক পরেই হাসিতে গড়াগড়ি। আবার হয়তো নিজের স্বভাবসুলভ দুষ্টুমিতে মগ্ন। অনেক শিশু একটু বেশি চঞ্চল। অভিভাবকদেরই তার স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহ বজায় রাখার ব্যবস্থা করতে হয়।

এ জন্য শিশুমনকে বুঝতে হবে, বয়সভেদে আচরণ জানতে হবে। তবেই বোঝা যাবে, কোনটা স্বাভাবিক। যেসব মা কিংবা বাবা নিজেদের ছোটবেলায় চঞ্চল ছিলেন, সন্তানও তেমন হতে পারে। এটা মেনে নিয়েই শিশুকে পরিচালনা করুন।

শিশুর জন্য ঠিক-ভুল

ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সাঈদা আনোয়ার বলেন, ‘চঞ্চল শিশুর অভিভাবকদের ধৈর্য হারালে চলবে না। আদর দিয়ে একটু একটু করে শিশুকে ঠিক-ভুল বোঝাতে হবে। কটাক্ষ করবেন না। শারীরিক-মানসিক আঘাতও নয়। তার দুষ্টুমির ফলে আপনি কী ধরনের অসুবিধায় পড়ছেন, বুঝিয়ে বলুন।’

ঢাকার গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের নার্সারির সহযোগী অধ্যাপক মওসুফা হক বলেন, ‘আমরা যেন শিশুকে “চঞ্চল” বা “দুষ্ট” হিসেবে চিহ্নিত করে না ফেলি। আড়াই থেকে পাঁচ-ছয় বছর বয়সী শিশুর বৈশিষ্ট্যই চঞ্চলতা। ওরা চুপটি করে বসে থাকবে একান্ত বাধ্যমতো, এমন আশা করা ভুল। এই সময় শিশু নানা কিছু শেখে (ছোড়া, হাঁটা, লাথি মারা)। অর্জিত দক্ষতাকে বারবার প্রয়োগ করে বাহবা পেতে চায়। এই স্বাভাবিকতাকে স্বাধীনতা দিন, নইলে দুষ্টুমি বাড়বেই।’

লাগামহীন স্বাধীনতাও শিশুর বিকাশের অন্তরায়। শুরু থেকেই শিশুর প্রতি ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ হলে শিশু বাড়বে স্বাভাবিকভাবে। সবকিছুতেই বাধা নয়, আবার সবটাই মানবেন, তা–ও নয়। সবকিছুতেই বাধা দিলে ভালো–মন্দ না বুঝে মন্দটাই করতে পারে, মিথ্যা বলা শিখতে পারে; শাসনেও নিয়ন্ত্রণে আনা যায় না। সবাই মিলে শাসন করবেন না, একজনই দায়িত্ব নিন।

শিশুবান্ধব পরিবেশ

শিশুবান্ধব পরিবেশে সে অযথা জেদ করবে না। তার দক্ষতা প্রয়োগের উপায় করে দিন। ইচ্ছেমতো লাথি মারতে বারান্দার কোণে বল রাখতে পারেন, যেখানে কিছু ভাঙবে না। শিশুর দরজা খোলা, ফোন ধরার–করার মতো ছোট্ট আগ্রহে জল ঢালবেন না। যৌথ পরিবারের না হলেও প্রযুক্তির সহায়তায় সবার সঙ্গে সময় কাটাতে দিন। ‘আর পারি না। এত চঞ্চল কেন?’ এমনটা ভাবলে সঠিকভাবে শিশু পালন হয় না। কারও তুলনাও দেবেন না। শিশুর সামনে কারও সঙ্গেই সহিংস আচরণও নয়।

রুটিন মানবে?

খেলার সময় খেলা আর খাওয়ার সময় খাওয়ার রুটিন বজায় রাখতে হবে বলে জানালেন অধ্যাপক সাঈদা আনোয়ার। খেলার সময় খাওয়ানো নয়। ছোট থেকেই সবার সঙ্গে খাওয়ার আনন্দটা বোঝান। প্রতিদিনের রুটিন করুন, যার কিছু কাজ ধীরস্থির। ধীরে ধীরে অভ্যস্ত করুন।

ঘরবাড়ি এলোমেলো

ছোট্ট শিশু আছে যে বাড়িতে, সে বাড়ি পরিপাটি রাখা সম্ভব নয়। অগোছালো থাকলে অতিথি কী ভাববেন, এমন ভাবনা অমূলক। অতিথিকেও মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকতে হবে। শখের জিনিস নষ্ট হবে বলে শিশুর পরিসর কমাবেন না, এতে দুষ্টুমি বাড়তে পারে। শৌখিন সামগ্রী কিছুদিন তুলে রাখলেও ক্ষতি নেই। রান্নাঘর-বাথরুমে দুর্ঘটনার ভয়, যেতে ‘না’ করবেন না, সঙ্গে যান।

খেলায়-কাজে

শিশুর নিজের কাজে, ঘরের কাজে তাকে সঙ্গে নিন। তবে চাপিয়ে দেবেন না। খেলা নিয়ে থাকার সময় কাজের কথা নয় বারবার। আগে থেকে কাজে আপনার সঙ্গে থাকার বিষয়ে শিশুর সঙ্গেই আলাপ করুন। বয়সভেদে কাজ দিন। দুই বছর বয়সেই শিশু কাজে আগ্রহ দেখায়। তখন উৎসাহ দেওয়া উচিত বলেই জানালেন মওসুফা হক। সে যতটুকুই পারুক, ধন্যবাদ দিন। সাহায্যের জন্য আপনি রয়েছেনই। কাজ না করলে হুট করে কখনোই শিখবে না। ছেলে–মেয়ের কাজ, খেলনা, খেলাধুলায় পার্থক্য নয়। বয়সের উপযোগী সৃজনশীল খেলায় যোগ দিন তার সঙ্গে। সহিংসতামূলক খেলনা নয়।

করোনাকালে নেই স্কুল বা বাইরের খেলাধুলা। অস্থিরতা বাড়তে পারে। অস্থিরতাপূর্ণ ডিজিটাল খেলায় আরও অস্থিরতা বাড়ে। ডিজিটাল মাধ্যমে শেখা হতে পারে, তবে এগুলো যেন শিশুর অভ্যাসে পরিণত না হয়। গল্প-ছড়া শোনান। শিশু গল্প পড়ে আপনাকে শোনাতে পারে। আঁকতে উৎসাহ দিন। ভালো কাজের ‘লক্ষ্যপূরণে’ উপহার দিন, ‘উপহার’ হতে পারে পছন্দের কাজের সুযোগটাও।

বিকাশে সহযোগিতা

দশটা দুষ্টুমির যেটি নিতান্তই খারাপ, সেটি নিষেধ করুন। যেমন কাউকে থুতু ছিটানো। দুই বছর বয়সেই শিশু জেদ করে, ভবিষ্যতে ‘ব্যক্তিত্বসম্পন্ন’ দেখতে চাইলে তার জেদও খানিক মানুন। শিশু মেধার পুরোপুরি প্রয়োগ করতে না পারলে দুষ্টুমি করতে পারে, আবার নিজের কাজ পেরে না ওঠার ফলেও দুষ্টুমি করতে পারে। সন্তানকে মা-বাবাই বুঝবেন, সহযোগিতা করবেন। নিজেদের এমন বোধ আবশ্যক বলেই জানা গেল মওসুফা হকের কাছে।

অন্যের সন্তান পালনের পদ্ধতি আপনার জন্য সঠিক না-ও হতে পারে। প্রতিটি শিশুই আলাদা। শিশু যেমনই হোক, মন থেকে গ্রহণ করুন। ভালোবাসা, ধৈর্য, মনোযোগ আর সময় দিন। অতিরিক্ত চঞ্চল বা জেদি হলে কিংবা বয়সের সঙ্গে স্থিতি না এলে কারণ খুঁজুন, পরিবেশের সমস্যাটা খুঁজুন। সে অনুযায়ী সমাধান। পরিবারের অন্যদেরও বোঝাতে হবে। শুরু থেকেই শিশুমনের প্রতি খেয়াল না রাখলে ৬ বছর বয়সের পর তাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রচুর ধৈর্যের প্রয়োজন। শিশুর চঞ্চলতায় মাকে নেতিবাচক কথা বলে চাপে ফেলা যাবে না। শিশু মানসিক কোনো সমস্যায় ভুগলে চিকিৎসা করান।