শিশুকে ভয় দেখাবেন না

শিশুকে কোনো সময় ভয় দেখিয়ে খাওয়ানো বা অন্য কিছু করতে বলা যাবে না। এতে শিশুর মনোজগতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে
ছবি: অধুনা

শিশুকে নানা কারণেই ভয় দেখানো হয়ে থাকে। শিশু হয়তো সময়মতো খেতে চাইছে না, এদিকে তার জন্য আটকে আছে অভিভাবকের অন্যান্য কাজ। তাড়াহুড়া করতে গিয়েই বলা—‘না খেলে কিন্তু মামদো ভূত চলে আসবে।’ এমন বাক্যে শিশু হয়তো নিমরাজি হয়ে আপনার ‘কার্যোদ্ধার’ করে দেবে, কিন্তু এ রকম ‘সামান্য’ কথাতেই শিশুর কোমল মনে দাগ পড়তে পারে প্রবলভাবে।

জন্ম থেকেই ভয় থাকে না, বরং ভয় সৃষ্টি করা হয়। ভয়ের আবহ সৃষ্টি করা হয় জেনে কিংবা না জেনে পরিবারে বা প্রতিষ্ঠানে। সহপাঠীদের কাছে ভূত বা অন্ধকারের গল্প শিশুমনে ভয় জাগাতে পারে। ভীতিতে সৃষ্টি হয় নেতিবাচকতা, যার ছাপ পড়ে শিশুর ব্যক্তিত্বে। ভয়ভীতির কারণে ভীরু ও হীনম্মন্য হয়ে গড়ে ওঠে শিশু। শিশুকে ভয়ভীতি দেখানো প্রসঙ্গে নানা তথ্য দিলেন ঢাকার গভর্নমেন্ট কলেজ অব অ্যাপ্লাইড হিউম্যান সায়েন্সের (গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ) শিশুবিকাশ ও সামাজিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফাতেমা ফেরদৌস।

ভয় দেখালে

অহেতুক আতঙ্কে ভোগার প্রবণতা দেখা যায়। আত্মবিশ্বাস গঠনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ভীতু শিশু সবার সামনে নিজেকে প্রকাশ করতেও ভয় পায়, আচরণে আসে অস্বাভাবিকতা। অবিশ্বাস বাসা বাঁধতে পারে শিশুমনে। কোমল মন অশান্তিতে ভোগে, অল্পতেই কাঁদে। ভয়ভীতি দেখিয়ে চৌকস শিশু গড়ে তোলা যায় না। আবার ভীতি নিয়ে কেউ কটাক্ষ করলে শিশু মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। নিজের মনের ভয়ের কারণে অন্যের সঙ্গে মিশতে সংকোচ করতে পারে সে।

রাগের ভয়

অভিভাবক বা শিক্ষকদের রাগের বহিঃপ্রকাশ যদি ঘটে শিশুর ওপর, কী ঘটে তখন? ভীরু, দুর্বলচিত্ত মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠে সে। রাগী ব্যক্তিকে এড়িয়ে চলতে পারে। যে কাজের জন্য অভিভাবক বা শিক্ষক রাগ করছেন, তা তাঁদের থেকে লুকিয়ে করার প্রবণতা হতে পারে, লুকাতে গিয়ে মিথ্যা বলার চর্চা হতে পারে। রাগারাগির বিষম পরিবেশে বড় হলে সে পরবর্তীকালে অন্যের প্রতি অসঙ্গত ও রাগান্বিত আচরণ করে। তাই শিশুকে তো নয়ই, শিশুর সামনে অন্যকেও রাগ দেখানো উচিত নয়।

ভয়ের বীজ বোনা

‘অন্ধকারে ভয় আছে’, ‘কুকুরের কাছে যেয়ো না, কুকুর কামড়ে দেবে’, ‘তেলাপোকা কামড় দেবে’—এমন সব কথাও বলা হয়, যা শিশুমনে সৃষ্টি করে অযাচিত ভয়। ফলে শিশু ভয় পেতে পারে অন্ধকারে, এমনকি পাশের ঘরে যেতেও। কোনো প্রাণী ও পতঙ্গ দেখলেই অকারণে ভয় পেতে পারে। আবার অভিভাবকেরা এগুলো থেকে ভয় পেলে শিশুও ভয় পেতে পারে। রোমহর্ষক গল্প শুনলে বা পড়লে তা যেন বাস্তব ভেবে না ফেলে শিশু।

ভয় নয় আর

ভয় না দেখিয়ে বরং শিশুকে তার মতো করে বুঝিয়ে দিন ঠিক আর ভুল। শিশুর পছন্দের কাজটি যদি তার জন্য ক্ষতিকর হয়, তাহলে ক্ষতির দিকগুলো বোঝান। যেমন ধারালো জিনিস নিয়ে খেলা, ছাদের প্রান্তে হুটোপুটি করার মতো কাজে যেসব বিপদ রয়েছে, তা ব্যাখ্যা করা জরুরি। তেমনিভাবেই তার অপছন্দের কাজে মঙ্গল নিহিত থাকলে সেটাও বোঝান। একবার বললেই শিশু সব বুঝবে না। বোঝার জন্য পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে, ধৈর্য ধরতে হবে। ভালোবেসে, আদর করে বোঝাতে হবে। শিশুপালন পদ্ধতি হোক ‘গণতান্ত্রিক’। শিশুরও মতপ্রকাশের অধিকার ও স্বাধীনতা থাকুক। তার কিছু মতামত মেনেও নিন। আবেগের অবদমন শিশুর বিকাশের অন্তরায়।

ভীতি সৃষ্টি হলে

শিশুর মধ্যে ভীতি সৃষ্টি হলে, তা কাটিয়ে উঠতে স্নেহপূর্ণ পরিবেশ দিন। তার ভয় নিয়ে লজ্জা দেবেন না। অনেকটা সময় দিতে হবে ভয় কাটাতে। উদাহরণস্বরূপ, অন্ধকারে শিশু ভয় পেলে অন্ধকারে প্রতিদিন খানিকক্ষণ কাটাতে পারেন তার সঙ্গে। আস্তে আস্তে ভয় কমবে। ভূত নেই, এই বিশ্বাসও তৈরি করে দিন তার মধ্যে। পরিচিত কেউ মারা গেলে শিশু ভয় পেতে পারে। মৃত মানুষ থেকে ভয় নেই, বরং তাদের শান্তির জন্য প্রার্থনা করতে হয়—এই বিষয়গুলো শিশুর মনে বুনে দিন। বড়রা প্রাণীকে খাবার দিলে, আদর করলে শিশুও সেটা করার সাহস পাবে। কীভাবে প্রাণীর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব, তা শিশুকে শিখিয়ে দিন। এতে শিশুর ক্ষতি তো হবেই না, বরং দয়ামায়া ও ভালোবাসার সুকোমল অনুভূতির মিশেলে মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ হয়ে গড়ে উঠবে সে।