বসে আছি পুকুরঘাটে। শহরের ব্যস্ত মানুষেরা এখানে এসে বসে, গল্প জমায়; মন চাইলে বাদাম, আমড়া, শসা কিনে খায়। কয়েকজনকে দেখা যায় ফ্লাক্সে করে চা বিক্রি করতে। এক কথায় এখানে সব ধরনের সুব্যবস্থা রয়েছে।
একজন কঙ্কালসার বৃদ্ধ মানুষকে সামনের কংক্রিটের বেঞ্চে পা তুলে বসে থাকতে দেখলাম। তিনি কিছুক্ষণ পরপর পা নামিয়ে এদিক-ওদিন তাকাচ্ছেন। তারপর আবার বেঞ্চে পা তুলে আরাম করে বসছেন। পাঁচ হাত মতো দূরে আরেক বেঞ্চে এক নারী বসে আছেন, সঙ্গে তাঁর ছোট্ট মেয়ে। মেয়েটার হাতে শপিং ব্যাগ। সে কিছুক্ষণ পরপর মায়ের হাত ধরে টানছে—‘চলো আম্মু, বাসায় চলো।’ বাচ্চার কথায় কান দিচ্ছেন না সেই নারী, তিনি এক দৃষ্টিতে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে আছেন!
সন্ধ্যায় আমার একটা মিটিং আছে পাশের সেটেলমেন্ট অফিসের সামনে, ঘাসের ওপর। অনেক আগে উপস্থিত হওয়ায় বসে থাকতে হচ্ছে। মিটিং হবে ‘আহ্বান’-এর পক্ষ থেকে পথশিশুদের বস্ত্র বিতরণ–সংক্রান্ত। হঠাৎ কঙ্কালসার দেহের বৃদ্ধ বেঞ্চ থেকে পড়ে গেলেন! হুমড়ি খেয়ে আমরা এগিয়ে গেলাম, আমাদের যাওয়ার আগে সেই পাশের বেঞ্চে বসা নারী ছুটে গেলেন! বৃদ্ধের সমস্ত শরীর কাঁপছে, দাঁতে দাঁত এঁটে গেছে। ভদ্রমহিলা ওনার ব্যাগ থেকে পানির পট বের করে বৃদ্ধের চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে দিলেন। কিছুক্ষণ পর বৃদ্ধের জ্ঞান ফিরল। ভদ্রমহিলা কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বললেন, ‘কী হয়েছে আপনার?’
‘সকাল থেকে কিছু খাইনি!’ কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে লোকটি বললেন। মহিলা দ্রুত ব্যাগ থেকে পাউরুটি-কলা বের করে মুখের সামনে ধরলেন। খাবার দেখে বৃদ্ধের চোখ লকলক করে উঠল! হাত থেকে একপ্রকার কেড়ে নিয়ে মুখে পুরলেন! আমরা নীরব দর্শক! ভদ্রমহিলা এক হাতে শক্ত কাগজ দিয়ে বাতাস করছেন, পাশে মায়ের শাড়ির আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে ছোট্ট মেয়েটি! ভদ্রমহিলার চোখে এবার জল—‘আপনার বাড়ি কোথায় আব্বা?’ বৃদ্ধ খেয়েই যাচ্ছেন, উত্তর দেওয়ার তাঁর সময় নাই। পাশ থেকে কেউ একজন বললেন, ‘পাগল মানুষ, এখানেই থাকে, খায় না-খায়!’ ভদ্রমহিলা এবার গলা ছেড়ে কেঁদে উঠলেন—
—‘আমার আব্বা নাই! আপনিই আজ থেকে আমার আব্বা! চলেন আমার বাড়ি চলেন!’
বৃদ্ধের খাওয়া থেমে গেছে। চোখে জল টলমল করছে তাঁর...
গাজী তৌহিদ
কলারোয়া, সাতক্ষীরা