সংক্রমিত হয়েছেন, তাতে কী? থাকুন ইতিবাচক

আইসোলেশনে থাকার সময়টা কাটাতে পারেন পছন্দের বই পড়ে। মডেল: স্নিগ্ধা
ছবি: কবির হোসেন

একটা ঘরে একলা থাকা। রাগ নয়, অভিমান নয়, কেবল নিজের শরীর থেকে অন্যদের মাঝে জীবাণু ছড়িয়ে যাওয়া রোধ করতেই এই একলা থাকা (আইসোলেশন)। সামাজিক জীব হিসেবে বেড়ে ওঠা মানুষের পক্ষে এমন একা থাকা কঠিন। তবে একজন ইতিবাচক মানুষ যেকোনো পরিস্থিতিকেই ইতিবাচক করে নেন। করোনা সংক্রমণ হঠাৎ করেই বেড়েছে। সংক্রমণের প্রথম আর দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কা কাটিয়ে নতুন সময়ে এসে আইসোলেশনে যদি প্রবেশ করতেই হয়, তবে জীবনকে অন্ধকার ভেবে নেবেন না।

আমি যখন প্রথমবার করোনায় সংক্রমিত হয়ে আইসোলেশনে ছিলাম, তখন চাঁদ দেখেছি দুচোখ ভরে। দেখেছি দিনের আকাশের রং আর আকাশের বুকে ঘুড়ি। দেখেছি বৃষ্টি, হাত বাড়িয়ে ছুঁয়েছি বৃষ্টির জল। বাংলা সাহিত্য পড়েছি অল্পস্বল্প। তবে দ্বিতীয়বার করোনায় সংক্রমিত হওয়ার পাঁচ দিন পর থেকেই বেশ সুস্থ বোধ করায় সেবার প্রচুর বই পড়েছি। তাই ‘মৃদু’ উপসর্গ নিয়ে যাঁরা বাসায় থেকেই চিকিৎসা চালাতে পারছেন, তাঁরা ভেঙে পড়বেন না। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলুন আর এই একা থাকার সময়টাকে করে তুলুন ফলপ্রসূ।

ইতিবাচক হওয়ার আরও আরও সত্যি ‘গল্প’ শোনা যাক এবার।

আঁকিয়ের গল্প

গ্রাফিক ডিজাইনার তানিয়া আফরোজের সঙ্গে যখন কথা হলো, তিনি সেই মুহূর্তে করোনায় সংক্রমিত হয়ে আইসোলেশনে। কাজ করেন একটি বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানে। এই সময়ে অফিসের কাজ তো আর নেই। তবে জানা গেল, তাঁর আঁকিয়ে সত্তা জেগেছে। জলরঙে আঁকছেন শীতের ফুল। বাংলা ফন্ট ডিজাইনিংয়ের জাতীয় পর্যায়ের একটি প্রতিযোগিতার জন্যও কাজ করছেন আইসোলেশনে থেকে। এরই মধ্যে পড়ছেন জোছনা ও জননীর গল্প। সিনেমাও দেখছেন নানা ধরনের।

রান্না যখন মনোবল বাড়ায়

অনলাইনভিত্তিক উদ্যোগ রুশা’স কিচেনের স্বত্বাধিকারী শাহ্‌রিয়া শুচি করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন তিনবার। আইসোলেশনে থাকার সময় খাবার ডেলিভারির কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তবে সেই সময়গুলোতে অনলাইনে রান্নার কিছু প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। বাসায় চেষ্টা করেছেন ভিন্ন কিছু রান্না করার। মনের জোর ধরে রেখেছেন সব সময়। তিনবারই তাঁর সঙ্গে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন তাঁর একমাত্র সন্তানও। শিশুটির আবার ভিএসডি, অর্থাৎ হৃৎপিণ্ডের দুটি প্রকোষ্ঠের মাঝের পর্দায় ছিদ্র রয়েছে। কঠিন এই সময়গুলোতে নিজের এবং সন্তানের খেয়াল রাখার পাশাপাশি নিজের দক্ষতাও কিন্তু বাড়িয়ে নিয়েছেন তিনি।

রান্না করেও মনোবল ঠিক রাখা যায়। মডেল: অভিনেত্রী টয়া
ছবি: প্রথম আলো

আইসোলেশনে থেকে ভিন্ন রকম রান্নাবান্না করেছেন, এমন আরও একজনের সঙ্গে কথা হলো। স্থপতি রুবাইয়াৎ সালতানা। তিনি যখন দ্বিতীয় দফায় করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন, তখন ছিল রমজান মাস। পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক প্রত্যেকেই সেবার করোনায় সংক্রমিত। শিশুদের জন্য ইফতারিতে বৈচিত্র্য আনতে চেষ্টা করতেন এই মা। নিজেও বুদ্ধি খাটাতেন, ইউটিউব থেকেও কিছু শিখেছেন। আর প্রথমবার করোনা সংক্রমণের পর মানসিক দিক থেকে নেতিবাচকতা অনুভব করছিলেন নিজের ভেতর (কোভিড-পরবর্তী জটিলতা)। তখন বেকিং শিখেছিলেন মনকে ব্যস্ত রাখতে। দ্বিতীয়বার সংক্রমণের সময় বাসায় বেকিং তো করেছেনই, এমনকি পেশাগতভাবে বেকিং করার ইচ্ছা জেগেছে। ইতিমধ্যেই স্বজনেরা কেক নিচ্ছেন তাঁর কাছ থেকে।

দক্ষতা বাড়ানোর আরও গল্প

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জৈবরসায়নে এমফিল করেছিলেন সাদিয়া হক। কাছের মানুষেরা তাঁকে ডাকেন ‘মুনিয়া’ নামে। ধানমন্ডির মেপল লিফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে শিক্ষকতাও করেছিলেন সাড়ে তিন বছর। সন্তান পালনের জন্য ক্যারিয়ারে খানিকটা বিরতি নিয়েছিলেন। এরপর ফ্রিল্যান্সিং দক্ষতার জন্য বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের (মিনিস্ট্রি অব আইসিটি) অধীনে লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের (এলইডিপি) একটি অনলাইন কোর্স করছিলেন ২০২০ সালে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রাফিক ডিজাইনের এই কোর্স চলার সময়ই তিনি করোনায় সংক্রমিত হন। শুরু হয় আইসোলেশনের বন্দিজীবন। সাদিয়া বলেন, ‘নিজেকে কেমন যেন “অস্পৃশ্য” মনে হতো তখন। আমার সন্তানের বয়স তখন তিন বছর। ওর থেকে দূরে থাকাটা ভীষণ কষ্টের ছিল। রাতে ঘুম হতো না। সকালে হাত ব্যথায় অবশ হয়ে থাকত।’

প্রিয়জনদের সঙ্গে কথা বলুন ভিডিও কলে। মডেল: স্নিগ্ধা
ছবি: কবির হোসেন

হাতটাকে সচল রাখতে, মনটাকে ব্যস্ত রাখতে ওই ঘরের মধ্যেই কোনো না কোনো কাজ করতেন। ঘর পরিষ্কার করতেন ঝেড়েমুছে। অন্য ঘরে থাকা সন্তানের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলতেন। অনলাইন কোর্সটির প্রশিক্ষক বেশ সহযোগিতা করেছেন কোর্স চলাকালে। করোনা সংক্রমণ ও পরবর্তী জটিলতা মিলিয়ে মাসখানেক নিজের ঘর থেকেই কোর্সের কার্যক্রম চালিয়ে গিয়েছেন তিনি। সপ্তাহের পাঁচ দিন দুই ঘণ্টা করে সময় দিতে হয়েছে সেখানে। কোনো দিন শারীরিক অসুবিধার কারণে কোনো অংশ বাদ পড়ে গেলে পরবর্তী সময়ে ধারণকৃত অংশ দেখে নিতেন। এভাবেই সময়ের মধ্যেই কোর্সটি সম্পন্ন করেছেন তিনি।

কাজের চলমানতা

প্রতিবেদনটি লেখার সময়ই করোনায় আক্রান্ত এক চিকিৎসকের সঙ্গে কথা হলো। পপুলার মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের রেজিস্ট্রার নওসাবাহ নূর এই সময়টায় কর্মস্থলে না গেলেও কাজ কিন্তু তাঁর থেমে থাকেনি। কর্মস্থলের একাডেমিক কাজে উপস্থাপনের জন্য করোনার নতুন ধরন অমিক্রন নিয়ে একটি প্রেজেন্টেশন তৈরি করেছেন। সেটির জন্য প্রচুর পড়ালেখাও করতে হয়েছে, আইসোলেশন থেকেই সেটি শেষ করে উপস্থাপন করেছেন অনলাইনে। পোস্টগ্র্যাজুয়েশন পরীক্ষার্থীদের জন্য অনলাইন ক্লাস নিয়েছেন। পান্থপথের চেম্বারে সশরীর না গেলেও খোলা রেখেছেন অনলাইন অ্যাপয়েন্টমেন্ট। এসব কাজের বাইরেও বাড়ি থেকে চিকিৎসাসংক্রান্ত লেখার কাজ করেছেন। ডকুমেন্টারি দেখেছেন, নেটফ্লিক্সের ধারাবাহিক দেখেছেন। ‘লিমিটলেস’ নামের আত্মোন্নয়নমূলক একটি অডিও বুকও শুনে শেষ করেছেন। সংক্রমণের খবর পেয়ে দূরদূরান্ত থেকে যেসব শুভাকাঙ্ক্ষী তাঁর খোঁজ নিচ্ছেন, তাঁদের সঙ্গে কথাও বলেছেন। মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা শিক্ষক হিসেবে তাঁকে কতটা ভালোবাসেন, সেটিও যেন নতুনভাবে উপলব্ধি করেছেন এই সময়ে।

ওটিটিতে দেখতে পারেন সিনেমা
ছবি: রয়টার্স

কাজে লাগান আপন সত্তাকে

অনেকেরই গল্প জানা হলো। তবে প্রত্যেকের জীবনই স্বতন্ত্র। করোনা সংক্রমণ যদি হয়েই যায়, আইসোলেশনের দিনগুলোকে সুন্দর করে তুলতে নিজের যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি আপনার সত্তার সৃষ্টিশীলতাকে বিকশিত করে তুলুন। আঁকাআঁকি কিংবা লেখালেখি যে কেবল পেশাদার আঁকিয়ে-লেখিয়েরাই করবেন, তা তো নয়। মনের আনন্দে যে কেউই তা করতে পারেন। হয়তো একটা শাড়িই হয়ে উঠল আপনার ক্যানভাস—ফুল আঁকলেন তাতেই, হোক না অপেশাদার হাতের কাজ। কাগজ কিংবা ফেলনা জিনিস দিয়ে ঘর সাজানোর সামগ্রী তৈরি করতে পারেন। প্রয়োজনে সাহায্য নিন ইন্টারনেট থেকে। তবে ইন্টারনেট-নির্ভর হয়ে পড়বেন না যেন। নিজস্বতাকে কাজে লাগান। আইসোলেশনের দিনগুলোতেই না হয় জীবনে আসুক প্রাণের স্পন্দন। জানুন নতুন আমিকে।

লেখক: ক্লিনিক্যাল স্টাফ, নিউরো-আইসিইউ, স্কয়ার হাসপাতাল লিমিটেড, ঢাকা