সঙ্গী থাকলেও নিরাপদ নন নারী

গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, গতকাল (২৩ ফেব্রুয়ারি) রাতে দুই শিক্ষার্থী গোপালগঞ্জ সদরের নবীনবাগ হেলিপ্যাডের সামনে থেকে হেঁটে আসছিলেন। এ সময় তাঁদের দুজনকে একটি অটোরিকশায় তুলে নেয় দুর্বৃত্তরা। পরে ছাত্রটিকে বেঁধে রেখে গোপালগঞ্জ জিলা স্কুলের নির্মাণাধীন একটি ভবনে কয়েকজন মিলে ছাত্রীটিকে ধর্ষণ করে।

পুরুষ সঙ্গী পাশে থাকার পরও অহরহ ঘটছে এমন ঘটনা।

গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। প্রতিবাদে ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন শিক্ষার্থীরা। আজ সকালে গোপালগঞ্জের ঘোনাপাড়া মোড়েছবি: প্রথম আলো

ঘটনা ১: বরগুনার বেতাগী উপজেলার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক সহকারী শিক্ষক স্কুল ছুটির পর অফিসেরই একটি কক্ষে বসে পরীক্ষার উত্তরপত্র দেখছিলেন। দেরি দেখে তাঁর খোঁজ নিতে সেখানে যান স্বামী। স্বামীর সঙ্গে ওই শিক্ষকের কথা বলার সময় এলাকার অন্তত ছয় ব্যক্তি সেখানে যায়। তারা গেটের তালা খুলে দিতে বলে। শিক্ষক খুলতে রাজি না হলে শৌচাগারের পাইপ বেয়ে দোতলায় উঠে আসে। শিক্ষকের স্বামীকে মারধর করে একটি কক্ষে আটকে রাখে তারা। এরপর শিক্ষককে আরেকটি কক্ষে নিয়ে ধর্ষণ করে।

নিয়মিত খবর হচ্ছে এমন ঘটনা
কোলাজ ছবি

ঘটনা ২: বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলায় এক দম্পতির কাছে এক লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন তৎকালীন উপজেলা ছাত্রলীগ সভাপতি সুমন হোসেন মোল্লা। পরে দলবল নিয়ে ওই দম্পতিকে গ্রামের ক্লাবে নিয়ে যান তিনি। সেখানে একটি কক্ষে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে এক আত্মীয়ের বাড়িতে নিয়ে ধর্ষণ করেন সুমন।

ঘটনা ৩: পলাশের একটি পাটকলে চাকরি করেন এক নারী। চট্টগ্রামে একটি লন্ড্রিতে কাজ করেন তাঁর স্বামী। কয়েক দিনের ছুটি নিয়ে স্ত্রীর কাছে বেড়াতে পলাশে আসেন স্বামী। ছুটির দিনে সন্ধ্যায় নরসিংদীর ঘোড়াশাল ফ্ল্যাগ স্টেশন এলাকায় ঘোরাঘুরি করতে বের হন স্বামী-স্ত্রী। ওই সময় তিন বখাটে এসে নানা প্রশ্নবাণে তাঁদের জর্জরিত করে। একপর্যায়ে স্বামীকে মারধর করে স্ত্রীকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় তারা। পাঁচদোনা স্টেশনের কাছে তাঁকে ধর্ষণ করে।

প্রথমটি ২০১৭ সালের জুলাই মাসের ঘটনা, দ্বিতীয়টি একই বছরের আগস্ট মাসের আর শেষেরটি ঘটেছে এই বছরেরই ৫ ফেব্রুয়ারি। অন্তর্বর্তীকালে এ ধরনের ঘটনা নিয়মিতই ঘটে চলেছে।

৫ বছরে আলোচিত ১৫

স্বামীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ধর্ষণের ১৫টি ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রতিটির ধরন এক। দল বেঁধে প্রথমে দম্পতির সঙ্গে তর্কাতর্কি করে বা চাঁদা দাবি করে ‘ঝামেলা’ পাকায় হোতারা। অসহায় স্বামী-স্ত্রীকে সেই ফাঁদে ফেলে পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ধর্ষণের সুযোগ তৈরি করে। ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত ধর্ষণের সংবাদ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, স্বামীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বা স্বামীকে আটকে রেখে ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১৫টি। মা-বাবাকে বেঁধে রেখে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১টি। শিশু ছোট বোনের সামনে বড় বোনকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১টি। সন্তানদের জিম্মি করে মাকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫টি। এর মধ্যে এক মা আবার অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। এ ছাড়া পরিবারের লোক, স্বজন, বন্ধু, প্রতিবেশী, পূর্বপরিচিত, স্বামী ও স্বামীর সহায়তায় স্বামীর বন্ধুদের ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৪৭ জন নারী ও শিশু।

নয়টি পত্রিকায় প্রকাশিত খবর ও নিজস্ব তথ্য যাচাই করে বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানিয়েছে, ২০১৭ সালে ৮১৮, ২০১৮ সালে ৭৩২, ২০১৯ সালে ১ হাজার ৪১৩, ২০২০ সালে ১ হাজার ৬২৭ এবং ২০২১ সালে ১ হাজার ৩২১টি ধর্ষণের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য অনুসারে, ২০২০ সালে শুধু রাজধানীতেই ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যার মামলা হয়েছে ৬৫৪টি। আর ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত মামলা হয়েছে ৬৫২টি।

তিন মামলার খোঁজখবর

উল্লিখিত তিনটি মামলার পরবর্তী অবস্থা জানতে খোঁজ নিয়েছে প্রথম আলো। বরগুনার মামলাটির বিষয়ে জানতে বেতাগী থানায় যোগাযোগ করা হলে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ আলম বলেন, ঘটনার সময় তিনি থানার দায়িত্বে ছিলেন না। ওই ঘটনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(৩) ধারায় দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে ছয়জনকে আসামি করে মামলা হয়। মামলাটি সম্পর্কে আরেকটু জানতে মামলাটির তৎকালীন তদন্তকারী কর্মকর্তা পিরোজপুরের ইন্দুরকানি থানার ওসি হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় ধর্ষণচেষ্টা উল্লেখ করে তিনি অভিযোগপত্র দিয়েছিলেন। ‘শিক্ষকের পরিধেয় বস্ত্রে যে সেমেন (বীর্য) পাওয়া গেছে, তা আসামিদের সঙ্গে মেলেনি।’ তাঁর স্বামীর সঙ্গে মিলেছে কি না, তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঘটনার পরদিনই শিক্ষকের স্বামী ভারতে চলে যান। পরে শুনেছি ভারত থেকে তিনি বিদেশ চলে গেছেন। তাঁরটা মেলানো সম্ভব হয়নি।’ অভিযোগপত্রে কতজনকে আসামি করা হয়েছিল, তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘২০১৭ সালের ঘটনা। এত কিছু মনে নেই।’

বানারীপাড়ার ঘটনায় মামলার পরপর সুমন মোল্লাকে গ্রেপ্তার করা হয়। বানারীপাড়া থানার ওসি হেলাল উদ্দিন বলেন, মামলাটি এখন বরিশালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। আসামি সুমন মোল্লা জামিনে মুক্ত আছেন।

ঘোড়াশালের ঘটনায় ধর্ষণের অভিযোগে দুজনকে আটক করা হয়। ভৈরব রেলওয়ে থানার ওসি ফেরদৌস আহমেদ বিশ্বাস বলেন, এখন পর্যন্ত দুজনই গ্রেপ্তার আছেন। আরেকজনকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। আসামিদের ডিএনএ সংগ্রহের জন্য আদালতে আবেদন করা হয়েছে।

প্রতিকারের উপায় কী

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক মেখলা সরকার বলেন, ‘ঘটনাগুলো থেকে বোঝা যায়, স্বামী সঙ্গে থাকলেই যে মেয়েটি নিরাপদ থাকতে পারবেন, তা নয়। এ ধরনের ক্ষেত্রে বখাটেরা দল বেঁধে স্বামী-স্ত্রীর সঙ্গে ঝামেলা বাধানোর মতো পরিস্থিতি তৈরি করে। না বুঝেই তাদের পাতা ফাঁদে পা দেন ভুক্তভোগীরা। এ ধরনের পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো সতর্কতা ও দক্ষতা অর্জন করতে হবে।’ তাঁর মতে, ধর্ষকদের মধ্যে ব্যক্তিত্বের সমস্যা আছে। অনেকে নেশা করে বলে তাদের বিবেচনাবোধও কমে যায়। নারীর ওপর ক্ষমতা দেখিয়ে তারা নিজেদের গ্যাংয়ে বাহবা নেয়। মানসিক বিষয় এখানে গুরুত্বপূর্ণ। তাই স্কুল থেকে যৌনশিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। যৌনতার মধ্যে যে সৌন্দর্য আছে, সম্পর্কের প্রতি যে দায়িত্বশীল হতে হয়, কিশোর বয়স থেকে সেটা তাদের শেখানো জরুরি।

স্বামী বা পরিবারের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ধর্ষণের ঘটনাকে পরিপূর্ণ, পরিকল্পিত ও সংঘটিত অপরাধ বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান খন্দকার ফারজানা রহমান। তিনি বলেন, ‘কোনো মেয়ে একা হলে, অভিভাবকহীন থাকলেই তাকে ধর্ষণ করা হয় বলে প্রচলিত যে ধারণা ছিল, তা পাল্টে দিচ্ছে এসব ঘটনা। রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়াসহ বিভিন্ন কারণে ওই অপরাধীরা এখন অনেক বেশি সংগঠিত ও শক্তিশালী। কোনো দম্পতির ক্ষেত্রে স্বামীর শারীরিক অবস্থা, অনেক ক্ষেত্রে আর্থিক অবস্থা যাচাই করে তারা ধর্ষণের পরিকল্পনা করে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর করে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রম জোরদারের মাধ্যমে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করে এসব ঘটনা প্রতিকার করতে হবে।

প্রতিকারের উপায় আসলে আমরা সবাই জানি, কিন্তু সেগুলোকে সত্যিকারভাবে কার্যকর করতে উদ্যোগী হবে কে?