সঙ্গীসাথি বাঘ-হাতি

আশরাফুল হকের উদ্যোগেই গড়ে উ​েঠছে টাইগার রেসপন্স টিম। ছবি: সংগৃহীত
আশরাফুল হকের উদ্যোগেই গড়ে উ​েঠছে টাইগার রেসপন্স টিম। ছবি: সংগৃহীত

কালো কেশরের জন্য বিখ্যাত ছিল সে। তাকে দেখতেই ভিড় জমত। পার্কের অন্যতম বড় আকর্ষণ ছিল সে। ৬ জুলাই জিম্বাবুয়েতে স্রেফ শিকারের আনন্দের জন্যই মেরে ফেলা হয়েছে হোয়াং ন্যাশনাল পার্কের সেসিল নামের সেই সিংহটিকে। ওয়াল্টার পামার নামের সেই মার্কিন শিকারি এখন সবার ঘৃণার পাত্র। সিংহ শিকারের জন্য নাকি তিনি খরচ করেছেন ৫০ হাজার ডলার। বিশ্বজুড়ে তীব্র নিন্দার ঝড় বইছে। এভাবে পশুহত্যার শাস্তি কী হওয়া উচিত, সেটা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। (সূত্র: গার্ডিয়ান)
সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা মাত্র ১০৬টি—বন বিভাগের সাম্প্রতিক জরিপের এমন ফলে হতবাক অনেকেই। তবে কি ‘বেঙ্গল টাইগার’ শুধু চিড়িয়াখানাতেই বেঁচে থাকবে? বন্য প্রাণী সংরক্ষণের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে? আশার কথা হলো সুন্দরবনের গ্রামগুলোতে এখন কাজ করছে ‘টাইগার রেসপন্স’ দল। এসব দলে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন গ্রামবাসীই। ওয়াইল্ড টিম নামের প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোগে গঠন করা হয় এই দলগুলো। আর ২০০৯ সালে এসব দল গঠন থেকে শুরু করে গ্রামবাসীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া, প্রয়োজনীয় সব সাহায্যের ব্যবস্থা করা—এই কাজগুলোতে যুক্ত ছিলেন আশরাফুল হক। কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রে আয়োজিত ইন্টারন্যাশনাল ভিজিটর লিডারশিপ প্রোগ্রামে (আইভিএলপি) অংশ নিয়েছেন। সারা বিশ্ব থেকে নানা ক্ষেত্রে উদীয়মান নেতাদের নির্বাচন করে এই আয়োজনে অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানায় মার্কিন সরকার।
‘বাঘ বাঁচালে কী লাভ? কেন আমরা বাঘ না মেরে বরং তাকে বনে ফিরে যেতে সাহায্য করব? লোকালয়ে ঢুকে পড়ে বাঘ মানুষ মারছে, আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। সেই বাঘের জন্য কেন এত দরদ দেখাব?’ কাজের শুরুতে এ ধরনের প্রশ্নগুলোই শুনতে হতো বেশি বলে জানালেন আশরাফুল। আইভিএলপি প্রোগ্রাম থেকে ফেরার পর ঢাকায় প্রথম আলো কার্যালয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। আইভিএলপি-এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন অ্যান্ড বায়োডাইভারসিটি কনজারভেশন ২০১৫ শীর্ষক প্রোগ্রামে বাংলাদেশ থেকে এ বছর নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। এমন কি তিন বছরে একটা বাঘও মারা যায়নি।
প্রশ্নগুলোর জবাব দেওয়া কঠিনই। মনে রাখুন, প্রশ্নকর্তারা শহুরে শিক্ষিত মানুষ নন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের তাত্ত্বিক দিক কিংবা বাঘের সংখ্যা কমে যাওয়ার ক্ষতিকর প্রভাবগুলো তাঁরা জানেন না। যদিও তাঁরাই এসবের ভুক্তভোগী। এই মানুষগুলোকে কোনো রকম আর্থিক লাভের আশা ছাড়াই বাঘ বাঁচানো দলে অন্তর্ভুক্ত করা মোটেও সহজ ছিল না। সেই কাজটাতেই সাফল্য দেখিয়েছেন আশরাফুল। ‘একটা এলাকায় গিয়ে প্রথমেই তো এমন কাজ শুরু করা যায় না। সেখানকার মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে হয়। শুরুতেই কেন তাঁরা আমার কথা শুনবেন? তা-ও আবার স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করবেন, তাঁরা নিজেরাও তো আর্থিকভাবে তেমন স্বাবলম্বী নন।’ বললেন আশরাফুল।

বাঘের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করে কীভাবে ফিরিয়ে দেওয়া যায় বনে, সে প্রশিক্ষণই চলছে গ্রামবাসীর
বাঘের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করে কীভাবে ফিরিয়ে দেওয়া যায় বনে, সে প্রশিক্ষণই চলছে গ্রামবাসীর

২০০৯ সালে সুন্দরবন টাইগার প্রজেক্টে যোগ দেন তিনি। ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশ নামের একটি প্রতিষ্ঠান এ প্রকল্প পরিচালনা করত। এখন যার নাম ওয়াইল্ড টিম। সে সময়ে সুন্দরবন এলাকার ২৯টি গ্রামে তাদের প্রকল্প শুরু হয়। এই প্রকল্পে বন বিভাগ তাদের সহায়তা দেয়। ‘বাঘ-মানুষ সংঘাতের খবর সে সময়ে বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি শোনা যেত। বাঘ এলাকায় ঢুকে পড়লেই হাজার মানুষ তাকে ঘিরে ফেলে। পাঁচ-ছয় হাজার মানুষ বাঘকে ঘিরে ফেললে তার পক্ষে আর জঙ্গলে ফিরে যাওয়ার কোনো উপায় থাকে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পিটিয়ে বা গুলি করে বাঘ মেরে ফেলা হয়। একবার তো স্থানীয় সংসদ সদস্য এসে অনুরোধ করেও বাঘ বাঁচাতে পারেননি।’ জানালেন আশরাফুল। তবে সেটা একসময় কমে আসে, যার পেছনে ছিল টাইগার রেসপন্স টিমের পরিশ্রম। এলাকার কিছু মানুষকে অনুপ্রাণিত করে এই দলে নেওয়ার পর আরও অনেকেই আগ্রহী হন যোগ দিতে। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাস থেকে শুরু হয় গ্রামবাসীর প্রশিক্ষণ। ‘বাঘ লোকালয়ে ঢুকে পড়লে কী করতে হবে, কীভাবে তাকে আবার জঙ্গলে ফেরত পাঠাতে হবে—এসব বিষয়ে তাঁদের শেখাই আমরা। জুন-জুলাইয়ের দিকে বৃষ্টির সময়ে লোকালয়ে বাঘ আসার ঘটনা বেশি ঘটত। প্রায়ই শুনতাম অমুক এলাকায় বাঘ এসে পড়েছে, গ্রামবাসী তাড়া দিয়ে জঙ্গলে ফিরিয়ে দিয়েছেন। এ ঘটনাগুলো স্থানীয় পত্রিকার খবর হতো। সেটা দেখে টাইগার টিমের মানুষ বেশ অনুপ্রাণিত হতো। একসময় দেখা গেল, গ্রামের মানুষ রীতিমতো অনুরোধ করা শুরু করল টাইগার টিমে যোগ দেওয়ার জন্য।’ বললেন তিনি। সেই দলগুলো এখনো কাজ করছে এসব অঞ্চলে।
এরপর ২০১২ সালে খুলনার আংটিহারা এলাকায় বাঘ ঢুকে পড়ার পর তাকে সফলভাবে অজ্ঞান করতে সক্ষম হন টাইগার রেসপন্স টিমের সদস্যরা। ‘এটা আমাদের বড় একটা সাফল্য বলে আমি মনে করি। একটা বাঘকে দূর থেকে দেখেই তার কতটুকু চেতনানাশক ওষুধ লাগবে, তা আন্দাজ করা হয়। বেশি হলে বাঘটি মরে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। কম হলেও অন্য বিপদ। কাছে গেলেই বাঘটি জেগে উঠে আক্রমণ করতে পারে। এভাবে বাঘটি অজ্ঞান করে তাকে সুস্থ অবস্থায় জঙ্গলে ফেরত পাঠানোটা বড় একটা চ্যালেঞ্জ ছিল আমাদের জন্য। তবে তিন ঘণ্টার মধ্যেই আমরা বাঘটি ফেরত পাঠাই জঙ্গলে।’ বললেন তিনি। এরপর এখন তো কয়েক শ ‘আশরাফুল’ তৈরি হয়েছে গ্রামগুলোতে। তিন বছরে গ্রােম চলে আসা একটা বাঘও মারা যায়নি। প্রশিক্ষিত গ্রামবাসী বাঘদের আবার ফিরিয়ে দিয়েছে বনে।
আশরাফুলের চাকরিজীবনের শুরু প্রশিকায়, ২০০৭ সালে। সামাজিক বনায়ন প্রকল্পে কাজ করতেন। ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া, গাজীপুর, টাঙ্গাইল—এসব এলাকায় প্রকল্পের ব্যবস্থাপনায় গাছ লাগানো হতো। পরিকল্পনাটা হলো, এসব গাছের দেখভাল গ্রামবাসীই করবে। গাছ বড় হলে সে তা কেটে অর্থ উপার্জনও করতে পারবে। সেখানে মানুষকে এ কাজে উদ্বুদ্ধ করাটা অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল। কারণ, আর্থিক লাভের একটা ব্যাপার ছিল।’ বললেন তিনি।
আইভিএলপি প্রোগ্রাম সম্পর্কে জানা ছিল না আশরাফুল হকের। ‘২০১৪ সালে পরিচয় হলো সারা ফ্লিউলিনের সঙ্গে। বাংলাদেশের মার্কিন দূতাবাসে কাজ করতেন। তিনি আমার কাজ নিয়ে বেশ আগ্রহ দেখান। তারপর এ বছরের জানুয়ারি মাসে ই-মেইল পাই তাঁর। আইভিএলপি প্রোগ্রামে আমাকে নির্বাচিত করা হয়েছে বলে জানতে পারি।’ বললেন আশরাফ। ‘১৭টি দেশের অংশগ্রহণ ছিল এবার। সেখানে আমরা নিজ নিজ দেশের সমস্যা, অভিজ্ঞতার কথা বিনিময় করেছি। নতুন অনেক কিছুই শিখেছি।’

যুক্তরাষ্ট্রে​র ইন্টারন্যাশনাল ভিজিটর লিডারশিপ প্রোগ্রামে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আশরাফুল হক
যুক্তরাষ্ট্রে​র ইন্টারন্যাশনাল ভিজিটর লিডারশিপ প্রোগ্রামে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আশরাফুল হক

এর আগে ২০১১ সালে জুওলজিক্যাল সোসাইটি অব লন্ডন আয়োজিত গ্লোবাল কনজারভেশন মিটিংয়ে বাংলাদেশ থেকে অংশ নেন তিনি। ২০১৩ সালে যোগ দেন আইইউসিএন (ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার) বাংলাদেশে ওয়াইল্ডলাইফ বায়োলজিস্ট হিসেবে। এখন সেখানেই কর্মরত আছেন। এবার বাঘের বদলে তাঁর কাজের বিষয় হাতি। কক্সবাজার, রাঙামাটি, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, ময়মনসিংহ, শেরপুর এলাকায় কাজ চলছে। হাতি লোকালয়ে ঢুকে পড়লে কী করতে হবে, কীভাবে সংঘাত ও ক্ষয়ক্ষতি কমানো যাবে—এসব নিয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন এলাকাবাসীকে। কথা হলো আইইউসিএন বাংলাদেশের কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ ইশতিয়াক উদ্দিন আহমাদের সঙ্গে। ‘আশরাফ মাঠপর্যায়ে খুব ভালো কাজ করে। তার নেতৃত্ব দেওয়ার গুণও দারুণ।’ বললেন তিনি।
বাঘ-হাতি আর জঙ্গলের পর একসময় শহরেও কাজ করার পরিকল্পনা আশরাফুল হকের। ‘ঢাকার মানুষদের নিয়ে পরিবেশবান্ধব একটা নগর গড়ে তোলার জন্য কাজ করতে চাই।’ সবার পরিশ্রম, অংশগ্রহণ আর স্বেচ্ছাসেবার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠবে পরিবেশবান্ধব, সুন্দর এক নগর। এটাই আশরাফের বিশ্বাস।