সঞ্চয় বনাম ব্যয়—এ কোন জটিলতায় বিশ্ব

  • বর্তমান প্রেক্ষাপটে সঞ্চয় থাকা যে কত জরুরি, তা খুব টের পাচ্ছে মানুষ। তবে সবকিছুরই ‘নেগেটিভ-পজিটিভ’ দুটি প্রভাব থাকে।

  • অর্থশাস্ত্রে ‘প্যারাডক্স অব থ্রিফট’ বলে একটি বিষয় আছে। অর্থনীতিবিদ জন মেইনার্ড কেইনস ১৯৩০ সালে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন মিতব্যয়ী হওয়ার এক কঠিন জটিলতা।

  • সঞ্চয়ে প্রাথমিকভাবে একজন ব্যক্তি লাভবান হলেও এই সঞ্চয়ই নেতিবাচক প্রভাব আনতে পারে তার জীবনে আরেক দিক দিয়ে।

বিন্দু বিন্দু জলে সিন্ধু হয়—করোনাকালে যেন এই প্রবাদে ঝাঁপিয়ে পড়েছে মানুষ। যে যেভাবে পারছে সঞ্চয়ে মনোনিবেশ করেছে। কী করলে সঞ্চয় করতে পারবে, কোথায় সঞ্চয় করবে, সঞ্চয় কেন করবে—এমন সব খবর লুফে নিচ্ছে সাধারণ মানুষ। সেদিন কথা হচ্ছিল পুরোনো এক বন্ধুর সঙ্গে, খুব জানতে চাইলেন কোথায় টাকা রাখবেন। তিনি এখন এক টাকাও বাড়তি খরচ করেন না। খুব হিসাব করে চলছেন। এমন কথা শুনলাম আরও বেশ কয়েকজনের মুখে। আর এটিই শঙ্কা জাগাচ্ছে ভবিষ্যৎ নিয়ে।

জন মেইনার্ড কেইনস

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে বর্তমান প্রেক্ষাপটে সঞ্চয় থাকা যে কত জরুরি, তা খুব টের পাচ্ছে মানুষ। তবে সবকিছুরই ‘নেগেটিভ-পজিটিভ’ দুটি প্রভাব থাকে। অর্থশাস্ত্রে ‘প্যারাডক্স অব থ্রিফট’ বলে একটি বিষয় আছে। অর্থনীতিবিদ জন মেইনার্ড কেইনস ১৯৩০ সালে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন মিতব্যয়ী হওয়ার এক কঠিন জটিলতা। প্যারাডক্স অব থ্রিফট নামে তাঁর এই বক্তব্য খুব সংক্ষেপে কিছুটা বুঝিয়ে বলা যায়। ধরেন, দেশে বেশ অর্থনৈতিক সংকট চলছে। রহিম আলী ভবিষ্যতের কথা ভেবে ব্যয় কমিয়ে দিল। রহিম আলীর পাঁচ বন্ধুও একই রকম ভাবল। তেমনি করে ওই পাঁচ বন্ধুর প্রত্যেকের আরও পাঁচজন করে বন্ধু একই রকম ভাবল। এভাবে একটি পুরো অর্থনীতির সবাই যদি ব্যয় কমিয়ে সঞ্চয় করতে থাকে, তাহলে এ ধাক্কায় বাজারে মোট চাহিদা কমে যায়, ফলে বাজারে টাকা ঘোরে না এবং শেষমেশ সবারই আয় কমে যায় এবং অর্থনৈতিক বৃদ্ধিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মন্দায় পড়ে অর্থনীতি।

বর্তমান করোনাকালে বিষয়টি যেন আরও প্রতিফলিত হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে মার্কিন অর্থনীতিকে তুলে ধরা যাক। মার্কিন অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, মানুষ যখন আগামীর ভালো দামের আশায় ব্যয় না করে সঞ্চয় করার সিদ্ধান্ত নেয়, তা বাজার ব্যর্থতা হিসেবেই বলা যায়। তারা অর্থ রাখছে, ব্যয় করছে না। কারণ, তারা মনে করে যে তাদের সতর্ক হওয়া উচিত। ঠিক এটাই ঘটছে করোনার কালে।

এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রে ভোক্তা ব্যয় রেকর্ড পরিমাণ কমে গেছে। অন্যদিকে পরিবারগুলোর সঞ্চয়ের হার বেড়ে যায় ৩৩ শতাংশ। মার্কিন অর্থনীতির জিডিপির ৭০ শতাংশ নির্ভর করে ভোক্তা ব্যয়ের ওপর। যদি মানুষ ব্যয় না করে, অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়বে, জিডিপি কমে যাবে এবং একটি দুষ্টচক্র তৈরি হবে।

বিশ্বব্যাপী করোনা সংকট তীব্র অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে, মানুষ যেভাবে পারছে হাতে অর্থ রাখতে চাইছে। যুক্তরাষ্ট্রে এপ্রিল মাসে দেখা গেছে, ভোক্তা ব্যয় রেকর্ড পরিমাণ কমে গেছে। দেশটির ব্যুরো অব ইকোনমিক অ্যানালাইসিসের তথ্য অনুযায়ী, ওই মাসে ব্যক্তিগত ব্যয় কমে যায় প্রায় ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ। অন্যদিকে পরিবারগুলোর সঞ্চয়ের হার বেড়ে যায় ৩৩ শতাংশ। ৪৫ বছরের মধ্যে যা সর্বোচ্চ। ফেব্রুয়ারিতে যা ছিল মাত্র ৮ শতাংশ।

এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, সঞ্চয় করলে অসুবিধা কী? সঞ্চয়ে প্রাথমিকভাবে একজন ব্যক্তি লাভবান হলেও এই সঞ্চয়ই নেতিবাচক প্রভাব আনতে পারে তার জীবনে আরেক দিক দিয়ে। যেমনটা ওপরে বলা হলো, কেইনসের প্যারাডক্স অব থ্রিফট থিওরিতে। সেই অনুযায়ীই বিষয়টি বিশ্লেষণ করি। মার্কিন অর্থনীতির জিডিপির ৭০ শতাংশ নির্ভর করে ভোক্তা ব্যয়ের ওপর। যদি মানুষ ব্যয় না করে, অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়বে, জিডিপি কমে যাবে এবং একটি দুষ্টচক্র তৈরি হবে। যার প্রতিফলন দেখা গেছে দ্বিতীয় প্রান্তিকে। অর্থাৎ, এপ্রিল থেকে জুন—এই সময়ে মার্কিন অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছে ৩২ দশমিক ৯ শতাংশ।

অর্থনীতিতে একটি কথা আছে, টাকায় টাকা আনে, কাজে কাজ আনে। অনেক অর্থনীতিবিদ ভোগের নীতিতে বিশ্বাসী। আবার অনেকে সঞ্চয়ের। কিন্তু অধিকাংশ অর্থনীতিবিদ বলেন, ব্যয় আর সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য রেখে যুক্তির প্রতিফলন ঘটানোটা জরুরি। মার্কিন বিশ্লেষকেরা বলছেন, মানুষ যত বেশি অর্থ ব্যয় করতে অনীহা প্রকাশ করবে, অর্থনীতিকে ঘুরিয়ে আনতে তত বেশি সময় লাগতে পারে। জটিলতাটা হলো, যেখানে মানুষ মন্দার কারণে সঞ্চয় করছে, সেখানে সেই সঞ্চয়ই মন্দাকে দীর্ঘায়িত করতে পারে।

আগের মন্দায় যা ঘটেছিল

১৯৩০ সালের মহামন্দা অনেক পরিবারকে তাদের ব্যক্তিগত অর্থায়নে সামঞ্জস্য করতে বাধ্য করেছিল। আয়ের তলানিতে থাকা মানুষগুলোও আগের তুলনায় সঞ্চয় বাড়িয়ে দেয়। দুর্ভাগ্যক্রমে যা মন্দাবস্থাকে আরও খারাপ অবস্থায় নিয়ে গিয়েছিল। সঞ্চয়ের এই বৃদ্ধি স্বতন্ত্র পরিবারের পক্ষে ভালো হলেও পুরো অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত। এই পরিস্থিতি আয়বৈষম্যেরও সৃষ্টি করে।

আসলে অর্থনৈতিক ভালো অবস্থা, মন্দা এবং পুনরুদ্ধার—এই তিন সময়ে ভোক্তার আচরণ আলাদা থাকে। ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে ২০১৪ সালে তৈরি মার্কিন এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০০৭ সালে যখন অর্থনৈতিক উত্থান ছিল, তখন মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের চেয়ে বিলাসী পণ্যে ব্যয় বেশি করেছিল। ২০০৮ সালে মন্দার শুরু হলে খাদ্যপণ্যের চাহিদা ব্যাপক বেড়ে যায় এবং পুনরুদ্ধার সময় আবার তা কমে। এটা অবশ্য আরেক অর্থনৈতিক তত্ত্বে পড়ে। তা হলো ‘অ্যাঙ্গেলস ল’।

তাহলে কি সঞ্চয় নয়

ওপরের এত কথায় মনে হতে পারে, তাহলে কী এখন সঞ্চয় করব না। আসলে সঞ্চয় করা ভালো। তবে অবশ্যই তা প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটিয়ে। অনেক বেশি সঞ্চয়ের অর্থ হলো বর্তমান ভোগকে ত্যাগ করা। মন্দার সময় মানুষ সঞ্চয় করে। কারণ, কোনো সংকট তৈরি হলে, যেমন চাকরি হারালে, আয় না থাকলে যেন তা সামাল দেওয়া যায়। অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, আর্থিক অসুবিধা মোকাবিলা করার সেই ক্ষমতা শেষ পর্যন্ত অর্থনীতি দ্রুত পুনরুদ্ধার করে। কারণ, ব্যয়গুলো মেটানো সম্ভব হলে তা অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। ব্যাংক, মুদিদোকান তাদের দরজা উন্মুক্ত রাখতে পারে। কর্মীরাও কাজে নিযুক্ত থাকেন। তবে ব্যক্তিগত সঞ্চয়ের কোনো ঝুঁকি নেই, তা কিন্তু নয়। সেটা কেমন? ধরেন, বর্তমান সংকটের সময় কী হচ্ছে। দেশে দেশে সরকারগুলো সহায়তা প্যাকেজ সরবরাহ করছে। যখন কোনো সরকার তার নাগরিকদের একটি অর্থনৈতিক উদ্দীপনা প্যাকেজ সরবরাহ করে, তখন সাধারণত অতিরিক্ত সার্বভৌম ঋণের মাধ্যমে এই ব্যয়ের অর্থায়ন করে। অন্যদিকে কেবল টাকা ছাপিয়ে যদি সরকার সহায়তা দেয়, তাহলে পরবর্তী সময়ে তা মূল্যস্ফীতিকে বাড়িয়ে দেয়। আর সঞ্চয়ের সবচেয়ে বড় শত্রুই হলো মূল্যস্ফীতি। কারণ, অর্থের মূল্য কমে যায়। ১০০ টাকা সঞ্চয় করলাম। কিন্তু তা দিয়ে ভবিষ্যতে আগের চেয়ে কম পণ্য কিনতে পারলাম।

অবশ্য অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, ব্যক্তিগত এবং জাতীয়, উভয় স্তরে শক্ত সঞ্চয়হার বজায় রাখা অর্থনৈতিক দুর্দশার অন্যতম সেরা নিরাময়। এর অর্থ হলো, মানুষকে উপায় রাখতে হবে। তবে ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক সংকটের জন্য কম সংবেদনশীল হতে হবে।

অর্থনীতির ভাষায় সঞ্চয় হলো বিনিয়োগ। সঞ্চয়ের অনুপাত অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের একটি বড় নির্ধারক। সঞ্চয় থেকে বিনিয়োগ হয়। নীতিগতভাবে, ‘সঞ্চয় বিনিয়োগ সংস্কৃতিতে’ কোনো ভুল নেই। উচ্চ সঞ্চয় উচ্চতর স্তরের বিনিয়োগের অর্থায়ন করতে এবং দীর্ঘ মেয়াদে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সহায়তা করতে পারে। মানুষ যদি বেশি সঞ্চয় করে, তবে ব্যাংক বিনিয়োগের জন্য ফার্মগুলোকে আরও ঋণ দিতে সক্ষম হয়। যে অর্থনীতিতে সঞ্চয় খুব কম হয়, তার মানে দাঁড়ায়, অর্থনীতি দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের তুলনায় স্বল্পমেয়াদি খরচ বেছে নিচ্ছে। এতক্ষণ তো কেইনসের মিতব্যয়িতার জটিলতা নিয়ে বলেছি। তবে অর্থনীতির আরেক মডেল ‘হ্যারল্ড ডোমার মডেল’ পরামর্শ দেয়, সঞ্চয়ের স্তরটি হলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার নির্ধারণের মূলমন্ত্র। মডেলটা অনেকটা এমন, সঞ্চয় বাড়ছে, বিনিয়োগ বাড়ছে, মূলধন বাড়ছে, ফলে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, মানুষের হাতে অর্থ আসছে, আবার সঞ্চয় বাড়ছে। হ্যারল্ড ডোমারের মডেলেও বলা হয়েছে, দীর্ঘ মেয়াদের জন্য সঞ্চয় বেশ ভালো হলেও স্বল্প সময়ের মধ্যে খুব বেশি সঞ্চয় প্রবণতায় মন্দার আশঙ্কা থাকে।

তাই বলা যায়, সব বিসর্জন দিয়ে সঞ্চয়ে ভবিষ্যৎকে খুব বেশি উজ্জ্বল করা সহজ হবে না। সাধারণত একজন মানুষের আয়ের কত শতাংশ সঞ্চয় করা উচিত, তা নির্ভর করে তার আয় এবং অবশ্যম্ভাবী ব্যয়ের ওপর। অর্থনীতির সাধারণ হিসাব হচ্ছে, একজন মানুষের আয়ের এক–চতুর্থাংশ, অর্থাৎ ২০-২৫ শতাংশ অর্থ যদি কেউ নিয়মিত সঞ্চয়ের অভ্যাস করতে পারে, তাহলে তাকে ভবিষ্যতে অর্থকষ্টে পড়তে হবে না ।