সন্তানের কোন আবদার মেটাব কোনটা না

ছেলে মোটরসাইকেলের মতো জিনিসের আবদার করতেই পারে, কিন্তু কোন বয়সে কোন অাবদার মেটানো উচিত, বাবাকে তা ভেবে দেখতে হবে। স্থান: হিরো মোটরসাইকেল সেন্টার, শান্তিনগর, ঢাকা
ছেলে মোটরসাইকেলের মতো জিনিসের আবদার করতেই পারে, কিন্তু কোন বয়সে কোন অাবদার মেটানো উচিত, বাবাকে তা ভেবে দেখতে হবে। স্থান: হিরো মোটরসাইকেল সেন্টার, শান্তিনগর, ঢাকা

দ্বীপের (ছদ্মনাম) কোনো কিছুর জন্য বায়না ধরা দিন দিন বেড়েই চলেছে। যা সে চায় তা তাকে দিতেই হবে। কোনো কিছু পাওয়ার পর কিছুদিন সেটা নিয়ে মেতে থাকে, এরপর সেটির প্রতি সব আগ্রহ চলে যায়। শুরু হয় নতুন বায়না। দ্বীপের বয়স এখন ১৬। ছোটবেলা থেকেই সে এমন। তার আবদার একটা মোটরসাইকেল কিনে দিতে হবে। ১৬ বছর বয়সী সন্তানের মোটরসাইকেল কেনার আবদার মা-বাবা কি মেটাবেন? কিংবা এমন বায়না কি মেটানো উচিত?

কয়েক দিন আগে পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে উত্তরার একটি ঘটনা প্রবলভাবে আলোড়িত করল। নবম শ্রেণির ছাত্রকে হত্যার চেষ্টা করেছে দশম শ্রেণির আরেক ছাত্র। কয়েক দিন চিকিৎসার পর নবম শ্রেণির সেই কিশোর প্রাণে বেঁচেছে। খবরে জানা গেছে, দশম শ্রেণির কিশোরের সঙ্গে বন্ধুত্ব বেশি দিনের নয়। ১৬ বছর বয়সী নবম শ্রেণির কিশোর তার বাবার কাছে মোটরসাইকেল চেয়েছিল। এসএসসি পাস করার আগে বাবা তাকে এটা দিতে চাননি। তবে তিনি বলেছিলেন, এসএসসির পর ছেলেকে গাড়ি বা মাইক্রোবাস কিনে দেবেন। কিন্তু দশম শ্রেণির ছেলেটির সঙ্গে মিলে ঠিকই মোটরসাইকেল চালাত এই কিশোর। মা-বাবার কাছ থেকে হাতখরচের জন্য টাকা নিয়ে বাইকের তেল কেনা হতো। এরপর একদিন রাতে ডেকে নিয়ে দশম শ্রেণির কিশোর নবম শ্রেণির এই ছাত্রের শরীরে ছুরি দিয়ে আঘাত করে।

অতিরিক্ত চাহিদা, পাওয়ার জন্য জেদ ধরা, না পেলে নানা রকম এলোমেলো আচরণ করা এগুলো মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এতে শিশুরা অবিবেচক হয়। মা-বাবার অর্থনৈতিক অবস্থার প্রতি সচেতনতা থাকে না। মা-বাবাকে কষ্ট দেয়, কোনো জিনিসের ঠিকমতো মূল্য দেয় না। কোনো জিনিসই তাদের বেশিক্ষণ আনন্দ দিতে পারে না এবং অপচয় করতে শেখে। পাশাপাশি অর্থনৈতিক সচ্ছলতা থাকলেই যে সন্তানের সব আবদার মানতে হবে, তা-ও একেবারে উচিত নয়। সন্তান বই কিনতে চাচ্ছে সে আবদার মেটানো ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে কিন্তু মোটরবাইক, দামি স্মার্টফোন কিংবা গাড়ির আবদার মেটানো হলে তার নেতিবাচক প্রভাব সন্তানের ওপর পড়বেই। সন্তানের কোন আবদার মেটাবেন আর কোনটা মেটাবেন না এটা মা-বাবাদের জানা জরুরি।

প্রয়োজনের অতিরিক্ত জিনিসপত্র না দেওয়া

প্রত্যেক শিশুরই চাহিদা রয়েছে এবং বয়সভেদে চাহিদার পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু এই চাহিদা পূরণ করারও সীমা থাকতে হবে। কোনো শিশুকেই বাড়তি খেলনা, পোশাক ইত্যাদি কিনে দিতে হয় না। কারণ তাতে শিশু বেশি বেশি জিনিসে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে এবং কোনো কিছুই তাকে বেশি তৃপ্তি বা আনন্দ দিতে পারে না।

সব চাহিদাই না মেটানো

শিশুরা ছোটবেলা থেকে নানা কিছু পেতে চায়। কিন্তু মা-বাবা বা অন্যাদের সব চাহিদা পূরণ করা উচিত নয়। বড়রা যদি শিশুর সব চাহিদা পূরণ করেন, তবে শিশুর চাহিদা দিন দিন বাড়তেই থাকে। একসময় তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। দ্বীপের মা-বাবা ছোটবেলা থেকে কমবেশি তার সব আবদারই পূরণ করতেন। ফলে দ্বীপ অতিরিক্ত চাহিদাসম্পন্ন হয়ে উঠেছে।

বইয়ের মতো উপহার যেকোনো সময়ই দেওয়া যায়। মডেল: জাকির হোসেন ও শাহরিয়ার। স্থান: বাতিঘর, ঢাকা, ছবি: সুমন ইউসুফ
বইয়ের মতো উপহার যেকোনো সময়ই দেওয়া যায়। মডেল: জাকির হোসেন ও শাহরিয়ার। স্থান: বাতিঘর, ঢাকা, ছবি: সুমন ইউসুফ

বেশি দামি জিনিসপত্র দেবেন না

শিশুর জন্য খেলনা, পোশাক, জুতা বা যেকোনো কিছু কেনার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে সেগুলো বেশি দাম দিয়ে না কেনা হয়। ছোটবেলা থেকে বেশি দামি জিনিস পেতে থাকলে দামি জিনিসে সে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে। ফলে কেউ দামি জিনিস উপহার না দিলে শিশু তা পছন্দ করবে না। বড় হয়ে দামি কিছু ছাড়া ব্যবহার করতে চাইবে না। মা-বাবার যদি কোনো সময়ে কোনো কারণে দামি জিনিস কিনে দেওয়ার ক্ষমতা না থাকে, তবে শিশুর এই অভ্যাস বড় সমস্যা তৈরি করে।

সীমিত কেনাকাটা

সন্তানসহ পরিবারের সবার কেনাকাটার চাহিদাও সীমিত রাখতে হবে। শিশুদের কম দিয়ে বড়রা যদি অতিরিক্ত খরচ করেন তবে সে এ ব্যাপারটিকে সহজভাবে নেয় না এবং জিনিসপত্র পাওয়ার জন্য জেদ করা শুরু করে। তাই কারও জন্যই অতিরিক্ত কেনাকাটা করা ঠিক নয়।

ছোটবেলা থেকেই বুঝিয়ে দেওয়া ও বুঝিয়ে বলা

কেন সব চাহিদাই পূরণ করা হবে না, তা শিশুদের ছোটবেলা থেকে বুঝিয়ে বলতে হবে। রাগ করে, ধমক দিয়ে, মেরে বা চিৎকার করে বোঝানো যায় না। ঠান্ডা মাথায় সুন্দর করে কারণগুলো বুঝিয়ে বলতে হবে। মা-বাবার অর্থনৈতিক অবস্থার কথাও সন্তানের উপযোগী করে তাকে বোঝাতে হবে।

ছেলে ও মেয়ে সন্তানের মধ্যে কোনো পার্থক্য নয়

অনেক পরিবারে ছেলে সন্তানের সব চাহিদা পূরণ করা হয়, সে তুলনায় মেয়ের চাহিদা পূরণ করা হয় না। এ ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণে ছেলেরা অতিরিক্ত চাহিদাসম্পন্ন হয়ে উঠতে পারে। অপরদিকে মেয়ে অভিমানী হয়ে উঠতে পারে এবং দুঃখ পেতে পারে। এ ধরনের বৈষম্যের কারণে ভাইবোনের মধ্যে হিংসার সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে।

সন্তানকে সময় দেওয়ার বদলে অতিরিক্ত জিনিস না দেওয়া

আজকাল প্রায়ই দেখা যায় চাকরি বা ব্যবসার কাজে মা বা বাবাকে ঘন ঘন দেশের বাইরে যেতে হয়। তাঁরা সন্তানের জন্য বিদেশ থেকে বেশি বেশি জিনিসপত্র কিনে আনেন। তাঁরা হয়তো ভাবেন, দামি জিনিসপত্র দিলেই সন্তান খুশি হয়ে যাবে এবং তাদের অনুপস্থিতি সহজভাবে নেবে। আসলে মা-বাবার সন্তানের কাছে থাকা, তার যত্ন নেওয়া, তার সঙ্গে গল্প করা ইত্যাদির কোনো বিকল্প নেই। সন্তানের জন্য এটাই মঙ্গলের।

সব আবদার মেটানো হয় এমন বিষয়ে আলাপ না করা

আমাদের অনেকেরই শিশুর চাহিদা নিয়ে কথা বলার অভ্যাস রয়েছে। যেমন অন্যের সঙ্গে কথা বলার সময় আমরা বলে থাকি, ‘আমি আমার বাচ্চার সব চাহিদা পূরণ করি, ও কিছু চাইবে আর আমি দেব না এমন হতেই পারে না।’ এ ধরনের কথা শিশুর সামনে বললে সে আরও বেশি করে চাইতে থাকবে। তার বায়না না রাখলে প্রচণ্ড জেদ করবে রাগ প্রকাশ করবে।

লেখক: মনোবিজ্ঞানী