সপরিবারে করোনা জয়ের আনন্দ

করোনাভাইরাস প্রতীকী ছবি
প্রথম আলো

আমি শিশুদের চিকিৎসক। দিনের বেলা হাসপাতাল আর সন্ধ্যায় চেম্বার, ছুটির দিন ছাড়া ৩০ বছর ধরে এই আমার রুটিন। আমার মেয়েরা বড় হয়েছে এর মধ্যেই। তাদের গুণগত সময় (কোয়ালিটি টাইম) দিতে চেষ্টা করেছি, তারপরেও মাঝেমধ্যে তারা মন খারাপ করত। দেশে করোনাভাইরাস আসার পর প্রায় ছয় মাস হলো এই রুটিন বদলে গেছে। এখন আমি বাসায় থাকি, চেম্বারে যাই না। অফুরন্ত সময় হাতে। তাই স্বামী–সন্তানদের সঙ্গে গল্প করে, গান শুনে, পছন্দের সিনেমা দেখে সময় কেটে যাচ্ছে। এ রকম জীবনের স্বাদ পেলাম বহুদিন পরে। মেয়েরা উচ্ছ্বসিত আমাকে কাছে পেয়ে।

এই সময়ে পরিবার, স্বজন ও বন্ধুদের সঙ্গে ফোনে কথা বলি, সবার শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিই। আমার শিশু রোগীদের অসুস্থতার জন্য বাবা–মাকে ফোনে পরামর্শ দিই। নিজের তাহমীনা বেগম ফাউন্ডেশনসহ নানা মাধ্যমে গ্রামের অসহয় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি। শেষ করলাম বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী। অনেকদিন পর প্রিয় কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনাসমগ্র নতুন করে পড়া শুরু করলাম। পড়লাম লেখক হারুকি মুরাকামির দুটি বই। হাতের কাছেই আছে রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ। এই এক বই, কতবার যে পড়লাম, তারপরও মনে হয় প্রথমবার পড়ছি। সময় ভালোই কেটে যাচ্ছিল।

এর মধ্যে আমার অনেক প্রিয়মুখ ও পরিচিতজন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। আমার একজন প্রিয় বন্ধু ডাক্তার আজিজুর রহমান মারা গেল। তার জন্য মন বেদনার্ত হয়। প্রিয়জনদের এভাবে করোনায় আক্রান্ত হয় চলে যাওয়ায় মাঝেমধ্যে আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। কখন না জানি করোনা হানা দেয় আমাদের পরিবারে। আমার স্বামী অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমেদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্যালিয়েটিভ কেয়ার বিভাগের চেয়ারম্যান। সপ্তাহে দুই দিন তাঁকে হাসপাতালে যেতে হয়।

১ জুলাই আমার স্বামীর জ্বর আসে, সঙ্গে মাথাব্যথা। দুই দিনের মধ্যে প্রচণ্ড কাহিল হয়ে পড়েন। যুক্ত হলো কাশি। তাঁর ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ আছে, আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি। আমার ছোট মেয়ের সামান্য জ্বর ও শরীরে ব্যথা শুরু হলো স্বামীর পর। তার এক দিন পর থেকে আমারও মাথাব্যথা, জ্বর। সবার করোনা টেস্ট পজিটিভ আসে। বাসায় চিকিৎসা শুরু করা হয়।

চার ঘণ্টা পরপর পালস অক্সিমিটার দিয়ে অক্সিজেনের মাত্রা দেখি। স্বামীর অসুস্থতার সাত দিনে এসে শ্বাসকষ্ট শুরু হলে তাঁকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিউ) ভর্তি করি। অবস্থা খারাপ হয়ে যাওয়ায় তিন দিন পর তাঁকে এভারকেয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাই। তাঁর ফুসফুস প্রায় ৭০ ভাগ আক্রান্ত, দেখার কোনো উপায় নেই, পাশে থাকার কোনো উপায় নেই, দুশ্চিন্তায় পরিবারের বাকিরা ঘুমাতে পারি না। তাঁর পাশের বিছানার রোগী মারা যাওয়ার সংবাদ শুনে আমাদের চিন্তা আরও বেড়ে যায়। সারা দিনে একবার ডাক্তার জাফর আমাদের ফোন করে জানাতেন আমার স্বামী কেমন আছেন। ডাক্তার জাফর অন্যান্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে আলোচনা করতেন বিভিন্ন সময়ে, তাঁর আন্তরিকতার জন্য আমরা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ।

কিছুটা সুস্থ হলে ১২ দিন পরে তাঁকে বাসায় নিয়ে আসি। কিছু ওষুধ খেতে হবে আরও অনেক দিন। করোনা–পরবর্তী জটিলতায় ও ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় এখনো তিনি দুর্বল, তবু আমরা আনন্দিত, তিনি আমাদের মাঝে আছেন। আমরা সবাই ভালো আছি। আমার মেয়ে আর আমি বাসাতেই চিকিৎসা নিয়েছি। কাহিল লাগত খুব, খেতে পারতাম না, তারপরও চেষ্টা করেছি ভালো থাকতে। এর মধ্যে আমাদের অনেক আত্মীয় করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁদেরকে বলেছি করোনা মোকাবিলা করতে প্রয়োজন মনের শক্তি। সবার প্রতি অনুরোধ, যাঁরা বয়স্ক ও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত, তাঁদেরকে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে, প্রয়োজনে হাসপাতালে যেতে হবে।

প্রতিদিন আমাদের নতুন জীবনে ভোর আসে, শরতের নীল আকাশে সূর্য ওঠে। সৃষ্টিকর্তার কাছে অসীম কৃতজ্ঞতায় আরেকটি আনন্দময় দিন আমরা পার করি। ঝুল বারান্দায় বসে গল্প করি, সেখানে অলকানন্দা, বেলি, রঙ্গন আর গোলাপ ফুটে আছে। প্রিয় কবি ওমর খৈয়ামের কথা মনে করি—

‘সদ্য ফোটা এই যে গোলাপগন্ধ প্রীতি উজ্জ্বল মুখ,

বলছে নাকি মিথ্যে এসব, এই ক্ষণিকের দুঃখ–সুখ।’

করোনাকালের এই দুঃখ–কষ্ট, বেদনা–বিষাদ আসলেই ক্ষণিকের। পৃথিবীর এই অসুখ ভালো হয়ে যাবে একদিন। এই মহামারির কাল শেষ হলে আমরা কেউ থাকব, কেউ থাকব না। আগামী দিনের পৃথিবীতে মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা বেঁচে থাকবে। মানুষের সঙ্গে প্রকৃতিও বাঁচবে তার মতো করেই। মানুষ আর প্রকৃতির ভারসাম্যপূর্ণ এক শান্তিময়, সুন্দর পৃথিবী দেখব আগামী দিনে, এই স্বপ্ন দেখি।

লেখক: শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ