সপ্তাহ দুয়েক আগে আমাদের ডিভোর্স হলো

>ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম। তিনি আপনার মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন।—বি. স.
মেহতাব খানম
মেহতাব খানম

সমস্যা
বছর দুয়েক আগে আমার বিয়ে হয়েছে পূর্বপরিচিত একজনের সঙ্গে। সাত-আট বছরের পরিচয় ছিল আমাদের। পরিচয়ের শুরুতে বন্ধুত্ব, তারপর বছর দুয়েকের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি। পরে পারিবারিকভাবে বিয়ে করি দুই বছর আগে। যদিও দুই পরিবারকে রাজি করাতে খুব কষ্ট হয়েছে। তারপরও বিয়ের পর আমাদের দুজনের মধ্যে ঝামেলা শুরু হলো। এরপর নিয়মিত ঝগড়াঝাঁটি। এর একটাই কারণ, সে আমাকে সন্দেহ করত। তার চালচলনে আমিও যে তাকে সন্দেহ করতাম না, তা–ও কিন্তু নয়। দিন দিন তা আরও বাড়তে লাগল। তার একটাই কথা—আমি আমার অফিসের সিনিয়রদের সঙ্গে মিশতে পারব না। আমারও কথা, তাহলে তুমিও কোনো মেয়ের সঙ্গে মিশতে পারবে না।
প্রসঙ্গত, আমরা দুজনই ভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। বলা চলে, প্রতিদিনই এসব বিষয় নিয়ে ঝামেলা লেগে থাকত। এসবের মধ্যেই কয়েক মাস আগে জানতে পারি, সে একটি মেয়ের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। এটা জানার পর আমি তার সঙ্গে না থাকার সিদ্ধান্ত নিই। সে–ও আমাকে বলে দেয়, এভাবে থাকতে পারলে থাকতে আর না হলে তার কাছ থেকে চলে যেতে। উল্টো দাবি করে বসে, আমি নাকি কার সঙ্গে কী করি। এমন অবস্থায় আমি বাবার বাড়িতে চলে আসি। বাবার বাড়িতেও স্বস্তিতে নেই। সবার কাছেই কথা শুনতে হচ্ছে। সব সময় মনে হয়, সবাইকে ছেড়ে চলে যাই।

নাম ও ঠিকানা প্রকাশে অনিচ্ছুক
পরামর্শ
এত বছরের পরিচয়ের পর তোমরা বিয়ে করলে, কিন্তু পারস্পরিক বিশ্বাসের জায়গাতে মনে হয় প্রথম থেকেই যথেষ্ট ঘাটতি ছিল। যেকোনো সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিশ্বাসের ভূমিকাটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সন্দেহের ব্যাপারটি বিয়ের আগেও ছিল কি না, সেটি উল্লেখ করলে ভালো হতো। তুমি লিখেছ, তোমরা দুজনেই দুজনকে সন্দেহ করছ। আর এই অবিশ্বাস যদি প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকে, তাহলে সম্পর্কটি খুব অসুন্দর ও ম্লান হয়ে যায়। দুজনের কেউ তখন আর স্বস্তিতে থাকতে পারে না।
দেখা যায়, দূরত্বটা ক্রমেই শুধু বাড়তে থাকে। ভালোবাসার সম্পর্কটি চলাকালীনও যদি পরস্পরকে শর্ত আরোপ করা হয় অর্থাৎ কারও ব্যক্তিগত অভিরুচিকে অসম্মান করে তার আচরণ পরিবর্তনের জন্য জোর করা হয়, তাহলে বুঝতে হবে যে সেই সম্পর্কে শ্রদ্ধাবোধের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। যেমন আমি প্রায়ই শুনি, তারা কার সঙ্গে কথা বলবে বা বন্ধুত্বের সম্পর্ক রাখবে, তা নিয়ে একে অপরকে বাধ্য করার চেষ্টা করছে। যদি কোনো একজন বা দুজনই সম্পর্কের প্রতি আন্তরিক না থাকে, তাহলে শর্ত আরোপ না করলেও সে কিন্তু বিশ্বাস ভঙ্গ করতে পারে।
তোমরা দুজনেই শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে বাইরে কাজ করছ, অথচ কাজের জায়গায় তুমি কার কার সঙ্গে মিশতে পারবে না, তা নিয়ে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হলো। তুমিও জেদের বশে এবং অবিশ্বাসজনিত কারণে তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করলে। এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, এটি করে তুমি তার আচরণকে পরিবর্তন করতে সক্ষম হওনি, তাই না? এরপরও কিন্তু তোমাকে সে আবার শর্ত দিল, সবকিছু মেনেই ওর সঙ্গে থাকতে পারলে তুমি তা করতে পারো। শুধু তা-ই নয়, একটি পারস্পরিক দোষারোপের পর্যায় এরপর শুরু হলো। এ অবস্থায় তোমরা যদি কোনো পেশাজীবী কাউন্সেলরের সঙ্গে বসে ‘ম্যারিটাল থেরাপি’ বা ‘কাপল থেরাপি’ গ্রহণ করতে পারতে, তাহলে খুব ভালো হতো।
ডিভোর্সের সিদ্ধান্তটি তোমাদের দুজনেরই ছিল কি না, তা জানাওনি। তবে এখন তো একটি আইনগত প্রক্রিয়া তোমরা শেষ করেছ। একই সঙ্গে তোমার যা মনের অবস্থা, তাতে বোঝা যাচ্ছে তুমি খুব কষ্ট পাচ্ছো। আশপাশের মানুষগুলো তোমার দুঃখের সাথি না হয়ে বরং তোমাকে আরও বেশি আঘাত দিচ্ছে। এটি সত্যিই খুব হতাশাব্যঞ্জক! যাঁরা তোমাকে পৃথিবীতে এনেছেন, তাঁদের কিন্তু একটি বড় দায়িত্ব হচ্ছে সন্তানের কষ্টের সময় তার পাশে থাকা এবং তাকে সামনে এগিয়ে যেতে সাহস ও অনুপ্রেরণা জোগানো। তুমি যদি কোনো ভুল করে থাকো, তাহলে সেই ভুলের কিছু দায়িত্ব তাঁদের ওপরেও বর্তায়। আশা করছি, এ ঘটনা থেকে যন্ত্রণা ও শোকের অংশটুকু ঝেড়ে ফেলে তুমি শুধু শিক্ষাটুকু গ্রহণ করবে; আবার নতুন করে পথ চলার শক্তি খুঁজে নেবে। যদি সেটি একা করতে খুব অসুবিধা হয়, তাহলে কোনো কাউন্সেলরের সহায়তা গ্রহণ কোরো, কেমন।