সম্পর্কে যখন হিংসার মনোভাব প্রকাশ পায়

ব্যক্তিগত ছবি ছড়িয়ে দেওয়াসহ হুবহু একই নাম ও ছবি দিয়ে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলার অভিযোগে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী। ছয় মাস পার হলেও আসামি গ্রেপ্তার হননি। উল্টো আসামির পরিবার থেকে মামলা তুলে নেওয়ার চাপ ছিল। তবে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী মামলা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অনড়। আশার কথা, পরিবারের সমর্থনও পাচ্ছেন তিনি।

কিন্তু নারায়ণগঞ্জের এক তরুণী সামাজিক নিগ্রহের ভয় ও লজ্জায় আত্মহত্যাই করলেন। ধর্ষণের অভিযোগে নুরুল আমিন নামের একজনকে আসামি করে মামলা করেন ওই তরুণীর মা। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ধর্ষণের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিলে তরুণী আত্মহত্যা করেন। তরুণীর বাবা দিনমজুর এবং মা গৃহপরিচারিকা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যক্তিগত ছবি–ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটলে পরিবারের সমর্থন সবচেয়ে বেশি জরুরি। বাংলাদেশের সমাজবাস্তবতায় ‘ভিকটিম ব্লেমিং’ বা ভুক্তভোগীকেই দোষারোপ করা হয়। নিরুপায় হয়ে অনেকেই তখন আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। এসব ক্ষেত্রে পরিবার, বন্ধু ও সমাজ থেকে সহযোগিতা পেলে নিজের জীবনহানির ঘটনা থেকে মেয়েরা ফিরে আসতে পারেন। অপরাধীর বিরুদ্ধে বিচারও চান; যেমনটা কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে ঘটেছে। তিনি বলেন, বন্ধুরা যখন জানতে পারেন, তখনই তাঁকে আইনি সহায়তা নিতে এবং মানসিকভাবে শক্ত থাকতে সাহস দেন। পরিবারও পাশে ছিল। তবে তিনি জানান, এত সহায়তা পাওয়ার পরও অভিযুক্ত ব্যক্তির পরিবার কিছুটা প্রভাবশালী হওয়ায় তিনি চাপে আছেন। সামাজিকভাবে হেয় হতে পারেন, এ ভয়ে ঈদে বাড়িতেও যাননি।

আরও পড়ুন

সাইবার ট্রাইব্যুনালে আসা মামলার প্রায় ২৫ শতাংশই অন্তরঙ্গ ছবি ছড়িয়ে দেওয়া, মানহানি, অশ্লীল ছবি ও তথ্য প্রকাশের অভিযোগে হয়। সাইবার ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর নজরুল ইসলাম বলেন, এই ধরনের মামলায় ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত সাজার পরিমাণ প্রায় ৪৫০টি। তিনি জানান, প্রথম দিকের তুলনায় এ ধরনের মামলা এখন কমে এসেছে। কারণ হিসেবে নজরুল ইসলাম বলেন, মানুষ এ মামলা সম্পর্কে জানছে। এ ছাড়া অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী রায়ের পর্যায়ে এসে আপস করে ফেলেন। সাক্ষ্য-প্রমাণও সব সময় যথেষ্ট পাওয়া যায় না।

সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ানেস ফাউন্ডেশনের ‘বাংলাদেশে প্রযুক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে যৌন নিপীড়ন ২০২১’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভুক্তভোগীদের ৯২ শতাংশই নারী। একই সংস্থার আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়, সাইবার অপরাধের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকেন্দ্রিক ও অ্যাকাউন্ট হ্যাকিংয়ের ঘটনা ২৮ শতাংশ। ভুক্তভোগীদের মধ্যে ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সীই বেশি। এ ছাড়া সাড়ে ৫৬ শতাংশ নারী সাইবার অপরাধের শিকার। যৌন নিপীড়নের কনটেন্ট ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ভিডিও–ছবি সবচেয়ে বেশি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার পরিমাণ প্রায় ৩৬ শতাংশ আর ভুক্তভোগীকে ব্যক্তিগতভাবে প্রদান করা হয় প্রায় ৪১ শতাংশ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান খন্দকার ফারজানা রহমান বলেন, সম্পর্কও এখন দেনা-পাওনার বিষয় হয়ে গেছে। কেউ কারও প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। অঙ্গীকারবদ্ধও থাকে না। সম্পর্কে হিংসার মনোভাব প্রকাশ পায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে এ ধরনের বিষয়গুলো প্রকাশ করাও সহজ হয়ে গেছে। কোনো মেয়ে যখন এ ধরনের ঘটনার শিকার হন, তখন পরিবার ও সমাজকে বড় ভূমিকা পালন করার কথা বলেন ফারজানা রহমান। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রযুক্তিজ্ঞান উন্নত করার বিষয়গুলো ভালোভাবে পড়ানোর ওপর জোর দেন তিনি।

আরও পড়ুন

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অন্যতম বড় প্ল্যাটফর্ম ফেসবুক। অন্তরঙ্গ ছবি বা ভিডিও শেয়ারের বিষয়ে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ফেসবুকের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটি দাবি করেছিল, সম্মতি ছাড়া কারও ব্যক্তিগত ছবি ফেসবুক প্রকাশ করতে দেয় না—এ ধরনের কোনো হুমকিও তারা সমর্থন করে না। এ ছাড়া অনুমিত ছাড়া কারও কোনো ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি কেউ প্রকাশ করলে ওই অ্যাকাউন্ট নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মিতি সানজানা বলেন, অন্তরঙ্গ ছবি বা ভিডিও সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে প্রকাশের ঘটনাগুলো খুবই স্পর্শকাতর। ভুক্তভোগী হয়তো সাহস করে মামলা করতে চান। কিন্তু তাঁর পারিপার্শ্বিক অবস্থা সহায়ক হয় না, পরিবারের সমর্থনও থাকে না। এ ক্ষেত্রে নিজেকেই শেষ করে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নিতে তাঁরা বাধ্য হন।

এসব ঘটনায় ভুক্তভোগীকে পুনর্বাসন ও কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। দেশে বিচারিক প্রক্রিয়া দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। কিন্তু অন্তরঙ্গ ছবি–ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হয়। প্ল্যাটফর্ম থেকে কনটেন্ট সরিয়ে নেওয়া এবং অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনা সবার আগে জরুরি।