সহশিক্ষা কার্যক্রম থেকে মুক্তচিন্তার চর্চা

সহশিক্ষা কার্যক্রমের মধ্য দিয়েই এক হয় নানা শ্রেণি, নানা মতের শিক্ষার্থীরা। ছবি: সংগৃহীত
সহশিক্ষা কার্যক্রমের মধ্য দিয়েই এক হয় নানা শ্রেণি, নানা মতের শিক্ষার্থীরা। ছবি: সংগৃহীত

‘ছোটবেলায় ভাবতাম, মা আমার সবকিছুতে সব সময় “না” বলে। তখন মন খারাপ হতো, রাগ করতাম। কিন্তু এখন আমি মায়ের জায়গা থেকে বোঝার চেষ্টা করি। আমি জানি, ঝট করে রেগে যাওয়া কোনো সমাধান না। আমরা এখন আলোচনা করি, আমি কেন কাজটি করতে চাইছি আর মা কেন ভাবছেন এটা করা উচিত না—এ নিয়ে আলোচনা করতে করতেই বেরিয়ে আসে সুন্দর একটি সমাধান।’ সম্প্রতি ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি কমিউনিকেশন অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব আয়োজিত ‘পাবলিক স্পিকিং কম্পিটিশন’–এ এমনটাই বলছিলেন একজন প্রতিযোগী। দুটি প্রজন্মের দূরত্বের কারণে সৃষ্ট সমস্যাগুলোর ভুক্তভোগী আমরা সবাই কিন্তু এমন গঠনমূলকভাবে ভাবার সময় বা সুযোগ হয়তো আমাদের অনেকেরই হয় না। অথচ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আয়োজিত একটি প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে গিয়ে কী দারুণভাবেই না গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সবার সামনে তুলে ধরলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী!

যে ধরা–বাঁধা সিলেবাসের পড়াশোনা আর ভালো ফলাফলের ইঁদুর দৌড়ের মধ্যে শিক্ষার্থীরা বেড়ে ওঠে, সেখানে সহমর্মিতা, অন্যের মতকে গুরুত্ব দেওয়ার মতো বিষয়গুলো খুব একটা আসে না। ফার্স্ট হতে হবে, ক্যারিয়ারে এগিয়ে থাকতে হবে—এত তাড়ার মধ্যে সৃজনশীলতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চার সময় কই। কিন্তু এমন শত ব্যস্ততার মধ্যেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহশিক্ষা কার্যক্রমের উদ্যোগ হতে পারে সৃজনশীলতার বিকাশ ও মানবিক মূল্যবোধগুলো চর্চার চমৎকার একটি মঞ্চ।

সহশিক্ষা কার্যক্রম মানে পড়াশোনার বাইরেও বিভিন্ন কাজে অংশ নেওয়া। সেটি হতে পারে গান গাওয়া, ছবি আঁকার মতো সৃজনশীল কিছু, হতে পারে বিতর্ক বা বৈজ্ঞানিক গবেষণার মতো গঠনমূলক কাজ কিংবা বৃক্ষরোপণ, মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টির মতো স্বেচ্ছাসেবামূলক আয়োজন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বর্তমানে গড়ে উঠছে এমন নানা বিষয়ের ক্লাব বা সংগঠন। নিজের আগ্রহের বিষয়টি বেছে নিয়ে অনেকে মিলে চর্চার সুযোগ আছে এই সংগঠনগুলোতে। এ ব্যাপারে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্স বিভাগের পরিচালক পারিসা শাকুর বলেন, ‘তরুণ মানেই প্রচণ্ড প্রাণশক্তিতে ভরপুর এক প্রজন্ম। তারা সারাক্ষণই কিছু সৃষ্টি করতে চাইছে, কিছু বদলে দিতে চাইছে। তাদের এ প্রাণশক্তিকে সঠিক পথে নির্দেশিত করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহশিক্ষা কার্যক্রমের কোনো বিকল্প নেই।’

সহশিক্ষা কার্যক্রমবিষয়ক ক্লাবগুলো এমন একটি জায়গা, যেখানে একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থীরা একত্র হয়। সেখানে বয়সের পার্থক্য থাকে, থাকে মতামতের পার্থক্যও। তবু ক্লাবের স্বার্থে দিন শেষে একটি সুন্দর ফলাফল পেতে সব পার্থক্য ভুলে একসঙ্গে কাজ করে সবাই। আর এভাবেই তৈরি হয় ভিন্নমত বা ভিন্ন মানসিকতা মেনে নেওয়ার চর্চা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী রিদিতা তাহসিনের কণ্ঠেও প্রতিধ্বনিত হলো সেই একই কথা, ‘স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আমি বিভিন্ন সহশিক্ষা কার্যক্রমবিষয়ক ক্লাবে কাজ করেছি। এ সময় আমি বিভিন্ন মতাদর্শের মানুষের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করেছি বলে একজন উদার চিন্তার মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পেরেছি, শিখেছি অন্যের মতকে শ্রদ্ধা করতে।’

ক্লাসরুম আর বইয়ের পাতার বাইরের জগৎ যার কখনোই দেখা হয়নি, ক্লাবের মাধ্যমে সে–ও জেনে যায় বন্ধুত্ব কী চমৎকার একটি বিষয়। একক পরিবারে প্রায় একা একা বেড়ে ওঠা মানুষটিও ক্লাবের কাজ করতে গিয়ে উপলব্ধি করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার অদম্য শক্তি। আর সেই সঙ্গে পাওয়া যায় নতুন কিছু করার আত্মতৃপ্তি, নতুন অর্জনের আত্মবিশ্বাস। ক্লাব কালচার বা সাংগঠনিক সংস্কৃতি মানবিক মূল্যবোধ বিকাশে কীভাবে সহায়ক, তা জানতে চাইলে পারিসা শাকুর বলেন, ‘আজকালকার তরুণেরা বেশির ভাগই বড় হয় একক পরিবারে। ফলে প্রায়ই একাকিত্ব, অস্তিত্ব সংকটে ভোগে। সহশিক্ষা কার্যক্রমবিষয়ক ক্লাবগুলোতে যেহেতু অনেকে মিলে একসঙ্গে কাজ করছে, নিজেকে একা মনে করার সুযোগ সেখানে থাকে না। ক্লাব তাকে একটি পরিচয় দেয়, একটি প্ল্যাটফর্ম দেয়, যেখানে দাঁড়িয়ে সে নিজের কথা বলতে পারে।’

নিজের কথা বলতে পারার এ সুযোগ তরুণদের জন্য ভীষণ জরুরি। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের একটি জরিপ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে সহিংস উগ্রবাদ বৃদ্ধির কারণগুলোর মধ্যে উদ্দেশ্যহীনতা, অস্ত্বিত্বের সংকট, নিজের মতামত প্রকাশের জায়গা না থাকা অন্যতম। অর্থাৎ তরুণেরা যখন নিজেকে একা মনে করে, তার মতামত যখন যথার্থ গুরুত্ব পায় না, তখনই সে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে; যা পরবর্তী সময়ে তাকে ভুল পথের দিকে ঠেলে দেয়। এ ক্ষেত্রে সহশিক্ষা কার্যক্রম ঠিক কতটা কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে, জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী নাওয়েদ নাফিস বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকেই বিতর্ক করতাম, ফলে যেকোনো বিষয় নিয়ে কীভাবে মুক্তচিন্তা করতে হয়, অন্যের মতামতকে কীভাবে মূল্যায়ন করতে হয়, তা আমি সেখান থেকেই শিখেছি। বিতর্কের চর্চা আমাকে শিখিয়েছে নিজের যেকোনো ধারণাকে কীভাবে চ্যালেঞ্জ করতে হয়, যা জীবনের যেকোনো পর্যায়ে সঠিক পথ বেছে নিতে ভীষণ সহায়ক।’

যে সৃষ্টির আনন্দ উপলব্ধি করতে জানে, ধ্বংসের ভয়াবহতা তাকে আকৃষ্ট করে না। দলগত কাজের শক্তি যে বুঝতে শেখে, বিচ্ছিন্নতাবাদ তাকে বিভ্রান্ত করে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহশিক্ষা কার্যক্রমের চর্চা তরুণদের দেয় সৃষ্টিশীলতার ক্ষেত্র, দলবদ্ধ হয়ে কাজ করার শিক্ষা। তাই হিংসা-দ্বেষ আর যুদ্ধ-বিগ্রহে যখন প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে পৃথিবী, তখন প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহশিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা ভীষণ প্রয়োজন।