
সীমার জন্মের পর তাঁর মা খুব কেঁদেছিলেন। কন্যাসন্তান দেখে নয়, মা কেঁদেছিলেন মেয়ের দুটি হাতের দিকে তাকিয়ে। মেয়ের হাত দুটি কনুই পর্যন্ত। এমন সন্তানের খবর পেয়ে শ্বশুরবাড়ির অনেকে বলেছিলেন, নবজাতকের মুখে লবণ দিয়ে মেরে ফেলতে। কিন্তু মা কি নিজের সন্তানকে মেরে ফেলতে পারেন? তাই মায়ের কান্না থামে না। কিন্তু এ সময় সীমার মাকে যিনি সাহস জুগিয়েছেন, তিনি হলেন সীমার দাদা সিরাজ উদ্দিন শাহ।
সিরাজ উদ্দিন সীমাকে দেখে বলেছিলেন, ‘একে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তুমি মন খারাপ কোরো না। যে যাই বলুক এই মেয়ে আমাদের পরিবারের সদস্য হয়ে থাকবে।’ দাদা তাঁর নাম রাখলেন সীমা। তিনি বললেন, ‘এই মেয়ে বড় হয়ে আমাদের পরিবার এবং সমাজের জন্য দুর্লভ মণি-মুক্তার মতো কোনো কিছু বয়ে আনবে।’
দাদার সেই ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হয়েছে। সীমা এখন রাজশাহীর পবা উপজেলার উপখাদ্য পরিদর্শক। খর্বাকৃতির দুটি ডানা দিয়ে সীমা ব্যক্তিগত ও দাপ্তরিক সব কাজই করতে পারেন। চালাতে পারেন কম্পিউটার। ব্যবহার করতে পারেন মুঠোফোন। কাগজকলমে লিখতেও পারেন। চমৎকার তাঁর হাতের লেখা।
সীমার বাড়ি রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলার হরিদেবপুর গ্রামে। ছয় ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয়।
বড় হতে থাকেন সীমা। একদিন সীমার দাদা তাঁর মাকে বলেন, ‘সীমার পায়ে পেনসিল ধরিয়ে লেখার অভ্যাস করতে থাকো।’ এ কথা শুনে তাঁর মা মেয়ের পায়ে পেনসিল ধরিয়ে দেন। লেখার অভ্যাস করাতে থাকেন। মা মাটিতে পানি দিয়ে দাগ দিয়ে ‘ক’ লিখতেন। সীমা সেই ‘ক’-এর ওপর পা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে লেখা শিখতেন। যেদিন সীমা ‘ক’ লেখা শিখেছিল সেদিন দাদা তাঁর মাকে বলেছিলেন, ‘সংসারের কাজ হোক বা না হোক, মেয়ের পেছনে বেশি সময় দাও। তোমার মেয়েকে দিয়ে পড়ালেখা করানো সম্ভব হবে।’ মা তাই করতে থাকলেন। এরপর বিদ্যালয়ে যাওয়ার বয়স হলো। এবার মা চেষ্টা করতে থাকলেন, পায়ের বদলে ডানা দুটি দিয়ে লেখা যায় কি না। দ্রুত সীমা দুই কনুই এক জায়গায় করে কলম ধরে লেখার অভ্যাস রপ্ত করে ফেলে।

একটি গ্রাম পেরিয়ে বিদ্যালয়ে যেতে হতো। পথে লোকজন দল বেঁধে তাঁকে দেখতে আসত। কেউ কেউ নেতিবাচক মন্তব্য করত। সীমা বলেন, ‘একেক সময় মনে হতো আর বিদ্যালয়ে যাব না কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনে হতো। না আমাকে আরও সামনে অনেক দূর যেতে হবে।’ মা বলতেন, ‘তোমার আর পিছে ফিরে তাকানোর সময় নেই। তুমি নিজেকে এমনভাবে তৈরি করবে, যারা তোমাকে নিয়ে আমাকে ও তোমার বাবাকে নানা কথা বলেছেন, তারা যেন অনুতপ্ত হয়। তুমি সবার উদাহরণ হিসেবে গড়ে উঠবে।’
এভাবে ১৯৯৮ সালে তালন্দ আনন্দ মোহন উচ্চবিদ্যালয় থেকে সীমা এসএসসি পাস করেন। ২০০০ সালে তালন্দ ললিত মোহন ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি। ২০০৭ সালে রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে মনোবিজ্ঞান বিভাগ থেকে এমএসসি শেষ করেন।
সীমা জানান, বিদ্যালয় জীবন থেকেই সহপাঠীদের কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়েছেন। কেউ নেতিবাচক আচরণ করেননি। বাবাও পড়ালেখার বিষয়ে তাঁকে সাহায্য করেছেন।
শেষ পর্যন্ত সীমা কারও বোঝা হয়ে থাকেননি। পড়াশোনার পাশাপাশি ২০০৬ সালে তিনি রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রশাসনিক শাখায় দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ শুরু করেন। ২০০৮ সালের তিনি ঢাকায় অ্যাকশন অন ডিজাবিলিটি ডেভেলপমেন্টে (এডিডি) সমন্বয়কারী পদে চাকরির সুযোগ পান। সীমা জানান, এডিডি তাঁকে ভাবতে শেখায় পৃথিবীতে তিনি একা নন। এরপর ২০০৮ সালের ১১ জুন তিনি পবা উপজেলা উপখাদ্য পরিদর্শক পদে যোগদান করেন। এত সাফল্যের পরও সীমার মনে ছোট্ট একটা দুঃখ আছে, তাঁর দাদা এই সাফল্য দেখে যেতে পারেননি।