সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার প্রচেষ্টা

ইউএনএফপিএ ১৯৭৪ সাল থেকে কারিগরি ও পরামর্শক সেবা প্রদান এবং আর্থিক সহায়তাদানের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে কাজ করছে। ইউএনএফপিএর প্রধান অংশীদার হলো সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, জাতীয় সংসদ, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সমাজের বিভিন্ন সংগঠন।

যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্যের বিষয়গুলো তুলে ধরতে ইউএনএফপিএ সরকার, জাতিসংঘের অন্যান্য সংস্থা ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে অধিকারমূলক কর্মকৌশল ব্যবহার করছে। এ ক্ষেত্রে লক্ষ্য হলো, প্রসূতি ও নবজাতকের স্বাস্থ্যসেবা, পরিবার পরিকল্পনা, জরুরি ধাত্রীসেবা এবং প্রসবকালে দক্ষ সেবার ক্ষেত্রে বিদ্যমান ঘাটতি কমিয়ে আনা। ইউএনএফপিএ ছেলে-মেয়ে, নারী-পুরুষ সবাইকে পর্যাপ্ত তথ্য ও সেবা সরবরাহের মাধ্যমে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের বিষয়ে কাজ করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশে এখনো গর্ভধারণ ও প্রসবকালীন প্রতিরোধমূলক পরিস্থিতি না থাকার কারণে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী মৃত্যুবরণ করেন। ইউএনএফপিএ দক্ষ ধাত্রীর (মিডওয়াইফ) মাধ্যমে সন্তান প্রসবের সংখ্যা বাড়ানো, অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ প্রদান ও নতুন ধাত্রী নিয়োগ করার বিষয়ে কাজ করছে। উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন ওই ধাত্রীরা নারীকে মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা দিতে সক্ষম। প্রসবকালীন জটিলতা কমানোর মাধ্যমে তাঁরা মাতৃত্বকালীন মৃত্যুহার কমিয়ে আনায় অবদান রাখছেন। যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য সরবরাহ এবং পরিবার–পরিকল্পনা সেবায় সহজে প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে ইউএনএফপিএ বাংলাদেশের নারী ও পুরুষকে তাঁদের পছন্দ অনুযায়ী পরিবার গড়তে এবং স্বাস্থ্যসেবা নিতে সহযোগিতা করছে। যৌন, প্রজনন এবং মাতৃ ও নবজাতকের স্বাস্থ্যসেবায় সবার প্রবেশাধিকার অর্জনে মিডওয়াইফরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে তাঁরা অপরিহার্য হয়ে উঠবেন। মিডওয়াইফদের পেছনে বিনিয়োগকে তাই প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় ‘সর্বোত্তম বিনিয়োগ’ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, প্রশিক্ষিত মিডওয়াইফরা নারী ও নবজাতকের প্রয়োজনীয় সেবার ৮৭ শতাংশ প্রদানে সক্ষম। জীবন বাঁচানো ও অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের খরচ বিবেচনায় নিয়ে মিডওয়াইফদের প্রশিক্ষণে বিনিয়োগ করলে এবং পরবর্তী পর্যায়ে কমিউনিটি-ভিত্তিক সেবায় তাঁদের নিয়োগ করলে ওই বিনিয়োগের ১৬ গুণ পর্যন্ত ফেরত পাওয়া সম্ভব। একদম নতুন এই পেশা-কাঠামোয় নিবন্ধিত মিডওয়াইফদের নেতৃত্বে একটি নতুন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ইউএনএফপিএ এ সংক্রান্ত কর্মসূচিতে সহায়তা দিয়ে আসছে।

বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগই হচ্ছে তরুণ। দেশের সম্ভাবনার জানালার একেবারে সম্মুখভাগে বিশাল জনগোষ্ঠীর ওই তরুণেরা। যদি এখনই সঠিক বিনিয়োগ করা সম্ভব হয়, তবে এই জনগোষ্ঠীকে একটি গুরুত্বপূর্ণ জনমিতিক সুফলে পরিণত করা যেতে পারে। যদি এই কিশোর ও যুবাদের, বিশেষ করে মেয়েদের ভালো মানের শিক্ষা, প্রজনন-স্বাস্থ্যসেবা এবং ব্যবহারিক জীবন দক্ষতাসহ সমন্বিত শিক্ষা দেওয়া যায়, তবে আশা করা যায়, তারা বাংলাদেশের উন্নয়নে চালিকাশক্তিতে পরিণত হবে। যদিও বর্তমানে বাংলাদেশের সামনে বাস্তবতা হলো, ৪৭ শতাংশ মেয়ে মাধ্যমিক পর্যায় থেকে ঝরে পড়ে। উচ্চমাধ্যমিকের পরের পর্যায়ের শিক্ষায় তিন ভাগের দুই ভাগ শিক্ষার্থীই হচ্ছে ছেলে। আর মাত্র এক-তৃতীয়াংশ নারী আনুষ্ঠানিক শ্রমশক্তিতে সক্রিয়। মেয়েদের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা হলো তারা ‘শিশুবিয়ের’ শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশে ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী ৫৯ শতাংশ নারীর বিয়ে হয় ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই (বিডিএইচএস ২০১৪), এর ফলে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশেই বয়ঃসন্ধিকালীন প্রজনন হার সবচেয়ে বেশি। তাই বিদ্যালয়ে যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে সমন্বিত শিক্ষা প্রদান ও এর বাইরে থাকা কিশোর-কিশোরীর কাছে বয়ঃসন্ধি ক্লাবের মাধ্যমে সরাসরি বিষয়টি তুলে ধরতে বাংলাদেশ সরকারকে ইউএনএফপিএ কারিগরি সহায়তা প্রদান করছে। এ ছাড়া কিশোর ও যুবাদের শিশু বয়সে বিয়ে এবং তাদের যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্যের ঝুঁকির বিষয়ে সমাজের সর্বস্তরে জানাতে, বিশেষ করে বাবা-মা, অভিভাবক, শিক্ষক ও সমাজের নেতাদের জানাতে ইউএনএফপিএ সরকারের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

বিশ্বে সবচেয়ে বেশি দুর্যোগের ঝুঁকিতে থাকা দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। এর অর্থ, দুর্যোগ এলে দ্রুত ও কার্যকরভাবে সাড়া দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এ কারণে প্রসব বিষয়ে হাতের কাছে মর্যাদাপূর্ণ ও নিরাপদ সরঞ্জামের একটি মজুত তাৎক্ষণিকভাবে সরবরাহের জন্য প্রস্তুত থাকা প্রয়োজন। একই সঙ্গে নিরাপদ প্রসব নিশ্চিত করতে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত মিডওয়াইফের সেবা নিশ্চিত করাও প্রয়োজন, যাতে সবচেয়ে বিরূপ পরিবেশেও অন্তঃসত্ত্বা নারীরা নিরাপদে সন্তান জন্ম দিতে পারেন। পাশাপাশি দুর্যোগের ঝুঁকিতে থাকা মেয়ে ও নারীরা কোনো নির্যাতনের শিকার হলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়, এই লক্ষ্যে ইউএনএফপিএ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা করে আসছে।