সে আমার ছোট বোন, বড় আদরের ছোট বোন...
রামিম আরমান বড় দুষ্ট আছিল। তাহার দুষ্টামির সীমা-পরিসীমা পরিমাপ করে সাধ্য কার? কেহ বলিত, এই দুষ্টামির হিসাব-নিকাশ করিবার জন্য বিদেশ হইতে গবেষক আনিতে হইবে। কেহ বলিত, উন্নত উচিত শিক্ষা না হইলে পর এই দুষ্টামি কমিবে না। লোকে যাহাই বলুক না কেন, রামিম আরমানের দুষ্টামি দিনে দিনে দেনার মতোই বাড়িতে লাগিল। বাড়ি ছাড়িয়া তাহা মহল্লা, মহল্লা ছাড়াইয়া তাহা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত গড়াইতে লাগিল। পরীক্ষার হলে পরীক্ষা দিতে বসিয়া সে এর ঘাড়ে উঁকি দিয়া, ওর ঘাড়ে চাপিয়া প্রশ্নের উত্তর বাহির করিতে আরম্ভ করিল। শিক্ষকেরা আসিয়া কিছু বলিতে ধরিলে রামিম বলিত, ‘চুপ! খেলা চলিবে!’
পথিমধ্যে কাহারও সহিত দুই-চারবার উচ্চবাচ্যে লিপ্ত না হইলে তাহার বাড়ি ফেরা হইত না। আর সেই উচ্চবাচ্যের মধ্যেও রামিম চিৎকার করিয়া বলিত, ‘খেলা চলিবে! খেলা চলিবে!’
রামিম আরমান কিছুদিনের মধ্যেই ‘খেলা চলিবে রামিম’ বলিয়া খ্যাত হইয়া পড়িল। বাহিরে যা হইতেছিল তা হইতেছিল কিন্তু বাড়িতেও তাহার দুষ্টামির অন্ত ছিল না। বিশেষত বাড়ির সর্বকনিষ্ঠ যাইবির সহিত তাহার তিল হইতে তাল—সর্ব বিষয়ে লাগিয়া রহিত। যাইবির পছন্দ ইলিশ মাছ। রামিম তাহা জানিত। আর জানিত দেখিয়াই বাড়িতে ইলিশ আসিলেই রামিম তাহাকে জাটকা বলিয়া রাষ্ট্র করিত। আর জাটকা খাওয়া যে কী পরিমাণ অপকর্ম তাহা ফলাও করিয়া বলিয়া বেড়াইত। শেষে বাড়িতে ইলিশ আসাই বন্ধ হইয়া গেল। শুধু তাহাই নহে, যাইবির সাজসজ্জা-সেলফি সমস্ত কিছুতেই রামিমের আপত্তি আর আপত্তি। এমনকি যাইবি তাহার ফেসবুকে কোনো একটা স্ট্যাটাস দিয়াও শান্তি পাইত না। রামিম গিয়া সেখানে কমেন্ট করিত, ‘খেলা চলিবে! খেলা চলিবেই চলিবে!’
যাইবির আর সহ্য হইল না। সে বড় বোনের নিকট গিয়া নালিশ করিতে বাধ্য হইল। বড় বোন বলিয়া কথা। তিনি ধৈর্য ধরিতে বলিলেন। ঈদ-পরবর্তী যে আন্দোলন তাহারও তো যবনিকা আছে; এত বড় যে ওবামা, তাঁহারও তো দিন ফুরাইয়াছে। তাহা হইলে রামিমের দুষ্টামির সমাপ্তি হইবে না কেন?
দিন যায়। কিন্তু দুষ্টামির সমাপ্তি না হইয়া বরং তাহা আরও বাড়িতেই থাকে। যাইবির সহিত তাহার যেন আর বনিতেই চাহে না। উঠিতে-বসিতে-নাইতে-খাইতে তাহারা নিয়মিত ঝগড়াই করিয়া চলে। হায়, ঝগড়া! হায়, বিবাদ! এমন করিলে যে সংসারে তিষ্টানো দায়, তাহা যেন রামিম বুঝিতেই চাহে না!
যাইবি টেলিভিশন দেখিতে বসিলে রামিম আসিয়া তাহার রিমোট ছিনাইয়া লয়। বলে, ‘খেলা চলিবে!’ অতঃপর সে কোনো এক স্পোর্টস চ্যানেল ছাড়িয়া রেসলিং নামক অদ্ভুত এক খেলা দেখিতে থাকে। যাইবি শক্ত মেয়ে বলিয়া কাঁদিতে পারে না। কিন্তু তাহার দুঃখ বড় বোনের হৃদয়কেও ব্যথিত করে।
ইত্যবসরে বাড়িতে মেহমান আসিবার সময় উপস্থিত। অথচ তাহা হইলেই বা কী, রামিম এহেন অনুষ্ঠান নিয়া বিন্দুমাত্র চিন্তিত নহে। এই বাড়ির ভাবমূর্তি তাহাকে কিছুতেই বিচলিত করে না। না পারিয়া বড় বোন রামিম আর যাইবিকে ডাকিয়া একত্রে বসাইয়া কঠিন কঠিন কিছু কথা শুনাইয়া দিলেন। রামিমকে বলিলেন, ‘আজ হইতে যদি তোমার দুষ্টামি বন্ধ না হয় তাহা হইলে পকেটমানি বন্ধ।’ তাহাতে রামিম বিন্দু পরিমাণ বিচলিত হইল না অবশ্য। এরপর তাহাকে আরও কিছু ভীতি দেখানো হইল। বলা হইল, তাহার বিশ্ববিদ্যালয় এবং ফেসবুক-টুইটার-ইন্সটাগ্রামসহ যাহা কিছু সামাজিক ও অসামাজিক ব্যাপার রহিয়াছে সকলই বন্ধ করিয়া দেওয়া হইবে। রামিম তাহাতেও বিচলিত হইল না। বড় বোন প্রমাদ গুনিলেন। এখন আর কীইবা করিবার আছে? তবু শেষ চেষ্টা হিসাবে বলিলেন, ‘ভাই রামিম, একটা কথা কান খুলিয়া শুনিয়া রাখো, যদি তুমি যাইবির সহিত এইসব দুষ্টামি বন্ধ না করিতে ইচ্ছুক হও তাহা হইলে তোমার “খেলা হইবে” “খেলা হইবে” ইহা বলাও বন্ধ করিতে হইবে! এখন বিবেচনা তোমার। তুমি কী করিবে?’
বড় বোন চলিয়া গেলেন। রামিম পড়িল সংকটে। এত দিনের সাধনার সংলাপ ‘খেলা হইবে’ আর বলিতে পারিবে না দেখিয়া সে যাইবিকে এই প্রথম বোন বলিয়া সম্বোধন করিয়া গাহিয়া উঠিল, ‘সে আমার ছোট বোন, বড় আদরের ছোট বোন…’
কিন্তু পরের লাইন কী তাহা কিছুতেই তাহার মনে পড়িল না! শুধু খেলা চলিবে শব্দ দুখানি তাহার মাথার ভিতর ঘুরিতে থাকিল।
পাদটীকা: সাধু ভাষায় রচিত এই গল্পটির সমস্ত চরিত্র ও ঘটনাও সাধু এবং অবশ্যই কাল্পনিক।