সেই ‘জয়ী মায়ের’ সঙ্গে আবার দেখা

জয়ী মায়ের বিজয়ী সন্তান।

এটি ২০০৯ সালের ৩ জুন প্রকাশিত ‘নারীমঞ্চ’–এর মূল রচনার শিরোনাম। এই জয়ী মায়ের নাম ডা. লীডি হক। আর বিজয়ী ছেলের নাম আদিল হক। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন একজন মানুষ তিনি। সব বাধা পেরিয়ে নিজেকে একজন দক্ষ শিল্পী হিসেবে গড়ে তুলেছেন আদিল। নারীমঞ্চে প্রতিবেদন প্রকাশের এক যুগ পর জাতীয় জাদুঘরে এই মা-ছেলের দেখা পাই। ‘চিত্রকলা এবং অটিজম নিয়ে জীবনযাত্রা: বালক রাজা আদিল হক’ শীর্ষক প্রদর্শনীতে।

২০০৯ সালের ৩ জুন প্রকাশিত ‘নারীমঞ্চ’–এর মূল রচনায় মা লীডি হক ও ছেলে আদিলের গল্প

বিধিনিষেধের গৃহবন্দী সময়ে ‘বাংলাদেশের ফোক আর্ট’, ‘বাংলাদেশিদের জীবিকা’ ও ‘মিসরের রাজা তুতেনখামেনের সমাধির গুপ্তধন’ শীর্ষক তিনটি সিরিজের আওতায় অনেক ছবি এঁকেছেন আদিল। তার থেকে বাছাই ১১৫টি ছবি নিয়ে সাজানো হয়েছিল এই প্রদর্শনী। চলেছে ৩ থেকে ১০ জুন। প্রদর্শনী ঘুরে দেখা গেল মিসরের পিরামিড, রাজা তুতেনখামেন, ধনরত্নসহ তাঁর মমি, রহস্যময় দেবতা আমুন এবং মাতৃদেবী আইসিস, মিসরের রাজপ্রাসাদের পাখি, দেশটির দিন ও রাতের চিত্র এবং ঐতিহাসিক স্থাপনার ছবি।

আরও পড়ুন
ছেলে আদিল হকের সঙ্গে মা ডা. লীডি হক
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

আদিলের আঁকায় এত মিসরীয় অনুষঙ্গ কেন? এমন জিজ্ঞাসার জবাবে ডা. লীডি হক জানালেন, ‘ছয় বছর বয়সে ইতিহাস বইয়ে প্রাচীন মিসরের রাজা তুতেনখামেনের ছবি দেখে মিসরের প্রতি তার প্রবল আকর্ষণ তৈরি হয়। একপর্যায়ে নিজেকে ‘‘বয় কিং’’ বা বালক রাজা বলে পরিচয় দিত আদিল। এটা ছিল তুতেনখামেনের উপাধি। এই উপাধির ইতিবাচক প্ররোচনায় আমার বয় কিংয়ের এত সাফল্য।’ শুধু মিসরই নয়, তাঁর আকাঁর মধ্যে বাংলাদেশের ঐতিহ্যও তুলে এনেছেন আদিল। গরুর গাড়িতে করে কৃষকের পণ্য টানা, গরু দিয়ে হালচাষ, রান্নাঘরে বসে গ্রামীণ বধূর রান্না, ধান বোনা, সাপুড়ের বাঁশি বাজিয়ে সাপের খেলা দেখানো, কুমারের মাটির জিনিসপত্র তৈরি আদিলের আঁকাআঁকির বৈচিত্র্যকেই তুলে ধরেছে।

মা ডা. লীডি হকের ধৈর্য-নিষ্ঠা আর শ্রমের যোগফল আজকের আদিল। ছেলের ৯ মাস বয়সের সময় মা লীডি হক অনুভব করেন, ডাকলে অন্য সব শিশুর মতো সাড়া দেয় না আদিল। দুই বছর বয়সে নিশ্চিন্ত হন আদিল অটিস্টিক। এরপর শুরু হলো সংগ্রাম। সার্বক্ষণিক তদারকি। এক মুহূর্তের জন্যও হাল ছাড়েননি মা। সন্তানের পরিচর্যা, তাকে বড় করে তোলার সবচেয়ে পরিশ্রমের কাজটিই দিনের পর দিন নিষ্ঠার সঙ্গে করে গেছেন তিনি। আর সেই নিষ্ঠার ফল আজকের সফল চিত্রশিল্পী আদিল। কিন্তু আঁকাআঁকির জগতে আদিল এলেন কী করে? ‘ওর বয়স যখন সাত বছর, অস্থির, চঞ্চল, আক্রমণাত্মক আদিলকে কোনোভাবেই যখন ম্যানেজ করতে পারছিলাম না, তখন আমরা খেয়াল করলাম শুধু ছবি আঁকার সময় সে ধীরস্থির থাকে। এটা ওর একটা ধ্যান,’ বললেন মা লীডি হক। তাঁর ভালো লাগার জগতে বিচরণে পদে পদে সাহায্য করেন মা লীডি।

আরও পড়ুন
প্রদর্শনীতে আদিল হকের চিত্রকর্ম
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

শুধু নিজের সন্তানই নন, ডা. লীডি হকের তত্ত্বাবধানে আছে আরও কয়েকজন অটিস্টিক শিশু। নিজ জগৎটাকে খুঁজে বের করতে তাদের সাহায্য করেছেন তিনি। তাঁর কাছ থেকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ, সহযোগিতা পাচ্ছেন অটিস্টিক সন্তানের অভিভাবকেরা।

প্রায় প্রতিদিনই সাধারণ দর্শকের পাশাপাশি প্রদর্শনী ঘুরে ঘুরে দেখেছে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু-কিশোরেরা। বিশাল গ্যালারি ঘুরে ঘুরে আদিল হকের এত এত চিত্রকর্ম দেখে সবাই যখন বিস্মিত, ডা. লীডি হকের মুখে তখন প্রশান্তির হাসি।