স্মৃতির অলিন্দে সায়মন ড্রিং

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে নানাভাবে কাজ করা বিদেশি বন্ধুদের সরকারিভাবে সম্মাননা জানানোর অনুষ্ঠানটি ছিল ২০১২ সালের মার্চে। ‘মুক্তিযুদ্ধের সম্মাননা ও মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ প্রদানের সে অনুষ্ঠান আর কিছু বিদেশি বন্ধুর কথা নিয়ে বিশেষ আয়োজন ছিল প্রথম আলোর শনিবারের ক্রোড়পত্র ছুটির দিনেতে। সদ্যপ্রয়াত সায়মন ড্রিংককে নিয়েও একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল তখন। ২০১২ সালের ৩১ মার্চ প্রকাশিত সেই লেখাটি এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হলো।

সায়মন ড্রিং, ২০১২ছবি: খালেদ সরকার

‘তোমার লেখার আইডিয়াটা আসলে কী?’

প্রশ্নকর্তা দুঁদে সাংবাদিক সায়মন ড্রিং স্বয়ং। উত্তরটা মোটামুটি গোছানো ছিল। তার পরও সাইমনের চোখের দিকে তাকিয়ে ক্ষণিকের জন্য বুক কাঁপল। তিনি মুখে হাসি টেনে উত্তর শুনলেন। তারপর বললেন, ‘এখন কিন্তু আমি কথা বলতে পারব না।’ বলতে বলতে উত্তর তার পুরোপুরি মনঃপূত হয়েছে কি না, বোঝার আগেই সায়মন উঠে দাঁড়ালেন। নাছোড়বান্দা সাংবাদিকদের মতো আমরাও ছুটলাম তাঁর পিছু পিছু। ঘটনাস্থল হোটেল রূপসী বাংলার (বর্তমানে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল) লবি। সায়মনের ডাক পড়েছে ক্যামেরার সামনে। চলছে তাঁকে নিয়ে তথ্যচিত্রের নির্মাণকাজ। সায়মন ঘুরছেন হোটেলের লবি থেকে পেছনের অলিগলি। ক্যামেরা অনুসরণ করে চলেছে তাঁকে। এখনকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের পেছনে দুটো ভবনের মাঝের সরু জায়গাটায় এসে থামলেন সায়মন। প্রায় ৪০ বছর আগের ভয়াবহ এক দিনে এই রাস্তাটা দিয়েই হোটেল থেকে আক্রান্ত ঢাকার রাজপথে বেরিয়ে গিয়েছিলেন টেলিগ্রাফ পত্রিকার ২৭ বছর বয়সী দুঃসাহসী তরুণ সাংবাদিক সায়মন ড্রিং। দেখেছিলেন ইতিহাসের জঘন্যতম এক গণহত্যার ভয়াবহতা। সঙ্গী আক্কু চৌধুরীকে সায়মন বর্ণনা করছিলেন সেসব মুহূর্ত। ক্যামেরা তাঁকে অনুসরণ করতে করতে গেল হোটেল রূপসী বাংলার ছাদ অবধি। এই ছাদেই সেদিন পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের চোখ এড়িয়ে লুকিয়ে ছিলেন সায়মন ড্রিং।

সেদিনের মতো শুটিং শেষ। সায়মন রূপসী বাংলার লবি ক্যাফেতে বসেছেন গা এলিয়ে। বাংলাদেশ-পাকিস্তান এশিয়া কাপের ফাইনাল ম্যাচ চলছে। পাকিস্তানের একেকটা উইকেট পড়ছে আর সায়মনের মুখের হাসি বিস্তৃত হচ্ছে। এর মধ্যেই সায়মনের আশপাশে ঘুরঘুর করছি। দেখে সায়মন নিজেই ডেকে বসালেন পাশের চেয়ারে। তারপর আলাপ শুরু হলো।

একাত্তর সালের ২৫ মার্চ রাতে ছাদে লুকিয়ে থাকার সময়টা আসলে কেমন ছিল?

‘সেদিন একজন মেজর এসে আমাকে বলেছিলেন হোটেল ছাড়তে। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এটা কি কোনো ‘নিদের্শ?’ তিনি বলেছিলেন, ‘এটি নির্দেশ নয়।’ আমি তাঁকে বললাম, তাহলে আমি যদি হোটেল না ছাড়ি তাহলে কী ঘটবে? ‘এটা তোমার ব্যাপার। কিন্তু তোমার নিরাপত্তার জন্যই তোমার হোটেল ছাড়াটা জরুরি।’ আমি ছাদে লুকিয়েছিলাম। নিচে তাকিয়ে দেখছিলাম সব সাংবাদিককে ট্রাকে উঠিয়ে বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। রাত নয়টার মতো বাজে তখন। মনে হচ্ছিল যেকোনো মুহূর্তে আমি ধরা পড়ে যাব। ফরাসি আলোকচিত্রী মিশেল হোটেলের অন্য জায়গায় ছিল। ট্রাক চলে যাওয়ার আরও এক ঘণ্টা পর চুপিসারে আমি নিচে নেমে আসি। আরেকটা মজার কথা, ওই মেজরের সঙ্গে আমার আবারও দেখা হয়েছিল। ১৯৭২ সালে ক্যান্টনমেন্টে। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘মেজর, সেদিন রাতে আমি ধরা পড়ে গেলে আমার কী হতো?’ তিনি বলেছিলেন, ‘তুমি মারা পড়তে পারতে।’

চল্লিশ বছর অনেক লম্বা সময়। এত দিনে একাধিকবার নাম পাল্টেছে ইন্টারকন্টিনেন্টাল। হোটেল ভবনেও পরিবর্তন এসেছে অনেক। সায়মনের অভিজ্ঞতা কেমন?

‘হ্যাঁ এটা ঠিক, ৪০ বছর অনেক লম্বা সময়। সবকিছু মনে থাকার কথা নয়। এর মধ্যে হোটেলের অনেক কিছু বদলেছে। তার পরও সেই গন্ধ আর চারপাশের আবহটা মনে হলো এখনো আগের মতোই আছে। এসব জায়গায় আমার স্মৃতিগুলোও অনেক বেশি পোক্ত।’

আলাপ এগিয়ে চলে। এর মধ্যে গুটিয়ে গেছে পাকিস্তানের ইনিংস। চারদিকে ক্রিকেটের উত্তেজনা। বাংলাদেশের আজন্ম বন্ধু খ্যাতিমান ব্রিটিশ সাংবাদিক সায়মন ড্রিংয়ের কাছে আরও একটা প্রশ্ন।

২৫ মার্চের রাতে আপনি যে জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন, সেটি কি শুধুই পেশাগত তাগিদ? নাকি এর সঙ্গে আবেগও জড়িত ছিল।

প্রশ্নটা খানিক নাড়াচাড়া করলেন যেন সায়মন। তারপর মুখ খুললেন।

‘দেখো, আমার পুরো সাংবাদিক জীবনে আমি ২২টির মতো যুদ্ধ-বিপ্লব, বিদ্রোহ দেখেছি। সাইপ্রাসে রিপোর্ট করতে গিয়ে আমি আহতও হয়েছিলাম। একাত্তর সালের ঘটনা নানা দিক থেকে বিভিন্নভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পাকিস্তানিরা চাইছিল ২৫ মার্চ রাতের ঘটনা পুরোপুরি গোপন রাখতে। এর কোনো প্রমাণ তারা রাখতে রাজি ছিল না। বিদেশিদের কাছে তো নয়ই। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল তারা যেটা লুকানোর চেষ্টা করছিল, সেটা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা। আর সত্যি বলতে আবেগের একটা ব্যাপার ছিলই। কারণ তত দিনে এখানকার অনেকের সঙ্গে আমার পরিচয় ও সখ্য হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এই মানুষগুলোর ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে, এ নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন ছিলাম। ওদের ওপর এমন কিছু হচ্ছে, যেটা চরম অন্যায়। এই চিন্তা আমাকে পীড়িত করছিল। আমার মনে হয়েছিল এটা হওয়া উচিত নয়। সারাক্ষণ মনে হচ্ছিল আমার কিছু একটা করতে হবে। মানুষের দুর্ভোগ দেখে আমি কষ্ট পাচ্ছিলাম। সাংবাদিকও তো আসলে একজন রক্ত-মাংসের মানুষ। সে যা চোখের সামনে দেখছে, সেটা তাকে তাড়িত করবেই। বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে আবেগ যদি খানিকটা যুক্তও হয়, আমার মনে হয় না সেটা খারাপ কিছু।’

আলাপের শেষ পর্যায়ে এসে জানা হলো সায়মন ড্রিং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একজন মুগ্ধ ভক্ত। বাংলায় নয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলি তিনি পড়েছেন ইংরেজিতে। সেই কিশোর বয়সেই তাঁকে আকর্ষণ করেছিলেন রবিঠাকুর। ইংল্যান্ডের নরফোকে কেটেছে শৈশব। মোটে ১৬ বছর বয়সে পালিয়ে চলে এসেছিলেন ভারতবর্ষে।

রবীন্দ্রনাথের লেখা আপনার প্রিয় কবিতা কোনটা? সায়মনকে শেষ প্রশ্ন।

সায়মনের জবাব, ‘ওই যে কবিতাটা আছে না? “ইউ আর মাই কুইন। আই অ্যাম দ্য গার্ডেনার”।’

সঙ্গে থাকা নির্মাতা পারভেজ চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি আক্কু চৌধুরী আমরা কেউই ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না সায়মন ঠিক কোন কবিতার কথা বলছেন। অতঃপর রাত ১০টার দিকে পারভেজ চৌধুরীর ফোন।

‘ পেয়েছি পেয়েছি। সায়মনের প্রিয় কবিতাটার নাম—“আবেদন”।’