হঠাৎ নিঃস্ব

একেবারেই দিশেহারা শাহেদ আলম। কয়েক দিন আগে ঢাকার গুলশানের ডিএনসিসি মার্কেটে আগুন লেগে পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে শাহেদ আলমের দোকান। ‘কোনো দিন ভাবতে পারিনি এ রকম কোনো ঘটনা আমার জীবনে ঘটবে। কিন্তু হঠাৎ করে সবকিছু শেষ হয়ে গেছে।’ বলেন শাহেদ আলম। ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় শুধু কি তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পুড়েছে? সঙ্গে পুড়ে গেছে দোকান নিয়ে দেখা তাঁর স্বপ্নও। আর্থিক ক্ষতি তো আছেই। তবে আশার কথা, দিশেহারা শাহেদের পাশে দাঁড়িয়েছে তাঁর পরিবার। নিজের জমানো কিছু অর্থ ও পরিবারের অন্যদের সহায়তায় আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখতে চান শাহেদ।
প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনা থেকে শুরু করে আগুন লেগে যাওয়া, আততায়ীর আঘাত, সংঘর্ষ, দালান ভেঙে পড়া বা হামলায় নিঃস্ব হচ্ছেন অনেক মানুষ। কেউ পরিবারের সবাইকে হারিয়ে পারিবারিকভাবে; কেউবা দুর্ঘটনার শিকার হয়ে আর্থিক ও মানসিকভাবে হয়ে পড়ছেন একেবারেই অসহায়। মানুষের মন মেনে নিতে পারে না আকস্মিক এমন আঘাত। ফলে মানসিকভাবেও দুর্বল হয়ে পড়েন সবাই। কিন্তু তারপরও মানুষকে ঘুরে দাঁড়াতে হয়। আর মানুষই পারে ঘুরে দাঁড়াতে।
বিপদ বলে-কয়ে আসে না—কথাটি খুবই পরিচিত এবং বাস্তব সত্য। বিষয়টি যত তাড়াতাড়ি মেনে নেওয়া যায় ততই ভালো। বিপদ যেকোনো সময় আসতে পারে—এ বিষয়টি মেনে নিতে পারলে বিপদ এলে সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, বিপদ কাটিয়ে উঠতে পারার বিষয়টি অনেকটা আর্থসামাজিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে। বিপদ যদি অর্থজনিত হয় এবং আগে থেকে সঞ্চিত অর্থ থাকে, তবে তা খুব দ্রুত কেটে যায় এবং সেটি দীর্ঘস্থায়ী বিপদে রূপ নেয় না। তেমনিভাবে যেকোনো ধরনের বিপদে আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে রাখলে নিঃস্ব হয়ে গেলেও সেই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি পাওয়া যায়।
বড় ধরনের বিপদ যে আসতে পারে, তার পূর্বপ্রস্তুতি থাকলে সেই বিপদ থেকে সহজেই রক্ষা পাওয়া যায়। বিপদে পারিবারিক সহায়তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যাদের পারিবারিক বন্ধন যত দৃঢ়, তাদের বিপদ এলে তা তত দ্রুত কেটে যায়। দৃঢ় বন্ধনের কারণে পরিবারের বিপদে পাশে এসে দাঁড়ায়। আর্থিক সাহায্য না দিতে পারলেও পরিবারের সবাই যদি মানসিক সহায়তা দেয়, তবে যেকোনো ধরনের বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার শক্তি পাওয়া যায়।
বর্তমান সময়ে সমাজের অন্য সদস্যদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ নেই বললেই চলে। কিন্তু বিপদে সবচেয়ে বেশি সহায়তা পাওয়া যায় সমাজ থেকে। সামাজিক বন্ধন যদি দৃঢ় করা যায়, তাহলে যেকোনো বিপদে সমাজ আপনার পাশে থাকবে। সে সময় কোনো বিপদ আর আপনার বিপদ মনে হবে না। তাই বিপদের প্রস্তুতি হিসেবে হোক বা সামাজিক দিক থেকে হোক, সমাজের সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখা জরুরি। অন্যের বিপদে এগিয়ে এলে নিজের বিপদেও সে এগিয়ে আসবে।
বিপদে অনেক সময়ই কাছের মানুষ পর হয়ে যাওয়ার একটি কথা প্রচলিত আছে। কিন্তু জমানো অর্থ কখনো পর হয় না। বিপদ যেকোনো সময় চলে আসতে পারে, যেকোনো সময় ঘটতে পারে দুর্ঘটনা বা বড় কোনো ক্ষতি। তাই সঞ্চয়ের বিকল্প নেই। আর্থিক অবস্থা যেমনই হোক, যদি নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী অর্থ সঞ্চয় করা যায়, তাহলে বিপদের সময় আর অসহায় হয়ে পড়তে হয় না।
>মানসিকভাবে শক্ত হতে হবে। বিপদ আসবেই, তাই বিপদে বিচলিত না হয়ে সাহসের সঙ্গে সেই বিপদকালীন অবস্থা ও বিপদের পরবর্তী অবস্থা পার করতে হবে। তাহলে যেকোনো ধরনের বিপদ সহজেই মোকাবিলা করা যাবে
মানসিকভাবে শক্ত হতে হবে। বিপদ আসবেই, তাই বিপদে বিচলিত না হয়ে সাহসের সঙ্গে সেই বিপদকালীন অবস্থা ও বিপদের পরবর্তী অবস্থা পার করতে হবে। তাহলে যেকোনো ধরনের বিপদ সহজেই মোকাবিলা করা যাবে।
কিছু আইনগত প্রস্তুতি নিয়ে রাখাও যেতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের চেয়ারম্যান বোরহান উদ্দীন খান জানালেন, একজন মানুষ যেকোনোভাবে নিঃস্ব হয়ে গেলে তাঁর ভরসার জায়গা হলো বিমা। সেটি হতে পারে জীবনবিমা, সম্পদবিমা বা যেকোনো ধরনের বিমা। বিপদের বিষয়টির পেছনে যদি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দায়ী থাকে, তবে সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করে ক্ষতিপূরণ দাবি করা যায়। পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে আইনগত বিষয়গুলো সম্পর্কে একটু জ্ঞান রাখা জরুরি।
আইনগতভাবে না পেলেও সামাজিক আইনের ওপর ভিত্তি করে সমাজের বড় বড় প্রতিষ্ঠান, সামাজিক গণ্যমান্য ব্যক্তি বা সমাজের অন্তর্গত বড় যেকোনো প্রতিষ্ঠান থেকে সহায়তা পাওয়া যায়। সঠিক তথ্য জানা থাকলে সরকারের পক্ষ থেকেও নিঃস্ব হয়ে যাওয়া ব্যক্তি সহায়তা পেতে পারেন।
বিপদের ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোতে সরকার দায়িত্ব নিলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই দায়িত্ব ব্যক্তির নিজের। কিন্তু ব্যক্তি নিজের নিরাপত্তা ও নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য বিমার সাহায্য নিতে পারেন। বিমা করে রাখলে যেকোনো ধরনের বিপদে নিঃস্ব বা অসহায় হয়ে পড়তে হয় না। ইসলামী ইনস্যুরেন্স বাংলাদেশ লিমিটেডের নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. রবিউল আওয়াল বললেন, যেকোনো সময় বিপদ এসে আপনার আর্থিক ও শারীরিক ক্ষতি করতে পারে। এ ক্ষেত্রে বিমা একটি বড় ভরসার জায়গা। এ ছাড়া বিমার মাধ্যমে সঞ্চয় নিরাপদ ও লাভজনক। পরিবারের জরুরি অবস্থা মোকাবিলায় জীবনবিমা সহায়ক। পরিবারের যে কারও অকালমৃত্যুতে অসহায় পরিবারের পাশে বিমা বন্ধুর মতো ভূমিকা পালন করে।
তবে বেশির ভাগ মানুষ বিমা সম্পর্কে সঠিক তথ্য না জেনে, সঠিকভাবে নিয়মকানুন না মেনে বিমা করে ফেলেন, ফলে অনেক সময় বিমা করা থাকলেও বিপদে সহায়তা পাওয়া যায় না। তাই এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। সচেতনভাবে বিমা করলে তা যেকোনো বিপদে সবচেয়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সুলতানা আলগিন জানালেন, যেকোনো বিপদের জন্য আগে থেকে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। ব্যবসার ক্ষেত্রে কোনো ক্ষতি হলে তার ক্ষতিপূরণ কীভাবে পাওয়া যেতে পারে আগে থেকে তা জেনে রাখতে হবে। যেকোনো ক্ষতির পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে রাখলে মানসিক শান্তি বজায় থাকে। মানসিকভাবে বেশি বিপর্যস্ত হলে সে ক্ষেত্রে সাইকোলজিক্যাল সাপোর্ট নেওয়া খুবই জরুরি। বড় ধরনের দুর্ঘটনায় গ্রুপ কাউন্সেলিং করা যেতে পারে। কারণ একই ধরনের বিপদে পড়া অনেকে শেয়ারিং করলে রোগী ট্রমা থেকে সহজেই বের হয়ে আসতে পারেন।
বিপদ আসার অপেক্ষা না করে শক্তিশালীভাবে বিপদের মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিতে পারলেই এবং মানসিকভাবে শক্ত থাকলেই যেকোনো বিপদ থেকে ঘুরে দাঁড়ানো যায়।