হঠাৎ নেমে এল বিপদ!

এ বছরের জানুয়ারিতেও দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে কক্সবাজার বেড়াতে গিয়েছিলেন ফারহানা-আবেদ (ছদ্মনাম) দম্পতি। কে তখন জানত এর কিছুদিন পরই সুখী এই পরিবারের জীবনে নেমে আসবে ঘোর অন্ধকার। পরের সপ্তাহে একদিন আবেদের অফিস থেকে ফোন—হঠাৎ করেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে অচেতন হয়ে পড়েছেন, সহকর্মীরা তাঁকে নিয়ে গেছেন হাসপাতালে। ফারহানা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে গেলেন। জানা গেল, মস্তিষ্কে বড় ধরনের রক্তক্ষরণ হয়েছে আবেদের। কী হয় কিছুই বলা যায় না। পরের কয়েকটি দিন কেটে যায় ঘোর অমানিশায়। আইসিইউ, এইচডিইউ ঘুরে আবেদ যখন বাড়ি ফিরে আসেন, তখন তাঁর শরীরের একটি অংশ অবশ, নিজে নিজে একা কোনো কাজই করতে পারেন না। এমনকি খাবারটাও চামচ দিয়ে মুখে তুলে দিতে হয়। তার চেয়েও বড় কথা— ধানমন্ডি এলাকার ছোট্ট হলেও সুন্দর ফ্ল্যাটটির ভাড়া, গাড়ি ও তার ড্রাইভার, ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়া বাচ্চাদের টিউশন ফি—আরও কত কি খরচ! কীভাবে এসব সামাল দেব! এসব চিন্তায় ফারহানা চোখে অন্ধকার দেখেন। দিশেহারা হয়ে পড়েন। হাসপাতালের খরচের প্রথম ধাক্কাটি সামাল দিতে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাই এগিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু নিত্যদিনের জীবনযাপনের খোঁজ রাখা কার পক্ষেই বা সম্ভব? ফারহানা বাড়ি বদল করে সস্তায় বাড়ি ভাড়া নিলেন মিরপুরে, গাড়ি বিক্রি করে দিলেন, বাচ্চাদেরও নামী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থেকে নাম কাটিয়ে ভর্তি করিয়ে দিলেন পাড়ার একটি স্কুলে।
কিন্তু এত চাপ, এত দুশ্চিন্তার মধ্যে যে খেয়ালই করা হয়নি—তার পাঁচ আর তেরো বছর বয়সের দুই সন্তান মানসিকভাবে কতটা পর্যুদস্ত হয়ে পড়ছে। বড় জন তো রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়ল; চিকিৎসক নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানালেন—ও কিছুই নয়; হতাশা, প্রচণ্ড বিষণ্নতা আর পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে কিছুতেই মেনে নিতে না পারায় মানসিক চাপে পড়ে গেছে।
মানুষের জীবনে কখন কী ঝড় আসে, কী তাণ্ডব ঘটে যায় তা আগে থেকে বোঝা যায় না কিছুই। সুন্দর উচ্ছল সুখী কোনো পরিবারেও হঠাৎ করে নেমে আসতে পারে গাঢ় অন্ধকার। আর এর জন্য আগে থেকে প্রস্তুত থাকা যায় না ঠিকই, কিন্তু কিছু কিছু ব্যাপারে আপৎকালীন প্রস্তুতি কি নিয়ে রাখা যায় না? কেননা অসুস্থতা, মৃত্যু, দুর্ঘটনা যে কারও জীবনেই যেকোনো সময় আঘাত হানতে পারে। জীবনযুদ্ধের খারাপ সময় আর সংকটের জন্যও তাই মানসিক প্রস্তুতি থাকা জরুরি।

যেমন, অনেক পরিবারে স্ত্রী ঘুণাক্ষরেই জানেন না যে স্বামীর টাকাপয়সা কোন ব্যাংকে কীভাবে গচ্ছিত আছে। কোনো ফিক্সড ডিপোজিট বা সঞ্চিত অর্থ আছে কি না বা কোথাও কোনো দেনা পাওনা আছে কি না। স্বামীর আকস্মিক অসুস্থতা বা অকাল মৃত্যুতে তাঁকে পড়ে যেতে হয় অকুল পাথারে । এসব বিষয় স্বামী-স্ত্রীর দুজনেরই গোচরে থাকাই উত্তম। এমনকি মাঝেমধ্যে অবসর সময়ে সংকট কীভাবে সামাল দেওয়া যায় তা নিয়েও আলোচনা করা যায়। গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র, চেকবই, রশিদ, দলিল ইত্যাদি কোথায় আছে, তা দুজনেরই পরিষ্কারভাবে জানা থাকা ভালো। দিন সব সময় একরকম নাও যেতে পারে। জীবনে উত্থান-পতন থাকতে পারে—এসব বিষয় শিশুদের অতটা বোঝানো সম্ভব নয়। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মত, যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে অটল থাকার মতো মানসিকতা নিয়েই বড় করা উচিত শিশুদের। এ জন্য চাই যথেষ্ট মানসিক শক্তি ও আত্মবিশ্বাস। আর তা শিশুরা অর্জন করবে পরিবারের কাছ থেকেই।
এর চেয়েও জরুরি—বিপদ-আপদের সময় সামাজিক সমর্থন। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহিত কামাল এ বিষয়ে বলেন, ‘বিপদের সময় আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীদের পাশে দাঁড়াতে হবে এক ধরনের ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে। সহানুভূতি না, সহমর্মিতা নিয়ে। “হায় হায়, এখন তোমাদের কী হবে!” কিংবা “আহা, পরিবারটা পথে নেমে গেল!”—এ ধরনের নেতিবাচক মন্তব্য না করে “আমরা তো পাশেই আছি, দেখো, সব ঠিক হয়ে যাবে।”—এ রকম ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করতে হবে। এতে করে শিশুরা নির্ভরতা ও আশ্বাস খুঁজে পাবে, হতবিহ্বল বা দিশেহারা হয়ে পড়বে না।’
দেখা যায়, আকস্মিক পারিবারিক বিপর্যয়ের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতি মেনে না নিতে পেরে শিশুরা হীনম্মন্যতায় ভোগে। ওরা সামাজিক মেলামেশা বন্ধ করে দেয়, সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। কখনো ওরা বিষণ্নতা, পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার বা এ ধরনের দীর্ঘমেয়াদি মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়। এসব সমস্যা থেকে উত্তরণে পরিবারের সদস্য তো বটেই, আশপাশের অন্যদেরও ভূমিকা রাখা উচিত।
বিপদ কারও বলেকয়ে আসে না। তাই বলে বিপদে ভরসা হারালে, সাহস হারালে চলবে না। তবে এর জন্য চাই যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস, দৃঢ় মনোবল। চোখ-কান খোলা রেখে একা একা পথচলা, সংকট সামাল দেওয়ার সাহস আর বিপদের দিনে সন্তানের কাছে সবচেয়ে বড় ও নিশ্চিন্ত নির্ভরতা হয়ে ওঠার মতো গুণ। আর এসব গুণের সবই কিন্তু চর্চার বিষয়। তাই ভয় পেলে, দিশা হারালে চলবে না বন্ধু—কেননা মানুষ তো কখনো হার মানে না।