হাত
কী চমত্কার দুটি হাত! উজ্জ্বল শ্যামলা রঙের পাতা আর লম্বা লম্বা আঙুলগুলো কোনো মহান শিল্পীর হাতকেই মনে করিয়ে দেয়। ব্রেসলেট বা হাতঘড়ি নেই সে হাতের কবজিতে, ছোট নখগুলো মেহেদি দিয়ে রাঙানো নয়, নেইলপলিশেরও কোনো আবরণ নেই—তার পরও অস্বাভাবিক এক দীপ্তি হাত দুটি থেকে যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে। বসেছিলাম ক্যাম্পাসের বকুলতলার শানবাঁধানো চত্বরে। জুলিয়া ও তার তিন বান্ধবী উল্টো দিকের বেঞ্চে বসে বাদাম চিবোচ্ছে আর গল্প করছে। আমি আড়চোখে বারবার তাকাচ্ছি জুলিয়ার হাতের দিকে। এভাবে একদৃষ্টে কোনো মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকা নিশ্চয়ই অভদ্রতা। কারও চোখে পড়ে গেলে লজ্জার ব্যাপার হবে। কিন্তু পারছি কই? ঘুরেফিরে বারবার জুলিয়ার হাতের দিকে চোখ চলে যাচ্ছে অজান্তে। হাতঘড়িতে ক্লাসের সময় হয়ে গেছে দেখে উঠে পড়লাম।ক্লাসরুমে বসেও ওর হাতের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকলাম। এ আমার এক আশ্চর্য অভ্যাস! মেয়েদের সৌন্দর্য নিরূপণের মাপকাঠি তাদের হাত। সুন্দর হাত যে মেয়ের আছে, তাকে আমার সুন্দরী রায় দিতে একবিন্দু দ্বিধা হয় না। আমি মেয়েদের সঙ্গে সবার আগে তাদের হাতই দেখি। অথচ জুলিয়ার ব্যাপারটা এত দিন আমার মনেই হয়নি! ওর সঙ্গে পরিচয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বছরে। চার বছরে যতটা সম্ভব ততটাই গভীর আমাদের বন্ধুত্ব। ক্যালেন্ডারের হিসাবে চার বছর, বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজটের গ্যাঁড়াকলে পড়ে সবেমাত্র তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষার অপেক্ষায় আছি।ভেবেছিলাম কারও চোখে পড়বে না, কিন্তু আহমেদ স্যার ঠিকই দেখলেন। বন্ধুভাবাপন্ন এবং ছাত্রমহলে দারুণ জনপ্রিয় সোহেল আহমেদ স্যারকে রসায়নের কম্পিউটার বলা হয়ে থাকে। রসায়নের মতো রসকষহীন জটিল বিষয় পড়ালেও তিনি অত্যন্ত রসিক। বললেন, ‘কী এত ভাবছ হে ভাবুক সম্রাট?’অপ্রস্তুতভাবে উত্তর দিলাম, সৌন্দর্যতত্ত্ব ও তার পরিচায়ক।‘রসায়নের ক্লাসে সৌন্দর্যতত্ত্ব! এতে খানিকটা হূদয়ের রসায়নও মিশে আছে নাকি?’ ক্লাসে হাসির রোল পড়ে গেল।‘জৈব ও অজৈব রসায়ন জানো। কিন্তু হূদয়ের রসায়নের “ক খ” তো জানো না। কীভাবে পাস করবে?’স্যারের বলাতেই যেন মনে হলো জুলিয়াকে আমি পছন্দ করি। অবচেতন মন ঠিকই জানত। আপনা-আপনি ঠোঁটে এসে গেল, কোনো সংশয় নেই যে আমি পরীক্ষায় পাস করব।‘কিন্তু তিনি তোমার পরীক্ষা নিতে আগ্রহী কি না, জানো?’ক্লাস শেষে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওকে বললাম, জুলি! তোমার হাতজোড়া কী সুন্দর! কোনো অলংকার পরো না কেন?‘তুমি জুলি বললে কেন?’ ঘাড় বাঁকিয়ে ও জিজ্ঞেস করল।জুলিয়া অনেক বড় হয়ে যায়। খোদ জুলিয়া রবার্টস এলেও তাকে আমি ‘জুলি’ সম্বোধন করব। ‘এত দিন তো দিব্যি জুলিয়া বলেছ। তার মানে আমাকে অপছন্দ করতে।’বাদ দাও তো, শোনো, তোমাকে একটা উপহার দিতে চাই। হাতে পরার মতো। নেবে? নাকি মুখে ছুড়ে মারবে?কিশোরী মেয়ের মতো ফিক করে হেসে ফেলল ও। ‘দিয়ো।’মাস্টার্স পড়ুয়া এক বড় ভাই ওকে চিঠি দিয়েছিল। সে চিঠি না পড়েই দলামোচড়া করে তার মুখে ছুড়ে মেরেছিল জুলিয়া গ্রেনেডের মতো। ছেলেটির ঝট করে বসে পড়া আর বজ্রাহত মুখোভঙ্গি মনে পড়ায় হাসি চেপে রাখা কষ্টকর হয়ে দাঁড়াল। আজ মঙ্গলবার। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তোমার উপহার পাবে। বলে বিদায় নিলাম।বৃহস্পতিবার সকালে নাশতার টেবিলে মাকে বললাম, হাজার চারেক টাকা দেবে?‘কী করবি?’এক বান্ধবীকে উপহার দিতে হবে।আগ্রহভরে মা জানতে চাইলেন, ‘মেয়েটা খুব সুন্দরী, তাই না রে?’তুমি যা ভাবছ মোটেও তা নয়। মায়ের মনোভাব টের পেয়ে বললাম, ঘটে আমার যথেষ্ট বুদ্ধি আছে, সুতরাং এখনই আমার দ্বারা প্রেম অসম্ভব।মায়ের ইচ্ছা মাস্টার্সের পর আমাকে পারিবারিক ব্যবসায় বসাবেন, তারপর বিয়ে। মায়ের মনে কষ্ট দেওয়ার কথা ভাবতেও পারি না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর মোটরসাইকেলের ভূত ঘাড়ে সওয়ার হয়েছিল আয়োজন করে। অনেক আবদার করেও যখন বাইক পেলাম না, তখন হুমকি দিলাম, বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। মা বললেন, ‘যাবি, যা। তোর মুখ চেয়ে জীবনে অনেক প্রলোভন এড়িয়ে গেছি। তোর কেমন লাগবে জানি না, তবে আমার নিদারুণ কষ্ট হবে।’ মায়ের অশ্রুসজল চোখ দেখেই ঘর ছেড়েছিলাম। ছয় ঘণ্টাও হয়নি আমি ফিরে এসেছি। মায়ের শীর্ণ দুখানা হাত ধরে মাফ চেয়েছি। ছোটবেলায় বাবা মারা গেলেন। মা দক্ষ হাতে কাপড়ের দোকানটা পরিচালনা করলেন। এখন আমরা তিনটি বেবিট্যাক্সি আর বড়বাজারে ৩০০ স্কয়ার ফুট দোকানের মালিক।মায়ের অমসৃণ আর শুকনো হাত থেকে টাকা নিলাম। এ হাত দিয়েই মা সংসার টিকিয়ে রেখেছেন। রাগ ঠান্ডা করে বাড়ি ফেরার পর এ হাত দিয়েই আমাকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। মেয়েদের হাত পর্যবেক্ষণ করে সৌন্দর্য নিরূপণের অভ্যাস এ হাতের প্রভাবেই গড়ে উঠেছে কি না, কে জানে।নিউমার্কেট থেকে তিন হাজার ২০০ টাকায় একটি ‘টাইটান’ ঘড়ি কিনলাম। জুলিয়ার বাসায় পৌঁছাতেই ওর মা ওর ঘরে নিয়ে আমাকে বসালেন। বললেন, ‘তুমি নিশ্চয়ই ফরহাদ। জুলিয়া তোমার আসার কথা বলেছিল।’ আমি ঘরের চারদিকে তাকালাম, সাধারণ আসবাব হলেও সুন্দরভাবে সাজানো-গোছানো। বুকশেলফ বলছে বিজ্ঞানের ছাত্রী হলেও সাহিত্যের প্রতি ও যথেষ্ট অনুরাগী। ভদ্রমহিলা বললেন, ‘নিজের মেয়ে বলে বলছি না। ও অত্যন্ত লক্ষ্মী।’ জানতে চাইলাম, ও কি বাসায় নেই? খানিকক্ষণ ইতস্তত করে তিনি বললেন, ‘কাল কাপড় ইস্ত্রি করতে গিয়ে ওর হাত অনেকটা পুড়ে গেছে। ও ক্লিনিকে আছে।’সন্ধানী ক্লিনিকের ২০৮ নম্বর রুমে ঢুকলাম, তখন এশার আজান হচ্ছে। বিছানার একপাশে ঘড়ির বাক্স রেখে ওর ম্লান মুখের দিকে তাকিয়ে চেয়ারে বসে থাকলাম। দীর্ঘ নীরবতার পর জুলিয়া মুখ খুলল, ‘কী কাণ্ড দেখো! তুমি আমার হাতের প্রশংসা করলে আর পরদিনই হাতটা পুড়ে গেল।’আমি নিশ্চয়ই অলক্ষুনে মানুষ—পরিবেশটা সহজ করার জন্য বললাম। কিছু না বলে কোলে রাখা হাতের দিকে তাকিয়ে থাকল ও। চেয়ার ছেড়ে বিছানার এক পাশে বসলাম। নরম সুরে বললাম, জুলি, দুর্ঘটনার আকস্মিকতা বা মানুষের সংস্কার, এর চেয়েও বড় এক সত্যের কাছে আমি পরাজিত।জিজ্ঞাসু নেত্রে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে জুলিয়া।ঘড়িটা বের করে ওর ব্যান্ডেজ বাঁধা বাঁ হাতে আলতোভাবে পরিয়ে দিলাম। ডান হাতটি দুই হাতে গভীর আবেগে চেপে ধরে ওর চোখে চোখ রাখলাম।সুমন সোনালী জুট মিলস, খুলনা।