হারানো মেয়ে ফিরল মায়ের বুকে

কাজির দেউড়ির ব্র্যাক কার্যালয়ে মা-মেয়ের মিলনের সেই ক্ষণ
কাজির দেউড়ির ব্র্যাক কার্যালয়ে মা-মেয়ের মিলনের সেই ক্ষণ

দিনটি ছিল গত ৪ মে। প্রতিদিনের মতো বিদ্যালয়ে যায় দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী বছর নয়ের জেসি (জান্নাতুল মাওয়া)। কিন্তু সেই যে গেল, ফেরার আর নাম নেই। বেলা ১১টায় ছুটির পর ফিরল পাশের বাসার দুই ছাত্রী। কিন্তু জেসি ফেরেনি। মা রিনা বেগম (২৯) প্রথমে খুব একটা আমলে নেননি। বেলা দুপুর গড়ানোর পর মায়ের মন দুলে ওঠে। ভর করে অজানা আশঙ্কা। বাসার কিছুটা দূরে মেয়ের স্কুল বায়েজিদের আলীনগরের আলোছায়া প্রাথমিক বিদ্যালয়েও গেলেন। না, সেখানেও নেই।

বাসায় ফিরে বড় বোনের সঙ্গে জেসি	। প্রথম আলো
বাসায় ফিরে বড় বোনের সঙ্গে জেসি । প্রথম আলো

কোথায় গেল মেয়ে? দুপুর গড়িয়ে বিকেল। শুরু হলো খোঁজাখুঁজি। কোথাও নেই বুকের ধন। সন্ধ্যা নামতেই পুরো এলাকা ও আশপাশে মাইকিং। কোনো খবর মিলল না। একবার এর বাসা তো আরেকবার ওর বাসা। কিছুতেই কিছু হলো না। পাগলের মতো হয়ে গেলেন রিনা আর তাঁর স্বামী জসিম উদ্দিন (৩৮)। তবে কি মেয়েকে কোনো ছেলেধরা নিয়ে গেছে, নাকি কেউ লুকিয়ে রেখেছে? কত কিছু না মনে আসছে রিনার। কিন্তু একটা প্রশ্নেরও উত্তর মিলছে না। নাওয়া-খাওয়া ভুলে গেলেন রিনা। ভাত মুখে উঠছে না—বারবার মনে হচ্ছে, ‘আমার মেয়েটা কী খাচ্ছে? আদৌ খেতে পারছে?’ দলা পাকানো জমাটবাঁধা কান্না উথলে ওঠে। ভাত আর গলায় নামে না। এর মধ্যে বায়েজিদ থানা ও র‌্যাব কার্যালয়ে সাধারণ ডায়েরি করেছেন। স্বামী-স্ত্রী চষে বেড়িয়েছেন রেলস্টশন, মার্কেটসহ সম্ভাব্য সব জায়গা। কোথাও নেই জেসি। এভাবে কেটে গেল প্রায় দুই মাস। অবশেষে চার তরুণের চেষ্টায় ২৭ জুন মায়ের বুকে ফিরল জেসি। কীভাবে কী হলো?
শিশুর কান্না...
বহদ্দারহাট সিটি করপোরেশন মার্কেটের দোকানি মোবাশ্বের আহমেদ (৪০) প্রতিদিনের মতো গত ২৫ জুন দোকান খুলতে গিয়ে থমকে দাঁড়ান। দেখেন, দোকানের সামনে বসে কাঁদছে এক মেয়ে। পরনে ময়লা কাপড়। মলিন মুখ। মোবাশ্বেরের মায়া লাগল। কাছে ডাকলেন। কাঁদছে কেন জিজ্ঞেস করতেই বলল, সে পথ হারিয়ে এখানে চলে এসেছে। নাম জানাল জেসি। বাড়ি কোথায় জানতে চাইলে সর্িঠক কিছু বলতে পারল না। শুধু এইটুকু বলল, বোনের নাম জান্নাতুল ফেরদৌস, মা রিনা, বাবা জসিম, বাড়ি আলীনগর। এভাবে তো আর ঠিকানা বের যায় না। তার পরও মোবাশ্বের দোকানের কর্মচারীকে বসিয়ে জেসিকে নিয়ে গেলেন দোকানের কাছে তাঁর বাসায়। মোবাশ্বেরের স্ত্রী বিবি আছিয়াও নানাভাবে চেষ্টা করে কোনো কিছু জানতে পারলেন না। এবার মহাফ্যাসাদে পড়লেন। শেষে না আবার শিশু অপহরণের দায়ে ফেঁসে যান। তার পরও তাঁরা হাল ছাড়েননি। খবর দিলেন মোবাশ্বেরের ভাগনি কলেজপড়ুয়া উম্মে আইমুন সুলতানাকে। সুলতানা এসে মেয়েটির সঙ্গে কথা বলার পর তাঁর বন্ধু পিপুন বড়ুয়া, জোবায়েদ খান ও মামুনুর রহমানকে খবর দিলেন। তাঁরা এসেই জট খুললেন।

মা-বাবার কাছে জেসিকে হস্তান্তর করা হচ্ছে
মা-বাবার কাছে জেসিকে হস্তান্তর করা হচ্ছে

চার তরুণের উদ্যোগ
চার তরুণ পিপুন বড়ুয়া, উম্মে আইমুন সুলতানা, জোবায়েদ খান ও মামুনুর রহমান। পিপুন পড়ছেন কম্পিউটার প্রোগ্রামিং নিয়ে। সুলতানা ও জোবায়েদ এইচএসসি পাস করেছে এবার। আর মামুন সদ্য ডিপ্লোমা শেষ করেছেন। চারজনের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে নানা সামাজিক কাজ করার মধ্য দিয়ে।
জেসির ব্যাপারটা সুলতানা প্রথমে জানান পিপুনকে। তিনি বাকি দুজনকে নিয়ে জেসির সঙ্গে কথা বলেন।
পিপুন বলেন, ‘সে প্রথম কথা বলছিল এলোমেলো। টানা অনেক দিন বাইরে থাকার কারণে বিধ্বস্ত। নিজের স্কুলের নাম ঠিকভাবে বলতে পারছিল না। অনেকক্ষণ কথা বলার পর বলল, তার বোন পড়ালেখা করে বায়েজিদের আলীনগর ব্র্যাক স্কুলে। সেটাই আমাদের সূত্র। এবার ব্র্যাকের একটি ফোন নম্বর জোগাড় করে সেখানে কল করলাম। সেটা ছিল কুমিল্লার একটি শাখা। তাঁরা দিলেন চট্টগ্রামের কাজীর দেউড়ি ব্র্যাক ট্রেনিং সেন্টারের কর্মকর্তা সানুর মোহাম্মদ রুবায়েতের নম্বর। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি খোঁজ নিতে থাকেন। পরে জানান আলীনগর ব্র্যাক স্কুলে পাওয়া গেছে তার বোনকে। তখনো নানা শঙ্কা কাজ করছিল। আদৌ ঠিকমতো সব হবে তো? তাঁরা আসল মা-বাবা তো? এর রকম হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। অবশেষে আমরা পারলাম।’
মিলনের সেই ক্ষণ
২৭ জুন। সন্ধ্যা সাতটা। কাজীর দেউড়ির ব্র্যাক কার্যালয়। আগে থেকেই নেওয়া হয় জেসিকে। রিনা বেগম আসার পর যখন জেসিকে তার সামনে নেওয়া হয় জড়িয়ে ধরে সেকি কান্না মা-মেয়ের। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিচ্ছেন। জেসিও মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। কাঁদছিলেন বাবা জসিম উদ্দিনও।
মা-মেয়ের এই মিলনের ক্ষণে চোখ মুছেছেন উপস্থিত সবাই। রিনা বেগম বলেন, ‘এই দুই মাস যে কীভাবে কেটেছে বলে বোঝাতে পারব না। কারও মুখে খাবার ওঠেনি ঠিকমতো। আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া। এই ভাইদের ঋণ তো কোনো দিন শোধ করতে পারব না।’
জেসি জানায়, সে সেদিন বিদ্যালয় থেকে বের হয়ে এক চানাচুরবিক্রেতার পিছু পিছু কিছুদূর আসার পথ হারিয়ে ফেলে। অনেককে বোঝাতে চেয়েছে তার ঠিকানা। কেউ আমলে নেয়নি তার কথা। শেষে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে বহদ্দারহাট। এর মধ্যে বিভিন্ন দোকান থেকে খুঁজে নিয়ে খাবার খেয়েছে। কখনো খেতে পেরেছে কখনো উপোস থেকেছে। রাতে দোকানের সামনেই ঘুমিয়ে পড়ত। মাথায় বালিশ হিসেবে দিত তার স্কুলব্যাগটি। কিন্তু একদিন সেটিও চুরি হয়ে গেল। এর মধ্যে তাকে অনেকে বাসায় নিয়ে গেছে কিছু খাবার দিয়ে কাজ করিয়ে আবার তাড়িয়ে দিয়েছে।
ব্র্যাক কার্যালয়ে মাকে পাওয়ার পর সেই যে জড়িয়ে ধরল আর ছাড়ে না জেসি। মায়ের কোলে মুখ লুকিয়ে বলে, আর কখনো চানাচুরওয়ালার পিছু নেব না।
ছোট্ট ঘরে খুশির রোশনাই
বায়েজিদের হিলভিউ এক নম্বর সড়কে আলীনগরে এক কামরার বাসায় রিনা ও জসিমের সংসার। জসিম পেশায় ইলেকট্রিশিয়ান। দুই মেয়ে এক ছেলে। জেসি মেজো। বড় বোন জান্নাতুল ফেরদৌস (১৩) ও ছোট ভাই জহিরুলের (২) সঙ্গে এখন আনন্দে কাটছে জেসির দিন। ছোট বোনকে পেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসের খুশি আর কে দেখে! মা রিনাও মেয়েকে আড়াল হতে দিচ্ছে না। বাবাও বাইরে থেকে এসেই প্রথমেই খোঁজ নিচ্ছেন মেয়ের।
জসিম বলেন, ‘জেসিকে পাওয়ার আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। দুই মাস হয়ে গেল, আর কী সম্ভব। কিন্তু আল্লাহ তা হতে দেয়নি। ফেরেশতাদের মাধ্যমে আমার মেয়েকে ফেরত দিয়েছে।’