হাসন রাজার অন্তঃপুরে

সুনামগঞ্জ জেলার প্রধান বাসস্ট্যান্ড থেকে মোটরসাইকেলে চেপে ১৫ মিনিট। পৌঁছে গেলাম হাসন রাজার বাড়ির প্রধান ফটকে।
সুরমা নদীর তীর ঘেঁষে বাড়িটির অবস্থান। উত্তরে তাকালে চোখে পড়ে সীমান্তের ওপারে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়। 

প্রবেশপথ
প্রবেশপথ

বাড়িতে একটি তিনতলা, একটি দোতলা ভবনসহ পুরোনো আমলের কাঠ ও টিনের চালার সাতটি ঘর। তিনতলা ভবনটির নিচতলার চারটি ঘর নিয়ে ‘হাসন রাজা মিউজিয়াম’। এই জাদুঘর দেখতেই গত ২৫ মে দুপুরে প্রথম আলোর সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি খলিলুর রহমানকে সঙ্গে করে এখানে আসা।

হাসন রাজার খড়ম রয়েছে জাদুঘরে। ছবি: প্রথম আলো
হাসন রাজার খড়ম রয়েছে জাদুঘরে। ছবি: প্রথম আলো

প্রধান ফটক পেরিয়ে কয়েক কদম হেঁটে জাদুঘরে ঢুকতেই অভ্যর্থনা জানালেন এটির প্রতিষ্ঠাতা ও তত্ত্বাবধায়ক সামারীন দেওয়ান। তিনি হাসন রাজার প্রপৌত্র।
জাদুঘরটিতে হাসন রাজার পোশাক-পরিচ্ছদ, তাঁর বংশপরিচয়, নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী, গানের পাণ্ডুলিপি, সংগীতচর্চায় ব্যবহার করা ঢোলসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র এবং নানা দুর্লভ উপকরণ।
অভ্যর্থনাকক্ষে একটি ফ্রেমে বাঁধা হাসন রাজার বংশপরিচয়ে চোখ আটকে গেল। এখান থেকে জানা গেল, সুরমা নদীতীরের তেঘরিয়া (লক্ষ্মণশ্রী) গ্রামে ১৮৫৪ সালের ২১ ডিসেম্বর জন্মেছিলেন এই সুরসাধক। বাবার নাম দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী। মায়ের নাম হুরমত জান বিবি। তাঁর পূর্বপুরুষেরা সনাতন ধর্মের ছিলেন। তাঁদের একজন বীরেন্দ্ররাম সিংহদেব মতান্তরে বাবু রায়চৌধুরী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।

হাসন রাজার বাদ্যযন্ত্র রয়েছে জাদুঘরে। ছবি: প্রথম আলো
হাসন রাজার বাদ্যযন্ত্র রয়েছে জাদুঘরে। ছবি: প্রথম আলো

তত্ত্বাবধায়ক সামারীন দেওয়ান বলেন, হাসন রাজার বাবা দেওয়ান আলী রাজা প্রভাবশালী জমিদার ছিলেন। সেই সূত্রে বাবার কাছ থেকে অঢেল ধনসম্পত্তি পেয়েছিলেন তিনি। তাঁদের জমিদারির অধীনে ছিল পাঁচ লাখ একর জমি। তাই যৌবনে তুমুল শৌখিন হয়ে ওঠেন। ১৮৭১ সালে বাবা ও ভাইদের মৃত্যু, তারপর ১৮৯৭ সালে ভয়াবহ ভূমিকম্পে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু দেখে ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকেন তিনি।
জাদুঘরের একটি শোকেসে রাখা হাসন রাজার পোশাক: একটি মখমলের আলখাল্লা, সাদা দুটি গেঞ্জি। জানা গেল, তিনি বেশির ভাগ সময় সাদাসিধা পোশাক পরতেন। সাদা ধুতি পরতেন লুঙ্গির মতো পেঁচিয়ে। গায়ে থাকত সাদা গেঞ্জি। পায়ে কাঠের খড়ম। উত্সব-অনুষ্ঠানে গেলে পরতেন জরির কারুকাজখচিত আলখাল্লা।
জাদুঘরের এক প্রান্তে হাসন রাজার চেয়ার-টেবিল পাওয়া গেল। এসবে বসেই তিনি গান ও কবিতা লিখতেন। কথিত আছে, গান রচনা করতে করতে তাঁর দুই চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ত।

হাসন রাজার পোশাক-পরিচ্ছদ রয়েছে জাদুঘরে। ছবি: প্রথম আলো
হাসন রাজার পোশাক-পরিচ্ছদ রয়েছে জাদুঘরে। ছবি: প্রথম আলো

জাদুঘরের ভেতরের একটি কক্ষে একটি বজরা (বড় নৌকা)। এই বজরায় চড়ে নৌবিহারে যেতেন এই খেয়ালি সুরসাধক। রম্য লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর এক প্রবন্ধে লিখেছেন, প্রতিবছর বিশেষ করে বর্ষাকালে নাচ-গানের ব্যবস্থাসহ নৌকায় চলে যেতেন হাসন রাজা। বজরায় বসে প্রচুর গান রচনা করেছেন। সেখানেই নৃত্য, বাদ্যযন্ত্রসহ সেগুলো গাওয়া হতো।
জাদুঘরের অপর একটি শোকেসে হাসন রাজার হাতে স্পর্শ পাওয়া দুটি ঢোল এবং একটি দোতারা রাখা। সামারীন দেওয়ান জানালেন, হাসন রাজা কখনো কখনো গান গাইতে গাইতে নিজের কোলের কাছে ঢোল টেনে নিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে যেতেন।
মাঝে মাঝে ঘোড়া ও হাতিতে চড়ে শিকার করতে যেতেন। জাদুঘরে রাখা হাতে আঁকা একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, তিনি হাতিতে চড়ে শিকারে যাচ্ছেন। জাদুঘরে তাঁর ব্যবহৃত দুধের পাত্র ও পানদানির দেখা মিলল। একটি আলমারিতে হাসন রাজার হাতের লেখা গানের পাণ্ডুলিপি। সামারীন দেওয়ান বলেন, অনেকের মতে হাসন রাজার রচিত মোট গানের সংখ্যা হাজারের বেশি। তবে এ পর্যন্ত ৭০০ গানের সন্ধান পাওয়া গেছে।

জাদুঘরে দেখা মেলে এমন অনেক দর্শনার্থীর
জাদুঘরে দেখা মেলে এমন অনেক দর্শনার্থীর

হাসন রাজার একটি জনপ্রিয় গান ‘নিশা লাগিল রে, বাঁকা দুই নয়নে নিশা লাগিল রে/ হাসন রাজা পিয়ারির প্রেমে মজিল রে’। এই গানটি জাদুঘরে বাজানো হচ্ছিল। এখানে পিয়ারি বলতে সৃষ্টিকর্তাকে বোঝানো হয়েছে। জানালেন সামারীন দেওয়ান।
জানা গেল, দেশ-বিদেশের পর্যটকেরা হাসন রাজার বাড়ি ও জাদুঘরে আসেন। প্রতিদিন ২৫০-৩০০ দর্শনার্থীর ভিড় হয়।
হাসন রাজা তাঁর ৬৮ বছরের জীবনকালে মাত্র একটি ছবি তুলেছিলেন। সেটা ১৯১৪ সালে কলকাতায়, মারা যাওয়ার আট বছর আগে। ছবির বিষয়ে সামারীন দেওয়ান বলেন, এই ছবিতে ষাটোর্ধ্ব হাসন রাজার দিকে তাকালে ৮০ বছরের বুড়োর মতো মনে হবে। আসলে হাসন রাজা আধ্যাত্মিক চিন্তাচেতনায় এবং জীবন-জগৎ নিয়ে এতটাই মগ্ন ছিলেন যে তাঁকে বয়সে ভারাক্রান্ত মনে হয়েছে। তিনি ১৯২২ সালে মারা যান।