৮ কেজি ওজনের বই আছে তাঁর লাইব্রেরিতে

নিজের বাড়িতে বিশাল লাইব্রেরি গড়ে তুলেছেন মাহমুদা খাতুন
ছবি: শহীদুল ইসলাম

মাহমুদা খাতুনের বাবা সরকারি শিশুসদনে চাকরি করতেন। বাড়ি ছিল নওগাঁর মান্দা উপজেলায়। ১৯৭২ সালের দিকে তিনি বদলি হয়ে রাজশাহীতে আসেন। ১৯৭৩ সালে বাবার কর্মসূত্রে রাজশাহীতে আসেন মাহমুদা খাতুন। তার দুই বছর পর থেকেই শিরোইলের বর্তমান ঠিকানায় রয়েছেন।

তখন তাঁর নানা (মায়ের চাচা) মমতাজ হোসেন রাজশাহী নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজ ও পরে রাজশাহী কলেজের গ্রন্থাগারিক ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাইব্রেরি সায়েন্সে স্নাতকোত্তর করেছিলেন। নানাকে লাইব্রেরিতে চাকরি করতে দেখে মাহমুদা খাতুনের স্বপ্নটা আরও বড় হয়। তিনি তখন লাইব্রেরি সায়েন্সে একটা কোর্স করেন। পরে গ্রন্থাগার বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন। একপর্যায়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে চাকরির সুযোগ পেলেন। সেই থেকে বইয়ের মধ্যে বসবাস শুরু হয়ে গেল। তাঁর তিন সন্তান তানভীর অপু, তারেক অণু ও কন্যা তাজনুভা তাজরীনেরও শৈশব কেটেছে মায়ের সঙ্গেই লাইব্রেরির পরিমণ্ডলে। তার মধ্যে তারেক অণু স্কুল ছুটি হলেই মায়ের কাছে লাইব্রেরিতে গিয়ে বই পড়তেন। ছোটবেলা থেকেই তাঁর বইয়ের প্রতি আকর্ষণ। দুই ছেলেই ফিনল্যান্ডপ্রবাসী। তাঁরা মাকে নিয়ে গেছেন পৃথিবীর নামকরা সব পাঠাগারে। তার মধ্যে মিসরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরে প্রাচীন বিশ্বের বৃহত্তম ও গুরুত্বপূর্ণ পাঠাগারের আদলে গড়ে তোলা লাইব্রেরিতেও গিয়েছেন মাহমুদা খাতুন। এ ছাড়া ফিনল্যান্ড, সুইডেন, এস্তোনিয়া ও ভারতে বিভিন্ন রাজ্যের ঐতিহ্যবাহী পাঠাগারেও গেছেন তিনি।

স্বপ্নের পাঠাগার

ছোটবেলায় মা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, ছেলে তারেক অণু সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য কাজ শুরু করেন। ২০১৭ সালে মা অবসরে যান। মায়ের পেনশনের টাকা দিয়ে বাসার আরেকটি ফ্লোর নির্মাণ করা হয়। সেখানেই নির্মাণ করা হয়েছে অত্যাধুনিক এই পাঠাগার।

পৃথিবীর ছয়টি মহাদেশ ঘুরে মায়ের পাঠাগারের জন্য বই সংগ্রহ করেছেন তারেক অণু, ওজনে যা দুই টন। দুর্লভ সেই সংগ্রহের বিশেষত্বই আলাদা। সংগ্রহের সবচেয়ে বৃহদাকৃতির বইটির ওজন আট কেজি। চিত্রকর রাফায়েলের জীবন ও সৃষ্টি নিয়ে বই। আছে চামড়ায় বাঁধাই করা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র ১৫ খণ্ডের প্রথম সংস্করণ।

নানা আকারের বই আছে মাহমুদা খাতুনের এই লাইব্রেরিতে
ছবি: শহীদুল ইসলাম

মানবসভ্যতার প্রাচীনতম নগরগুলো নিয়ে ১৯৭৩ সালে টাইম-লাইফ প্রকাশ করেছিল দ্য ফার্স্ট সিটিজ নামের অপূর্ব একটি বই। প্রায় ১২ হাজার বছর আগের নগরসভ্যতার পত্তন, এখনো কীভাবে তা আমাদের জীবনযাপনকে প্রভাবিত করে চলেছে, তার এক সচিত্র আলেখ্য এই গ্রন্থ। এখন সাজানো রয়েছে মাহমুদা খাতুনের পাঠাগারে।

৮ হাজার মিটার উঁচু শৃঙ্গ বিশ্বে আছেই ১৪টা। সব কটাই হিমালয়ে। সেই ১৪টি শৃঙ্গ নিয়ে অসাধারণ একটি বই অন টপ অব দ্য ওয়ার্ল্ড। ২২৮ পৃষ্ঠার বইখানার পাতা ওলটাতে ওলটাতে সেই ১৪ শৃঙ্গের ইতিহাস, ছবি, মানচিত্র জানতে এই পাঠাগারে যাওয়া যেতে পারে।

‘১৮৮৩ সালে কলকাতায় ব্রিটিশ ভারতের রাজধানীর চিড়িয়াখানায় ছয়টি জ্যান্ত রাক্ষস আনা হলো। ভরা হলো খাঁচায়। সারা কলকাতার বাবুরা এলেন টিকিট কেটে রাক্ষস দেখতে।’ এই ছয় রাক্ষস আসলে আন্দামান দ্বীপের অধিবাসী, আদিবাসী। আমরা কি জানি, আমাদের বাড়ির সামান্য নিচেই যে আন্দামান, সেখানে কী ভয়াবহ সব কাজ করে গেছে ঔপনিবেশিক প্রভুরা? আন্দামানে আদিম কলকাতায় রাক্ষস বইটির সত্যি কাহিনি পড়তে গিয়ে কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারবেন না।

তাকে তাকে সাজানো আছে ম্যাগাজিন ও বই
ছবি: শহীদুল ইসলাম

মাহমুদা খাতুনের পাঠাগারে থরে থরে সাজানো এমনই সব বিচিত্র সংগ্রহ। যেমন আছে চিত্রকলার ওপর খুবই মূল্যবান একটা সংগ্রহ, সেই সঙ্গে পুরাতত্ত্ববিষয়ক বই, হিমালয় ভ্রমণ নিয়ে থরে থরে বই বাংলা ও ইংরেজিতে। আছে আফ্রিকার জঙ্গলে অভিযান নিয়ে বই। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকার বিশাল সংগ্রহ আছে। এই লাইব্রেরির অন্যতম লক্ষ্য পাঠকদের জন্য নিসর্গ এবং ভ্রমণ নিয়ে বিশাল সংগ্রহ গড়ে তোলা।

লাইব্রেরির বই নিকট পরিচিতজনদের এখনই ইস্যু করা হচ্ছে। কাছের কেউ এসে বসে থেকে পড়তে পারছেন। মাহমুদা খাতুন বলেন, ‘ঠিকঠাক কর্মী পাওয়া যাচ্ছে না। তাই সর্বসাধারণের জন্য এই পাঠাগার এখনই উন্মুক্ত করে দেওয়া যাচ্ছে না। তবে পুরো বাড়িটিই রিসোর্টের মতো করে দেওয়ার পরিকল্পনা আছে, যেখানে বাইরে থেকে বইপাগল অতিথিরা এসে, থেকে, খেয়ে বইয়ের সঙ্গে রাত কাটাতে পারবেন।’ এটুকু হলেই তাঁর স্বপ্নটা সত্যি হয়।