'আমি তার ফাঁসি চাই'

‘আমার দুনিয়া এখন আন্ধার। চোখে তো কিছুই দেখি না। দুই চোখে এখন খালি ব্যথা। সেই সাথে মাথাটাও ব্যথায় ফাইট্টা যায়। ডাক্তার কইছে এই জেবনে আর চোখে দেখুম না। আমি এখন পঙ্গু মা আর ভাইয়ের অভাবের সংসারের বোঝা। কেউ খাওয়ায়ে না দিলে খাইতে পারি না। এর চাইতে মরণ ভালো।’ কথাগুলো বলছিলেন ভয়াবহ সহিংসতার শিকার শিউলি আখতার (৩৫)। গত নভেম্বর মাসের গোড়ার দিকে স্বামী মো. জুয়েল (২৯) চাকু দিয়ে শিউলির দুচোখ তুলে নেন।
২ ডিসেম্বর দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার ধলিহার গ্রামে বাবার বাড়িতে শিউলির সঙ্গে কথা হয়। দুএক মিনিট কথা বলার পরই যন্ত্রণায় কাতরে ওঠেন তিনি। কালো চশমার আড়াল থেকে চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়তে থাকে।
এর মধ্যেই শিউলি বলেন নিজের জীবনের কথা। অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় ১৯৯৬ সালে গাজীপুরের টঙ্গী থানার মধ্যপাগার মহল্লার মৃত মজিদ চৌধুরীর ছেলে আয়নাল হক চৌধুরীর সঙ্গে বিয়ে হয় শিউলির। বিয়ের পর তিনি জানতে পারেন সম্পত্তি নিয়ে চাচাদের সঙ্গে বিরোধ রয়েছে তাঁর স্বামীর। সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে নানামুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত চাচারা। তারপরও ছিল শিউলির সুখের সংসার। এর মধ্যেই শিউলির কোলজুড়ে আসে এক ছেলে ও এক মেয়ে।
২০০৯ সালে শিউলির স্বামী আয়নাল হক চৌধুরী খুন হন। খুনের জন্য আয়নালের চাচা আয়াত আলী চৌধুরী ও তাঁর ছেলে মো. জুয়েল চৌধুরীকে সন্দেহ করা হয়। কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে তাঁদের অভিযুক্ত করা যায়নি। এরপর তাঁরা আয়নালের জমির জন্য শিউলিকে সন্তান হত্যাসহ নানা ধরনের হুমকি দিতে থাকেন। একপর্যায়ে চাচা আয়াত আলী তাঁর ছেলে জুয়েলের জন্য শিউলিকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। প্রথমে রাজি না হলেও ২০১০ সালের মাঝামাঝি সময়ে শিউলি বাধ্য হন জুয়েলকে বিয়ে করতে।
জুয়েল ছিলেন নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি। বিয়ের পর থেকে প্রতিনিয়ত নেশার টাকা ও জমিজমা লিখে দেওয়ার জন্য শিউলিকে চাপ দিতেন। দিতে না চাইলে নির্যাতন শুরু হয় তাঁর ওপর। দিনে দিনে এ নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকে। মায়ের ওপর এ নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে বাধ্য হয়ে এক বছর আগে মেয়ে সাবরিনা আখতার (১৪) নানার বাড়ি ঘোড়াঘাটে চলে আসে। ছেলে শিবলু চৌধুরী (১৭) ঢাকার এক মেসে চলে যায়।
বাড়তে থাকে শিউলির ওপর নির্যাতন। গত ৫ নভেম্বর টঙ্গীর জামাই বাজার এলাকার ভাড়া বাসায় টাকা ও আগের স্বামীর জমিজমা লিখে দেওয়ার জন্য শিউলিকে চাপ দেন জুয়েল। দিতে না চাইলে হাত-পা বেঁধে ও মুখে স্কচটেপ দিয়ে শিউলির ওপর নির্যাতন শুরু করেন। একপর্যায়ে চাকু দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে শিউলির দুচোখ তুলে নেন । এরপর দরজা বাইরে থেকে তালা দিয়ে তিনি পালিয়ে যান।
প্রতিবেশীরা শিউলিকে উদ্ধার করে ভর্তি করান ঢাকার জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে। সেখানে শিউলির চোখে অস্ত্রোপচার হয়। চিকিত্সা শেষে শিউলি অন্যান্য স্বজনের সহায়তায় চলে আসেন বাবার বাড়ি। বাবা নেই। মা সাহেনা আখতার (৭০) কয়েক বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন।
শিউলির ভাই রনি প্রাইভেট গাড়িচালক। তাঁর রোজগারের ওপর কোনো রকমে চলে এ সংসার। মা, বোনের চিকিৎসাসহ ভরণপোষণ কীভাবে হবে সেই চিন্তায় তাঁরা দিশেহারা। এখন মাঝে মাঝে শিউলির চোখে প্রচণ্ড যন্ত্রণা হয়। বোঝেন আরও চিকিৎসা করতে হবে। কিন্তু ভাইয়ের যে সেই খরচ চালানোর সংগতি নেই।
নিজের ও ছেলেমেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে শিউলি এখন দিশেহারা। বলেন, ‘আমার ভবিষ্যৎ তো আন্ধার। ছেলেমেয়ে দুইটারে নিয়া বেশি চিন্তা আমার। কী হইব তাদের। আমার এই অবস্থা যে করছে আমি তার ফাঁসি চাই।’