'আমি পদকের জন্য কাজ করি না'

আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া। ছবি: জিয়া ইসলাম
আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া। ছবি: জিয়া ইসলাম

আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া একাধারে প্রত্নতাত্ত্বিক, পুঁথিসাহিত্যবিশারদ ও অনুবাদক। ১ অক্টোবর তিনি পা রেখেছেন ৯৬ বছর বয়সে। জন্মদিনে তাঁর মুখোমুখি হয়েছিলেন আজিজুল ইসলাম

আজিজুল ইসলাম: আজ আপনি ৯৬-তে পা দিলেন। আপনাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা। আপনি আমাদের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্বের জন্য যে কাজ করেছেন, তা অনন্য। কিন্তু আপনি তো একজন সরকারি চাকুরে ছিলেন...।

আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া: প্রথমে আমি শিক্ষকতার সঙ্গেই যুক্ত ছিলাম। ১৯৪৬ সালে বগুড়ার আজিজুল হক কলেজে আমার প্রথম চাকরি ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের প্রভাষক হিসেবে। প্রায় পৌনে দুই বছর সেখানে কাজ করার পর আমি সিভিল সার্ভিসে যোগ দিয়েছিলাম।

আজিজুল: সিভিল সার্ভিসে যোগ দিলেন কেন?

যাকারিয়া: অ্যাকচুয়ালি, সত্যি কথা বলতে কি, আমি তো গরিবের ছেলে। ইউনিভার্সিটির মাইনে ছিল দেড় শ টাকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে অফার দিয়েছিল। ড. এস এম তখন ইংরেজি বিভাগের হেড, তিনি বললেন, ‘তুমি বিভাগে যোগ দিলে ভালো হবে।’ কিন্তু ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের বেতন তখন আড়াই শ টাকা। এ লট অব মানি। সিভিল সার্ভিসে যোগ দিয়ে তখন বুঝেছি যে আমি কত বড় ভুল সেদিন করেছিলাম। তার খেসারত সারা জীবন দিয়েছি সারা রাত কাজ করে। অফিসে চাকরি করেছি, কিন্তু সারা রাত পড়াশোনা করেছি এবং নোট নিয়েছি।

আজিজুল: কখন থেকে প্রত্নতত্ত্বের প্রতি আগ্রহ শুরু হলো?

যাকারিয়া: অ্যাকচুয়ালি, ১৯৪৬ সালের প্রথম দিকে আমি যখন বগুড়া আজিজুল হক কলেজের প্রভাষক, তখন একদল ছাত্র রংপুর থেকে মহাস্থানগড়ে যাবে। তখন ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ বগুড়া আজিজুল হক কলেজের প্রিন্সিপাল। তিনি বললেন, ‘আপনি তো এসব বিষয়ে আগ্রহী, আপনি এদের নিয়ে যান।’ তো গেলাম বগুড়ার মহাস্থানগড়ে। সেখানে গিয়ে আমি তো অভিভূত। এতসব প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ আছে আমাদের! যেদিকে তাকাই, শুধু ধ্বংসাবশেষ আর ধ্বংসাবশেষ। তখন থেকে আই ডেভেলপড এ লট অব ইন্টারেস্ট। তখন থেকেই আমি যেখানে যাই, নোট রাখা শুরু করি। ১৯৪৭ সালে আমি সিভিল সার্ভিসে যোগ দিই। ১৯৫৮ সালে আমাকে সিভিল সার্ভিস থেকে অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সম্পর্কে পড়াশোনা করতে পাঠানো হয়েছিল সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া। আমি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সম্পর্কে পড়েছি ঠিক আছে, কিন্তু আমার আগ্রহজুড়ে ছিল প্রত্নতত্ত্ব। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স শেষে আমি দেড় মাস ছুটি নিলাম ইউরোপ ও আমেরিকার প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলো ঘুরে দেখতে। আমি গ্রিস, রোম ও মিসরের পিরামিড দেখি। পরে ইন্দোনেশিয়া গেলাম, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বৌদ্ধমন্দির দেখার সুযোগ হলে। তখন প্রত্নতত্ত্বের প্রতি আমার আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। তখন আমি নোট রাখি। লেখা শুরু করি রিটায়ারমেন্টের পর।

আজিজুল: বিশিষ্ট প্রত্নতাত্ত্বিক নলিনীকান্ত ভট্টশালীর সান্নিধ্য পেয়েছিলেন আপনি...

যাকারিয়া: হ্যাঁ, তার ছেলে আমার সঙ্গে ঢাকা কলেজে পড়ত। ওর বাবা ছিলেন মিউজিয়ামের কিউরেটর। প্রায়ই যেতাম ওদের বাসায়। আমি তো গ্রাম থেকে এসেছি। ভট্টশালী মশাইকে আমি শুধু প্রশ্ন করতাম—এটা কী মূর্তি, ওটা কী মূর্তি। উনি শুধু হাসতেন। হেসে হেসে সব উত্তর দিতেন। তাতে আমার অনেক লাভ হলো। এতে প্রত্নতত্ত্বের প্রতি আমার গভীর আগ্রহ তৈরি হলো। এটা আমার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।

আজিজুল: আপনার পেশা ও আগ্রহ দুটি কি সাংঘর্ষিক মনে হয়নি কখনো?

যাকারিয়া: তা তো হয়েছেই। তবে আমি গভর্নমেন্টের কাজে ফাঁকি দিইনি। আমাকে সময় বের করে নিতে হয়েছে। আমি সারা রাত কাজ করতাম। শেষ রাতের দিকে একটু ঘুমাতাম।

আজিজুল: আপনি তো প্রত্নতত্ত্ব চর্চা করতেন, অনুবাদের দিকে ঝুঁকলেন কীভাবে?

যাকারিয়া: আগ্রহী হলাম, এ জন্য যে প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে পড়তে পড়তে আমি বখতিয়ারের বঙ্গবিজয় নিয়ে পড়লাম। তখন আমি মিনহাজ-ই-সিরাজের তবাকত-ই নাসিরি সম্পর্কে জানতে পারি। বইটি আমি সংগ্রহ করি, এখনো আমার কাছে আছে। যিনি এ বইটি লিখেছেন, তিনি একজন মস্ত বড় ইতিহাসবিদ। তিনি সারা মুসলিম জগতের ইতিহাস লিখেছেন। বইটি পড়েই সিদ্ধান্ত নিলাম বইটি অনুবাদ করব। বিশেষ করে বাংলার ইতিহাস অংশ। বাংলার ইতিহাস জানতে হলে তবাকত--নাসিরি একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস গ্রন্থ। বইটি ফারসিতে লেখা। আমি সৌভাগ্যবান যে আমার পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণে ফারসি খুব ভালো জানতাম। আমার বাবা ছিলেন ফারসি পণ্ডিত।

আজিজুল: শুনেছি দিনাজপুরে আপনি নিজে একটি বৌদ্ধবিহার আবিষ্কার করেছেন?

যাকারিয়া: হ্যাঁ, বৌদ্ধবিহার—সিতাকোট বৌদ্ধবিহার। আমাকে দিনাজপুরে ১৯৫৮ সালে রেভিনিউ হেড হিসেবে পোস্টিং দেওয়া হয়। সেখানে আমার একটা লাভ হলো। আমি তখন তহশিলে তহশিলে, গ্রামে গ্রামে রেভিনিউ কালেকশনে যাই। সেখানে আমি অসাধারণ প্রত্নসম্পদের সন্ধান পাই। দিনাজপুরে এমন কোনো প্রাচীন গ্রাম নেই, যেখানে প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ নেই। আর এসব ধ্বংসাবশেষ সবই প্রাচীন। পাল আমলের, গুপ্ত আমলের, সেন আমলের সব প্রাচীন কীর্তি। ভাবলাম, আমি রত্নের খনির মধ্যে এসে পড়েছি। কিন্তু দুই বছর পর আমাকে সেখান থেকে ময়মনসিংহ বদলি করে দিল। কিন্তু সৌভাগ্য আমার। ১৯৬৮ সালে ডেপুটি কমিশনার হিসেবে দিনাজপুরে পোস্টিং দেওয়া হয়। সেখানে আমি একটি বাঁধানো মাউন্ড (ঢিবি) পেলাম। আমার পূর্বসূরি ওয়েস্ট মে কট ওটাকে বাঁধানো পুকুর বলেছিলেন। কিন্তু আমি বললাম, না, এটি কোনোমতেই বাঁধানো পুকুর হতে পারে না। চারদিকে দেয়াল, মাঝখানে বাঁধানো জায়গা। ইট বেরিয়ে আছে। আমি আর্কিওলজিক্যাল ডিপার্টমেন্টকে খনন করার কথা বললাম। সরকারকে অনেক বুঝিয়ে ১০ হাজার টাকা নিলাম খনন করার জন্য। তখন সেখান থেকে একটি ইমারতমতো বেরোল। এটি সিতাকোট বিহার। এটি পঞ্চম থেকে ষষ্ঠ শতকের। বাংলার প্রাচীনতম বৌদ্ধবিহার।

আজিজুল: দিনাজপুরে আপনি একটি জাদুঘরও করেছিলেন?

যাকারিয়া: হ্যাঁ। দিনাজপুর মিউজিয়াম নিয়ে আমি একটি বইও লিখেছি। এখানে কালেকশন সম্পর্কে সব তথ্য আছে। এটি সম্পূর্ণ আমার কালেশনে করা। সে সময় প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদগুলো চলে যাচ্ছিল পাকিস্তান, ভারতসহ পশ্চিমের বিভিন্ন জায়গায়। তাই ভাবলাম, এগুলো সংগ্রহ করে মিউজিয়াম করা দরকার। পরে সরকার এগুলো নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি তখন বলি, এগুলো আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহ। আমি দিনাজপুর মিউজিয়ামে দান করেছি। দিনাজপুরে আমি বেশ কয়েকটি কলেজও করেছি।

আজিজুল: প্রত্নতত্ত্ব, অনুবাদ তো হলো, আপনি পুঁথিসাহিত্য নিয়েও কাজ করেছেন, সংগ্রহ করেছেন দুষ্প্রাপ্য পুঁথি...।

যাকারিয়া: এটা খুব মজার। আমার বাবা ফারসি পণ্ডিত ছিলেন। কিন্তু কোনো চাকরি পাননি। বাড়িতেই থাকতেন তিনি। পুঁথিপাঠের প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল। গ্রামের মানুষ তাঁকে নিয়ে যেত পুঁথি শুনতে। আমিও তাঁর পুঁথিপাঠ শুনতাম। আমি তখন ছোটমানুষ। দুনিয়ার পুঁথি—বদিউজ্জামানের পুঁথি, গাজী কালু চম্পাবতীর পুঁথি—আরও অনেক পুঁথি শুনেছি। সেখান থেকে পুঁথিসাহিত্যের প্রতি একটা আগ্রহ তৈরি হয়। যখন চাকরি করি, তখন বিভিন্ন জায়গায় হাতে লেখা পুঁথি সংগ্রহ করে দিনাজপুর মিউজিয়ামে রাখি। এর মধ্যে নাথ সাহিত্যের একটি পুঁথি পাই—বড় যোগীর পুঁথি। আমি পড়ে তো মুগ্ধ। একটা আধ্যাত্মিক ব্যাপার। নাথধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের মধ্যে যে একটা সম্পর্ক আছে, এটি পড়ে বিষয়টি বুঝেছি আমি। এ বিষয়ে গুপিচন্দ্রের সন্ন্যাস নামে একটি বইও লিখেছি। এরপর আমি গাজী কালু চম্পাবতীর পুঁথি নামে আরেকটি গ্রন্থ লিখেছি। আমি রংপুরের গোবিন্দপুর উপজেলার চর নওয়া গ্রাম থেকে সংগ্রহ করি খোদ বখশ রচিত গাজী কালু চম্পাবতী পুঁথির পাণ্ডুলিপি। এ ছাড়া গাজী কালু চম্পাবতীর আরেকজন লেখক হালুমীর পাণ্ডুলিপিও উদ্ধার করি।

আজিজুল: সারা দিন পড়াশোনা, রাতজাগা—এসব নিয়ে এ বয়সে শারীরিক সমস্যা তৈরি হয় না? শরীরচর্চা করেন নাকি?

যাকারিয়া: না। আল্লাহ আমাকে এখনো এই বয়সে অনেক সুস্থ রেখেছেন। এ জন্য শুকরিয়া। আমি হাঁটাহাঁটি করি না। তবে দুপুরে গোসল করার আগে আধা ঘণ্টা ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করি। আর প্রতিদিন বাগানে তো দুই ঘণ্টা কাজ করিই।

আজিজুল: আপনি এত গবেষণা করেও রাষ্ট্রীয় কোনো সম্মাননা না পাওয়ায় একসময় আক্ষেপ করেছিলেন জাতীয় অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ সালাহ্উদ্দীন আহ্মদ। এ বিষয়ে আপনার কি কোনো আক্ষেপ বা কষ্ট আছে?

যাকারিয়া: লাগে তো এক-আধটু, কী আর করা। রাষ্ট্র থেকে তো কিছুই দেয়নি আমাকে। কোনো সরকারই আমাকে পছন্দ করে না। কারণ, আমি কারও তল্পিবাহক নই। আমি পলিটিকস করি না। (হাসি) আর আমি তো পদকের জন্য কাজ করি না। খারাপ লাগে। তবে আমার কাজ আমি করে যাব। এটা আমার ভালোবাসা, ডেডিকেশন। কে কী দিল, তা নিয়ে আমি চিন্তা করি না। তবে আমি তিনটি পদক পেয়েছি। এ জন্য আই অ্যাম ভেরি প্রাউড। আমি বাংলা একাডেমি, ইতিহাস পরিষদ ও ইতিহাস একাডেমি থেকে পদক পেয়েছি। এ ছাড়া এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ আমাকে ম্যান অব দ্য ইয়ার গোল্ড মেডেল দিয়েছে।