ঘর থেকে বাইরে কোথায় নিরাপদ নারী

খবরের কাগজের পাতা খুললেই দেখা যায় বিভিন্ন রকম ধর্ষণের খবর। বাবা কর্তৃক মেয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় প্রধান, মাদ্রাসার অধ্যক্ষ/শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক, গৃহশিক্ষক, প্রভাবশালী, রাজনৈতিক কর্মী, পরিত্যক্ত স্বামী তাদের বন্ধুসহ, সহপাঠী, বন্ধু, পরিবহনশ্রমিক, বখাটে, অশীতিপর বৃদ্ধ, মামা, চাচা, খালু, ফুফা, দুলাভাই—সবাই আজ যৌন নিপীড়ক? কিন্তু কেন?

১২ থেকে ১৩ বছরের একটি মেয়ে ধর্ষণের কারণে অন্তঃসত্ত্বা, কোনো দলের পক্ষে ভোট না দেওয়ার কারণে পাঁচ সন্তানের জননী গণধর্ষণের শিকার, কুমিল্লার সাংস্কৃতিক কর্মী তনু মৃত্যুর আগে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন, তা আজও রহস্যাবৃত।

বাসচালক ও চালকের সহকারীর হাতে ধর্ষণের শিকার রূপাকে হত্যা করে অন্ধকারাচ্ছন্ন বনের মধ্যে ফেলে রাখা হয়েছিল। বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম তাঁকে দাফন করেছিল। বড় ভাই থানায় বোনের লাশের ছবি দেখে শনাক্ত করেন। মহামান্য আদালতের অনুমতি নিয়ে পরম যত্নে পারিবারিকভাবে কবরে দাফন করা হয়।

কত তনু, নুসরাত, রূপার কথা বলব। এঁরা সবাই মা–বাবার ভালোবাসার ফল, পরিবারের সদস্যদের কাছে চোখের মণি। স্বাধীন বাংলাদেশে সবার অধিকার রয়েছে সুরক্ষা পাওয়ার। প্রথমে পরিবার থেকে। যেখানে বাবা কাছে মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়, তাতে পারিবারিক সুরক্ষা কোথায়?

সম্প্রতি সাভারে থানায় বান্ধবীর সঙ্গে বান্ধবীর পাওনা টাকা চাওয়ার সহযোগী হওয়ার কারণে দুজন পুলিশ কর্মকর্তা (এসআই ও এএসআই) দিনভর আকটে রেখে ধর্ষণ করেন। নুসরাতকে জেরা করার সময় ভারপ্রাপ্ত ওসি তাঁর হিজাব খুলতে বাধ্য করেন এবং এমন সব অবান্তর প্রশ্ন করেন, তাও আবার ফেসবুক এবং কোনো কোনো মিডিয়াতে প্রচারের পর মনে হলো নুসরাত অধ্যক্ষকে প্ররোচিত করেছিলেন তাঁকে যৌন নিপীড়ন করতে? পরে সুযোগ পেলে হয়তো ধর্ষণ করতেন।

প্রশাসন পারেনি এঁদের সুরক্ষা দিতে। কিন্তু কেন?

বিদ্যালয়ের, কলেজের, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছেও ছাত্রীসমাজ নিরাপদ নয়। একজন বিভাগীয় প্রধানকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে যৌন নিপীড়নের কারণে। সুশীল সমাজের কাছেও মেয়েরা নিরাপদ নয়। কিন্তু কেন?

আমি অপরাধসংক্রান্ত বিষয়ে বিশেষজ্ঞ বা মনস্তাত্ত্বিক নই। দীর্ঘ ৩৩ বছর (পরিবার পরিকল্পনা ও ওয়ার্ল্ডভিশন) মা ও শিশুদের, পথশিশু, ভাসমান শিশু, যৌনসেবা প্রদানকারীদের নিয়ে কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে চাই, মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হয় আর ধর্ষণকারী হলো পুরুষ।

সব ধর্মে মহান সৃষ্টিকর্তা মানুষকে সবার ওপরে স্থান দিয়েছেন। মানুষের যা আছে বুদ্ধিমত্তা, মননশীলতা, এটা পশুসমাজের নেই। তবু আমি বলব, কালের বিবর্তনে পশুসমাজ আজ মানবসমাজের ওপরে। কথাটা শুনতে যদিও খারাপ লাগবে, তবু বলছি, পশুদের মধ্যেও প্রকৃতিগত একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তারা যৌনক্রিয়ায় রত হয়, গর্ভবতী হয় এবং যথাসময়ে শাবক প্রসব করে। বেড়ে ওঠে পশুসমাজে, যারা প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে, মানুষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

মানুষের মধ্যে মুক্তচিন্তা, বোধবুদ্ধি আছে বলে পশুদের চেয়ে ব্যতিক্রম। কথাটা শুনতে যদিও খারাপ লাগবে, তবু বলতে বাধ্য হচ্ছি, পশুদের মধ্যে যৌনক্রিয়া যে প্রক্রিয়া দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, শিক্ষিতের তকমা লাগিয়ে মানুষ আজ তার চেয়েও ঘৃণিত।

ধর্ষণের পর অনেকেই কোনো চিহ্ন রাখতে চায় না বলে হত্যা করছে অবলীলায়। নুসরাতকে ছাদে নিয়ে নররূপী পশুরা পরিকল্পনা করে গায়ে কেরোসিন ঢেলে হত্যা করেছে। সাহায্যকারীদের মধ্যে দুজন ছিল তাঁর সহপাঠী। গায়ে আগুন দিয়ে নুসরাতের পাশে পরীক্ষার জন্য সংরক্ষিত সিটের পাশে বসে পরীক্ষাও দিয়েছে একজন।

আমার লেখার মধ্যে কয়েকটি ‘কেন’ রয়েছে। আমার মনের গভীর উপলব্ধি থেকে তার উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছি। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে একক পরিবার হচ্ছে, বিশেষ করে দাদি–নানিদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বড় হচ্ছে তারা। বিশেষ করে ছেলেরা ঘরের আকর্ষণের বাইরের দিকে ধাবিত হচ্ছে। চাইলেই পাওয়া যায়—এমন একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে আমাদের চারপাশে। কারণ, ঘরে শাসনের অভাব, সমাজপতি, রাজনৈতিক নেতারা তাদের ব্যবহার করছে তাদের নিজেদের প্রয়োজনে। ক্রমে জড়িয়ে পড়ছে ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদকের জালে। আর তার সঙ্গে আছে আকাশ সংস্কৃতির খোলা আকাশ। রঙিন চশমা চোখে দিয়ে আবালবৃদ্ধপুরুষেরা চারদিকে ঘুরে বেড়ায় পাওয়ার আশায় এবং অপরাধ জগতে চলে তাদের অবাধ বিচরণ।

কাঁদছে তনুর মা, নুসরাতের মা, রূপার মা আরও কত নাম তা–জানা তনু, নুসরাত, রূপার অগণিত মায়েরা। এঁদের বেলায় বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।

লেখা শেষে মনে পড়ছে সম্ভবত টাঙ্গাইলের ছোট একটি মেয়ের কথা। বখাটে একটি ছেলের হাত থেকে বাঁচার জন্য ডোবায় ঝাঁপ দেয়। বখাটে দাঁড়িয়ে থাকে, ‘মেয়েটি আর কতক্ষণ পানিতে থাকবে, উঠতে তো তাকে হবেই।’ মেয়েটি বুঝে গেছে যে বখাটের হাত থেকে বাঁচতে পারবে না। তার চেয়ে শ্রেয় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা। হয়েছিলও তাই। মেয়েটিকে আমি মাস্টারদা সূর্য সেনের অনুসারী প্রীতিলতা বলে ডাকতে চাই। কারণ, প্রীতিলতা ধরা না দিয়ে বিষপানে নিজেকে শেষ করে দিয়েছিলেন। সে যুগের প্রীতিলতার আবার জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশে টাঙ্গাইলের এক মায়ের ঘরে। তোমাকে নমস্য।

লুৎফে তাহেরা, উন্নয়নকর্মী