নয় বছরে মুক্ত আসর

২০১৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠান। ছবি: মুক্ত আসর
২০১৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠান। ছবি: মুক্ত আসর

২০১১ সালের ২৮ মে। কয়েকজন তরুণকে নিয়ে যাত্রা শুরু মুক্ত আসরের। প্রথমত আমাদের ইচ্ছে ছিল মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসগুলো নতুন প্রজন্মকে জানানো। তখন খুব বেশি আক্ষেপ হতো, আমাদের দেশের এত গৌরবময় ইতিহাসকে আমরা গর্ববোধ করি না। বিদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য,সংস্কৃতিকে নিয়ে মাতামাতির মধ্যে মনে হচ্ছিল নিজের অস্তিত্বের কথা কি আমরা মনে রাখছি না।

মুক্ত আসরের লেখক পুরস্কার । ছবি: মুক্ত আসর
মুক্ত আসরের লেখক পুরস্কার । ছবি: মুক্ত আসর

আমার নানা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মজিদ। ছোটবেলা স্কুল ছুটি হলে অন্য অনেকের মতো চলে যেতাম নানাবাড়ি। নানার সঙ্গে পঞ্চগড়ের আটোয়ারির ফকিরগঞ্জ বাজারে যেতাম। সেখানে অনেক মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে দেখা হতো। অনেকের অনেক কথাবার্তা শুনতাম। তখনকার দিনে মুক্তিযোদ্ধাদের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল। তা দেখে খুব দুঃখবোধ হতো। ভাবতাম, উনাদের অর্থনৈতিভাবে কখনো সহযোগিতা করতে পারব না। তবে উনাদের সম্মাননা জানাতে পারলে কিছুটা দুঃখ কমে যাবে।

দেশব্যাপী শিক্ষামূলক কর্মসূচি ‘বাংলাদেশকে জানো’ আয়োজন। ছবি: মুক্ত আসর
দেশব্যাপী শিক্ষামূলক কর্মসূচি ‘বাংলাদেশকে জানো’ আয়োজন। ছবি: মুক্ত আসর

ঢাকায় এসে বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হই। বের করি আলোকবর্তিকা নামে একটা সাহিত্য পত্রিকা। সেখানে একটা বিভাগ রাখলাম মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য! সেই সংগঠনের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আমাকে সেই লেখা প্রকাশ করতে দেবেন না। রেগেমেগে ফেলে চলে আসি। এ পরাজয় মানতে পারছিলাম না। অবশেষে সেই লেখা প্রকাশে মনের ভেতরে দৃঢ় প্রত্যয় নিলাম। এদের জন্য একটা কিছু করতেই হবে।

কয়েকজন পরিচিত ছোট ভাইবোনদের নিয়ে নীরবে যাত্রা শুরু করি। প্রতি সপ্তাহে সকাল ১০টায় কোনো না কোনো খোলা আকাশের নিচে বসত আমাদের সভা। সেই সভায় বন্ধুদের নানা ভাবনা নিয়ে আলোচনা চলত। আর আমার স্বপ্ন বোনার নির্ঘুম রাতগুলো অন্য রকমের এক রোমাঞ্চকর মনে হতো। স্বপ্নের সারথীদের গভীরভাবে স্মরণ করি। মোহাম্মদ হাবিব, মহিউদ্দিন শেখ, স্বর্ণময় সরকার, কৌশিক চাকমা, নাশিদ মুস্তারিন, তাসনুভা জাহান মৌ প্রমুখ। খোলা আকাশের নিচে বসতে বসতে আমাদের সংগঠনের নাম হলো ‘মুক্ত আসর’। শুরু হলো মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য সংগ্রহ। দল বেঁধে যেতাম। একজন সাক্ষাৎকার নিলে আর একজন ছবি কিংবা ভিডিও করতাম। গ্রুপ হিসেবে ভাগ করে কাজ করতাম। খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাৎকার নিয়ে শুরু হলো আনুষ্ঠানিক কাজের যাত্রা। সাক্ষাৎকারগুলো প্রকাশিত হতো প্রথম আলো শেষ পাতায় তোমাদের এই ঋণ শোধ হবে না কলামে।

‘বাংলাদেশকে জানো’ আয়োজনে শিক্ষার্থীরা । ছবি: মুক্ত আসর
‘বাংলাদেশকে জানো’ আয়োজনে শিক্ষার্থীরা । ছবি: মুক্ত আসর

এভাবে পরিচিত হলো খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে। তাঁদের মুখে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনে আবেগ আপ্লুত হয়ে যেতাম। তাঁরা অনেক স্নেহ করতেন, আমাদের দেখে আশা–আলোর কথা বলতেন। বলতেন, আমরা ভেবেছিলাম আর বুঝি আমাদের কথা কেউ মনে রাখবে না।

প্রথম অনুষ্ঠান
সংগঠনের বয়স তখন ছয় মাস। অনেক সাক্ষাৎকার তো হলো। একটা আয়োজন হলে মন্দ হয় না। কিন্তু আয়োজন করতে তো অর্থ লাগবে। কোথায় পাব! সাপ্তাহিক একটা চাঁদা দেওয়ার রেওয়াজ থাকলেও সেটাই বা কত, অতিসামান্য। তখন আমাদের সব সময় খোঁজখবর রাখতেন ফারাহ দিবা আহমেদ আপা। আপা আমাদের খোলা আকাশের নিচের সভাগুলোতে আসতেন। মহিউদ্দিন মধুর সঙ্গে আপার বাসায় যাই। আপা আমাদের ১০ হাজার টাকা দিয়ে বললেন, ‘যাও অনুষ্ঠান করো।’

সেই উৎসাহে শুরু হলো আমাদের বৃহৎ কর্মকাণ্ড। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, জাতীয় দিবসগুলোকে কেন্দ্র করে শুধু অনুষ্ঠান কেন হবে, মুক্তিযুদ্ধের অনুষ্ঠান হবে সব সময়। সেই চিন্তায় আমরা তারিখ ঠিক করি ২৫ ডিসেম্বর ২০১১। মুক্তিযুদ্ধের ৪০ বছরের অনুষ্ঠান। শিশু-কিশোরদের নিয়ে আয়োজন ‘শাবাশ বাংলাদেশ’। আয়োজনে থাকবে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, মুক্তিযুদ্ধের গল্প।

প্রচার নেই। প্রসার নেই। কীভাবে জানবে চারুকলার মুক্ত আসরের আয়োজন। তখন প্রথম আলোর সংস্কৃতি পাতাটা দেখতেন আশীষ-উর রহমান শুভ ভাই। তিনি ছোট করে একটু নিউজ করে দিলেন। তা দিয়ে কী কয়েকজন বা আসবে। অনুষ্ঠানের আগের রাতে মহিউদ্দিন মধুকে নিয়ে চারুকলায় শাহনেয়াজ হলে মোহাম্মদ হাবিবের সঙ্গে দেখা করলাম। এরপর হাবিবের কী ছোটাছুটি। শিশু একাডেমি থেকে শুরু করে, শিশুদের অভিভাবকদের কাছে। হাবিব জোগাড় করলেন চিত্রাঙ্কনে অংশ নেওয়া শিশুদের অভিভাবকদের মোবাইল নম্বরসহ তালিকা। রাত জেগে প্রায় ২০০ জনকে ফোন দেওয়া হলো। পরদিন অনুষ্ঠান। যতটা আমরা আশা করিনি। তার চেয়ে কয়েক গুণ শিশু-কিশোর অংশ নিল। আমরা বারবার ছুটছিলাম মাদুর আনার দোকানের কাছে। সত্যি আয়োজনটা ছিল জমকালো। মুক্তিযোদ্ধারা ঠিক সময়ে এসে মুক্তিযুদ্ধের গল্প বললেন। শিল্পী আবুল বারক আলভী স্যার বিচারক হলেন।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রথম ত্রৈমাসিক ‘স্বপ্ন ৭১’
আমাদের কর্মকাণ্ড দেখে কয়েকজন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা যুক্ত হলেন। তাঁদের মধ্যে বীর প্রতীক মেজর জেনারেল মাসুদুর রহমান, মেজর তাহের আহমেদ, এ কে এম জয়নুল আবেদিন খান, রফিকুল ইসলাম প্রমুখ। মেজর তাহের আহমেদ আঙ্কেল আমাদের সঙ্গে একেবারে মিশে গেলেন। আমরা প্রায়ই তাঁর বাসায় সভায় বসি। আলোচনা হয় কীভাবে অর্থ (ফান্ড) সংগ্রহ করা যায়।

বীরাঙ্গনাদের পাশে মুক্ত আসর। ছবি: মুক্ত আসর
বীরাঙ্গনাদের পাশে মুক্ত আসর। ছবি: মুক্ত আসর

মুক্তিযুদ্ধের বিষয়গুলো সহজে সবাইকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য খোলা আকাশের মঞ্চে সিদ্ধান্ত হলো একটা মুক্তিযুদ্ধ

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীদের সম্মাননা। ছবি: মুক্ত আসর
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীদের সম্মাননা। ছবি: মুক্ত আসর

বিষয়ক পত্রিকা বের করব। সবার কাছে নাম প্রস্তাব চাওয়া হলো। একেকজন একেক নাম দিলেন। ‘জয় বাংলা’ কিংবা ‘৭১ স্বপ্ন’ এমন ভাবনা ছিল আমাদের। তাসনুভা জাহানের দেওয়া নাম ছিল ‘৭১ স্বপ্ন’। তখন আমি সেটা ঘুরিয়ে নাম দিলাম ‘স্বপ্ন ৭১’। পুরোদমে কাজ চলল। রবিন আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলেন। তিনি ব্যাপক উদীপ্ত। দিন–রাত পরিশ্রমের ফলে সেগুনবাগিচায় অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের মুক্তমঞ্চে প্রকাশিত হলো দেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ত্রৈমাসিক ‘স্বপ্ন ৭১’।

মুক্ত আসর নিয়মিত কার্যক্রম
প্রতি বছরে আমরা দিয়ে থাকি মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা। এ জন্য আয়োজন করি অনুষ্ঠানের। বছরব্যাপী স্কুল কার্যক্রম ‘শুনি মুক্তিযুদ্ধের বীরত্ব কথা’, ‘বাংলাদেশকে জানো’। বাংলা সাহিত্যে ১০০ শব্দের গল্প লেখা প্রতিযোগিতা, মুক্তিযোদ্ধা তথ্যসংগ্রহ, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক অনুষ্ঠানসহ নানা আয়োজন।

শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। ছবি: মুক্ত আসর
শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। ছবি: মুক্ত আসর


ইতিহাস অলিম্পিয়াড
নিজের শিকড়কে না জানতে পারলে একজন মানুষ পরিপূর্ণ মানুষ নাকি হয় না, ভেতরে মনুষ্যত্ব বোধ কাজ করে না। ঠিক একটা দেশকে বা সমাজকে জানতে হলে সেই দেশের ইতিহাস-ঐহিত্যকে জানতে হবে। তাহলে সেই দেশের প্রতি মায়া-মমত্ববোধ জন্মাবে। সেই চিন্তা থেকে আমরা ২০১৫ সালের ১৮ জুলাই থেকে শুরু করি ইতিহাস অলিম্পিয়াডের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন এবার আমরা ঢাকার সভারের আয়োজনের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছি। জুনে শুরু হবে আয়োজন।

নানাভাবে যাঁদের সহযোগিতা
মুক্ত আসর যাত্রা থেকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছে মুক্তবন্ধুরা। কিছু মানুষের অবদান অনস্বীকার্য। বিশেষ করে মুক্ত আসরের উপদেষ্টা ভাষাসংগ্রামী আহমেদ রফিক, প্রধান উপদেষ্টা বীর প্রতীক মাসুদুর রহমান, মেজর তাহের আহমেদ, নুরুন আখতার, ফারাহ দিবা আহেমদ, মুনির হাসান, কথাসাহিত্যিক মোহিত কামাল, ডা. আহমেদ হেলাল, রাশেদুর রহমান তারা, নিয়াজ চৌধুরী তুলি, দন্ত্যস রওশন, রাশেদা নাসরীন, মুক্তিযোদ্ধা ডা. এম এস এ মনসুর আহমেদ, রাশেদুল আলম রাসেল, মোহাম্মদ হাবিব, কাব্য আহমেদ, শুভংকর কর্মকার, অনীক রাহীম, খায়রুল বাবুই, সাহিনা মিতা, এনডি মিথুন, বায়েজিদ ভূঁইয়া জুয়েল, আশফাকুজ্জামান, কৌশিক চাকমা, মোহাম্মাদ আলী, জিনাত নাজিয়া, আবদুর রাজ্জাক, আইয়ুব সরকার, আলমগীর হোসেন, রাহিতুল ইসলাম, আনোয়ার হোসেন, আবু তাহের সোহেল, উন্মে নুর কনা, পার্থ প্রতীক, মোছাম্মৎ হালিমা, ভারতের স্বপন চক্রবর্তী, সঞ্জিত দত্তসহ প্রমুখ। আরও অনেকেই আমাদের সংগঠনকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করেন, কৃতজ্ঞ তাঁদের প্রতিও।

* আবু সাঈদ: প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি মুক্ত আসর