ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে রাজধানী বিভাজন করা যায় না?

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

আজকের ঢাকা একসময় এমন সমস্যায় জর্জরিত নগরী ছিল না। সতেরো শতকে মোগল সাম্রাজ্যের বাংলা প্রদেশের (সুবাহ বাংলা) রাজধানী ছিল ঢাকা। সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে এই শহর পরিচিত ছিল জাহাঙ্গীরনগর নামে। ইতিহাস অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী মসলিন বাণিজ্যের একটি কেন্দ্র ছিল ঢাকা এবং বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যবসায়ীরা এখানে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে আসতেন। অবশ্য আধুনিক ঢাকা শহরের বিকাশ ঘটে ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজ শাসনামলে, এই সময় নবাবেরা ঢাকা শাসন করতেন। সেই সময় কলকাতার পর ঢাকাই দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী হয়ে ওঠে।

১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ হয়। এরপর ঢাকা নবগঠিত পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশের রাজধানী হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পরে ঢাকা পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনিক রাজধানীতে পরিণত হয়। ১৯৫০-৬০ সালের মধ্যে এই শহর বিভিন্ন সামাজিক, জাতীয়তাবাদী ও গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। ঢাকা স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাজধানী ঘোষিত হয় ১৯৭১ সালে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৫(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী। আধুনিক ঢাকা বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের প্রধান কেন্দ্র। কিন্তু আজকাল ঢাকার নির্দিষ্ট কিছু অভিজাত এলাকা ছাড়া বাকিটা হয়ে গেছে বসবাসের অযোগ্য। সেই জায়গা ঘিরে উঠে আসে নানা সমস্যার কথা। প্রশাসনিক রাজধানী হিসেবে ঢাকার বিকল্প বা কাছাকাছি কোনো শহরকে ভাবনার সময় বোধ হয় হয়ে গেছে।

পত্রিকায় দেখলাম, জাকার্তা থেকে রাজধানী সরিয়ে নিচ্ছে মুসলিম বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়া। জাকার্তা থেকে রাজধানী অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা চলছে বলে দেশটির পরিকল্পনামন্ত্রী ব্যামব্যাঙ ব্রোদজোনেগোরোর জানিয়েছেন। সংবাদমাধ্যমকে ব্যামব্যাঙ ব্রোদজোনেগোরোর বলেন, প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো ইন্দোনেশীয় রাজধানী স্থানান্তরে গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। রাজধানীর নতুন স্থানের নাম এখনো ঠিক হয়নি। তবে সম্ভাব্য রাজধানী হওয়ার সম্ভবনায় প্রথম দিকে আছে বোর্নিও দ্বীপের পালঙ্কারায়া। জোকো উইদোদোর দেশটির সাধারণ নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট হিসেবে জয়লাভ করার পরই রাজধানী স্থানান্তরের ঘোষণা দেন। 

আমরা দেখেছি, বিশ্বের আরও অনেক দেশ তাদের রাজধানী শহর সরিয়ে নিয়েছে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা নতুন কোনো শহরে। এর মধ্যে রয়েছে ব্রাজিল, কাজাখস্তান, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, মিয়ানমার বা নাইজেরিয়ার মতো দেশ। ইন্দোনেশিয়া যদি তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে, সেই তালিকায় এখন তাদের নামও যুক্ত হবে।

বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে বাস করা মানুষের ৩৬ ভাগই ঢাকায় বাস করে। আর বর্তমান প্রবণতা চলতে থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ ঢাকার জনসংখ্যা হবে প্রায় সাড়ে তিন কোটির বেশি। কিন্তু যথাযথ পরিকল্পনা ছাড়াই শহরটি গড়ে ওঠার ফল হিসেবে ঢাকা পরিণত হয়েছে বসবাসের ক্ষেত্রে নিম্নমানের শহরে আর বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে ভয়াবহ যানজটে। রাজধানী ঢাকা নগরীর এখন যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, ঢাকা থেকে বাংলাদেশের রাজধানী অন্য কোথাও সরিয়ে নেওয়া সম্ভব কি না, তা নিয়ে ভাবতে হবে।

বিশ্বব্যাংকের মতে, গত ১০ বছরে সড়কে যান চলাচলের গতি ঘণ্টায় গড়ে ২১ কিলোমিটার থেকে কমে এখন এসে দাঁড়িয়েছে ৭-এ। মানুষের গড় হাঁটার গতির চেয়ে যা একটু বেশি। যানজট, জলাবদ্ধতার মতো সংকটের পাশাপাশি অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণেও ঢাকায় বেড়েছে ভূমিকম্প ও বন্যার ঝুঁকি। ৩৫ লাখ বস্তিবাসী প্রায় বঞ্চিত হচ্ছে ন্যূনতম সুবিধা থেকেও। ঢাকায় রাস্তাঘাট প্রয়োজনের প্রায় অর্ধেক। তারও অধিকাংশই আবার ভাঙাচোরা। আবাসন, শিক্ষাঙ্গন ও বিনোদনের সংকট প্রকট। আর বেশ কয়েকটি পার্ক আছে। সেগুলো যানবাহন, মাদকসেবী আর বখাটে লোকে ভরপুর। তাই সাধারণ লোক তেমন যায় না সেখানে। পানি, বিদ্যুৎ পয়োনিষ্কাশনের সংকট তীব্রতর। জলাবদ্ধতা, রাস্তা দখল, অপরিকল্পিত ও জরাজীর্ণ বাড়িঘর, ব্যাপক চাঁদাবাজি নিরাপত্তাহীনতা, ভয়াবহ যানজট ইত্যাদি বিদ্যমান। তাই এখন বসবাসের অনুপযোগীর দিক দিয়ে বিশ্বের ১৪০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ১৩৭। বায়ুদূষণের দিক দিয়েও ঢাকা প্রথম।

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

ভাবলে কষ্ট লাগে, ঢাকার সব ব্যবস্থাপনা এবং বিভিন্ন সামাজিক সেবা আসলে ভালো নয়। আমরা জানি, বিশ্বের অনেক দেশে যখন এ রকম পরিস্থিতি হয়েছে, তারা উদ্ভাবনী উপায়ে সমাধানের চেষ্টা করেছে। আর এর একটি সমাধান দেশকে দুটি কেন্দ্রে ভাগ করে ফেলা। প্রশাসনিক কেন্দ্র আর বাণিজ্যিক কেন্দ্র। ভারতের ক্ষেত্রে যেমন দিল্লি এবং মুম্বাই রয়েছে, পাকিস্তানের ক্ষেত্রে যেমন করাচি এবং ইসলামাবাদ। ইউরোপের অনেক দেশেই প্রশাসনিক রাজধানী যেখানে, সেখানে কোনো বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে তোলা হয় না। কিন্তু আমাদের সব এক জায়গায় করার কারণেই আজকের এই অবস্থা হয়েছে। প্রায় তিন কোটি মানুষের চাপ, যানজট, নানা ধরনের নাগরিক সুবিধার অভাব, বাসস্থানের সংকট এবং ব্যাপক দূষণ ঢাকার নাগরিকদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। এই শহরের অনেক ভবন এবং এলাকার রাস্তা ও ড্রেন রীতিমতো মৃত্যুফাঁদ হয়ে গেছে। আগামী দিনে ঢাকার চেহারা কেমন হবে, সেই কথা ভেবে অনেকেই আঁতকে ওঠেন। আর এসব কারণে ঢাকা যদি অচল এবং বসবাসের অযোগ্য হয়ে দাঁড়ায়, তখন আর বিকল্প কী?

অনেক দিন আগে বন্দরনগরী চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে চিন্তা করা হয়েছিল; আর ঢাকাকে প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে। কিন্তু এটা তখন করা হয়নি। এর কারণ হলো, আমাদের এই সমাজের অভিজাত শ্রেণি এবং ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা এ ধরনের বিভাজনকে খুব সুনজরে দেখেন না। কারণ তাঁরা একটা জায়গাতেই সবকিছু হাতের মুঠোয় পেতে চান। তাঁরা অন্য কোনো জায়গায় পুনরায় স্থাপিত হতে চান না। তবে এটা ঠিক যে একটি শহরে বাণিজ্যিক রাজধানী রেখে অন্য একটিতে প্রশাসনিক কেন্দ্র করার কাজটা খুব সহজ হবে না। কিন্তু নতুন রাজধানী যদি গড়তেই হয়, সেটা গড়ে তোলা কি একেবারেই অসম্ভব? অর্থ, জমি ও প্রযুক্তি দিলে কোনো কিছুই অসম্ভব হওয়ার কথা নয়। আবার আরেকটি কাজ করা যায়। সেটা হলো ঢাকা শহরকে আরও বিস্তৃত করা। দেশের আগামীর প্রয়োজন অনুযায়ী ঢাকাকে আর কতটা বিস্তৃত করা সম্ভব, সেটা নিয়েও ভাবা যায়। আর সেটা করতে না পারলে আমাদের কী ধরনের ক্ষতি হবে (পরিবেশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদির ক্ষতি) তা নিয়েও চিন্তা করা দরকার। তাই ঢাকাকে দ্রুত বাসযোগ্য করার পদক্ষেপ না নিতে পারলে, বিকল্পই ভাবতে হবে।

হাসান হামিদ: কবি ও গবেষক, সদস্য জাতীয় গ্রন্থাগার