মাতারবাড়ী কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পে মহাযজ্ঞ

মাতারবাড়ী কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র। প্রথম আলো ফাইল ছবি
মাতারবাড়ী কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র। প্রথম আলো ফাইল ছবি

নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতাম না। কী অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে ‘মাতারবাড়ী কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের’ কাজ! এই তো সেদিন, গত বছর জুলাই কি আগস্ট মাসে গিয়েছিলাম প্রকল্পের কিছু কাজের চিত্র সংগ্রহ করতে, আমার আর্কাইভে সংরক্ষণের জন্য। তখনো প্রকল্পের এই দৃশ্যমান যজ্ঞটুকু দেখতে পাইনি! যদিও পুরোদমেই তখন কাজ চলছিল এখানে-ওখানে। কিন্তু সময়ের সীমাবদ্ধতায় পুরো প্রকল্প এলাকাটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ঘুরে দেখতে পারিনি বলে হয়তো যজ্ঞটুকু নজরে আসেনি তখন!

আগেরবার এই প্রকল্প এলাকায় ঢুকেছিলাম কোহালিয়া নদী সীমান্ত (পূর্ব দিক) দিয়ে। এবার প্রবেশ করেছি মাতারবাড়ীর ‘সাইরার ডেইল’ সীমানা অর্থাৎ পশ্চিম দিক দিয়ে।

শুরুতেই বলে নেওয়া ভালো, আমি কিন্তু এই মাতারবাড়ীরই সন্তান। আমার দেহ-মনে আজও এই দ্বীপের কাদামাটির গন্ধ লেগে আছে। ক্লাস ফাইভ অবধি আমি এই মাতারবাড়ী দ্বীপেই পড়াশোনা করেছি। সেই সময়ে (১৯৬৫) মাতারবাড়ীতে কোনো হাইস্কুল না থাকায় আমি চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ সরকারি কলোনি হাইস্কুলে ভর্তি হই এবং সেই স্কুল থেকেই এসএসসি পাস করি।

আমার জন্মস্থানকে আমি বরাবরই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি সবার কাছে—আমার কথায়, লেখায় এবং প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে। ১৯৯১-এর ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের কাহিনি নিয়ে আমার প্রামাণ্যচিত্র ‘দুর্জয় দ্বীপ’ সেই সময়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ চ্যানেল ফোর এবং বিবিসি ওয়ার্ল্ডে অংশবিশেষ প্রদর্শিত হয়েছিল।

সেই ১৯৯১ সালে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা এবং আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টেকনাফ, কক্সবাজার, মহেশখালী, মাতারবাড়ী ও কুতুবদিয়ার মতো দুর্গম উপকূলে গিয়েছিলেন উপদ্রুত মানুষের পাশে সহযোগিতা আর সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে! সেই সময়ে আমিও WTN (Worldwide Television News)-এর ক্যামেরা নিয়ে ওসব অঞ্চলে কাজ করতে গিয়ে শেখ হাসিনার বেশকিছু কর্মকাণ্ড ধারণ করেছিলাম। থাক, সেসব নিয়ে পরে এক দিন বিস্তারিত লেখা যাবে। আজ শুধু বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়েই লিখতে চাই।

এ বছরের ৩০ আগস্ট মাতারবাড়ীতে গিয়েছিলাম একটি পারিবারিক কাজে। ভাবলাম, এত দূর যখন এসেই পড়েছি তখন প্রকল্পে না গিয়ে ফিরে যাই কেন! সেই উদ্দেশ্যেই এবার যাওয়া কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পে।

মাতারবাড়ীর পশ্চিম দিকের বেড়িবাঁধের ওপর দিয়ে আমরা যখন দক্ষিণে ছুটছি, বেলা তখন প্রায় সাড়ে তিনটা। আমাদের বাঁয়ে মাতারবাড়ী গ্রাম আর ডানে কুতুবদিয়া চ্যানেল। এই চ্যানেলকে অবশ্য বঙ্গোপসাগরের উত্তর দিকের মোহনাও বলা যেতে পারে।

আমরা তখন সাইরার ডেইলের শেষ মাথায়। এখান থেকে আর কয়েক কিলোমিটার দক্ষিণে গেলেই ধলঘাটার সুতরিয়া। সুতরিয়া এই দ্বীপের শেষ দক্ষিণ প্রান্ত। এরপরেই বঙ্গোপসাগর। ধলঘাটার সুতরিয়া থেকে সোজা দক্ষিণে ২০ কিলোমিটার গেলেই সোনাদিয়া দ্বীপ। আবার সোনাদিয়া থেকে ১১৯ কিলোমিটার দক্ষিণে (সামান্য দক্ষিণ–পূর্বে) রয়েছে পর্যটনদ্বীপ সেন্ট মার্টিন। মাতারবাড়ী গ্রামের শেষ সীমানা—অর্থাৎ, কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের শুরুর সীমানা থেকে ধলঘাটা হয়ে সোজা সোনাদিয়া পর্যন্ত জায়গাটিতেই তৈরি হতে যাচ্ছে গভীর সমুদ্রবন্দর। যে সুতরিয়া থেকে সোজা দক্ষিণে গেলেই সোনাদিয়া দ্বীপ, সেই সুতরিয়াকে পেছনে রেখে বাঁয়ে তাকালেই নজরে পড়বে মহেশখালী দ্বীপের সবুজ পাহাড়, উত্তর–দক্ষিণে বিস্তৃত। মাঝখানে প্রবাহিত খরস্রোতা নদী ‘কোহালিয়া’- মহেশখালী আর মাতারবাড়ী দ্বীপকে আলাদা করে রেখেছে ভৌগোলিকভাবে। তবে প্রশাসনিক দিক থেকে দ্বীপটি কিন্তু মহেশখালী উপজেলার অন্তর্গত দুটি ইউনিয়নের সমন্বয় মাত্র, যা মাতারবাড়ী ও ধলঘাটা নামেই পরিচিত!

কোনো দ্বীপের পুরো ভূমিতেই একটি পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে অনড়—এমন নজির খুব কম দেশেই আছে বোধ হয়! মহেশখালী দ্বীপের অসাধারণ এই সৌন্দর্য নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। পাহাড় আর সাগরের অদ্ভুত এই মহামিলন পৃথিবীর আর কোথাও এমন সুন্দর স্নিগ্ধভাবে আছে কি না আমার জানা নেই।

আমাদের অঞ্চলের মানুষগুলো ‘লড়াকু’ হয়ে ওঠার পেছনে এই সাগর আর পাহাড়ের মিথস্ক্রিয়া অন্যতম ভূমিকা রেখেছে বলেই অনেক মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন। দিনে দুই বেলা যে অঞ্চলের মানুষ জোয়ার–ভাটা দেখতে অভ্যস্ত, তাদের জন্যে হারানোর বেদনা কিংবা হঠাৎ প্রাপ্তি—কোনোটাই বড় বিষয় নয়। যার ফলে একান্নব্বইয়ের মহা ধ্বংসযজ্ঞের পরে এই অঞ্চলের মানুষ উঠে দাঁড়িয়েছিল মাত্র তিন মাসের মাথায়!

যাক! ফিরে আসি মাতারবাড়ী কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পে! বেলা সাড়ে তিনটায় যাত্রা শুরু করে বিকেল পৌনে চারটার দিকে আমরা পৌঁছে যাই প্রকল্পের দুই নম্বর গেটের কাছে। বেড়িবাঁধ থেকে নিচের দিকে নেমে যাওয়ার আগে ডানে তাকাতেই দেখি কুতুবদিয়া চ্যানেলে এবং সাগরের মোহনায় বেশ কয়েকটা জাহাজের উপস্থিতি। পরে জেনেছি, এসব জাহাজে করে এই প্রজেক্টের খুবই ভারী এবং বিশালকায় যন্ত্রপাতিগুলো আনা হয় এখানে।

বাঁধ ছেড়ে আমাদের গাড়ি নেমে যায় একটু নিচে—প্রকল্পের দুই নম্বর গেটের দিকে। গেটে নিরাপত্তা বাহিনীর কড়া পাহারা। হাত তুলে আমাদের গাড়ি থামিয়ে দিল প্রহরীদের একজন। কাছে এসে পেশাদারি কায়দায় জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের গন্তব্য কোথায়? যথাযথ উত্তর দিতেই রক্ষী বললেন, আপনাদের ব্যাপারে প্রকল্প পরিচালক অবশ্য বলে রেখেছিলেন। তবুও একটুখানি ফরমালিটিজ আছে। আমাদের খাতায় যদি আপনাদের নাম–ঠিকানা এবং অন্যান্য তথ্য লিখে যেতেন, ভালো হতো। আমি সব তথ্য দিয়ে তাঁদের খাতায় স্বাক্ষর করে আসি।

২ নম্বর গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকেই নজরে পড়ে বিস্তর বালুভূমি, বালুর চর। বালু ঢেলে এখানকার জলাশয়গুলো ভরাট করা হয়েছে নিপুণভাবে! এখানে আগে লম্বা খাল আর জলাশয় ছিল। খালের দুই পাশে ছিল লবণের মাঠ। লবণের মৌসুমে লবণ আর পরবর্তী সময়ে হতো চিংড়ির চাষ। ১ হাজার ৪১৪ একর আয়তনের এই প্রান্তরটি আসলে মাতারবাড়ী আর ধলঘাটার মধ্যবর্তী একটি ফাঁকা জায়গা! দুই ইউনিয়নের মাঝখানের একটি বিশাল ফাঁকা অংশেই গড়ে উঠছে মাতারবাড়ী কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প।

এই প্রকল্পের কারণে কোনো বসতবাড়ি এখান থেকে উচ্ছেদ হয়েছে কি না আমার জানা নেই! তবে ৪০টি হতদরিদ্র পরিবার খাসজমিতে ‘বস্তি’ ধরনের ঘর তুলে বসবাস করছিল বেড়িবাঁধের পাশে, যাদের জন্য সরকার প্রকল্পের বাইরে জমি কিনে নতুন করে বাড়ি নির্মাণ করে দিচ্ছে বলেই জেনেছি।

আমার ছোটবেলায় এই ফাঁকা এলাকাটি আমি বহুদিন দেখেছি নিষ্ফলা, ফাঁকা পড়ে আছে। এই ফাঁকা জায়গাটি এতটাই নির্জন ছিল যে এখানে যেতে আমাদের ভয় করত তখন! তবে যখন থেকে চিংড়ির কদর বাড়তে শুরু হলো, লবণের দাম বাড়তে লাগল, তখন থেকেই এই জমি এবং জলাভূমির কদরও বাড়ল। বেড়ে গেল মানুষের আনাগোনা! ঘুরে গেল এই অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যের চাকা!

এই প্রকল্প যখন ছোট বাউন্ডারি ওয়াল দিয়ে সীমানা নির্ধারণ করে ফেলল, তখনই আমি এই পুরো এলাকাটির ভিডিওতে ধারণ করে রাখি সচেতনভাবেই। প্রকল্পের ‘সয়েল টেস্ট’-এর সময় থেকেই আমি ভিডিও এবং স্থিরচিত্র ধারণ করে রেখেছিলাম। প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে আমি আগেভাগেই নিশ্চিত ছিলাম যে এই প্রকল্পের কারণে এক দিন এই দ্বীপের স্কাইলাইন যাবে পাল্টে, এই অঞ্চলের মানুষের সংস্কৃতি যাবে বদলে! সুতরাং তখনই যদি সেটা ধারণ করে রাখা না যায়, পরে এই অঞ্চলের আগের ডেমোগ্রাফি, আর্থসামাজিক অবস্থা এবং সংস্কৃতির কোনো দলিল কিংবা প্রমাণাদি আর পাওয়া সম্ভব হবে না! সেই উদ্দেশ্যেই আমি উল্লেখিত বিষয়গুলো যতটা সম্ভব ধারণ করে রাখি সেই সময়ে। ভিডিওর পাশাপাশি সেই সময়ের বেশকিছু স্থিরচিত্রও আমি তুলে রেখেছিলাম এলাকাটির, যার কয়েকটি এখানে দেওয়া হলো।

১৯৮১ সালে ইউপিটিএন ( ইউনাইটেড প্রেস টেলিভিশন নিউস)-এ ইলেকট্রনিক ফটোজার্নালিজম শুরুর সুবাদে, আমার নিজের একটি ভিডিও ক্যামেরা দিয়ে একটু একটু করে মাতারবাড়ী গ্রামের ক্রমবিকাশমান আর্থসামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড আমি ধারণ করে রেখেছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল, পরে এসব ফুটেজ কম্পাইল করে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করা। বর্তমানে আমার হাতের কাজটি সম্পন্ন করেই মাতারবাড়ী নিয়ে আমার আরাধ্য প্রামাণ্যচিত্রটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন করব আশা করি।

ফিরে আসি প্রকল্পে। মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্পের ২ নম্বর গেট দিয়ে ঢুকেই ডানে দেখি বিশাল আকৃতির কয়েকটি স্থাপনা। এই স্থাপনাগুলো প্রকল্পের কী কাজে আসবে, সেটা অবশ্য আর জানা হয়ে ওঠেনি তাড়াহুড়োয়।

তবে প্রকল্প এলাকায় এদিক–সেদিক যেদিকেই তাকাই, সব দিকে কেবল কাজ আর কাজ! শুক্রবারে ছুটির দিনেও দেখি বেশ কিছু কোরিয়ান এবং বাঙালি কর্মী রাস্তা মাপজোক করছেন। আমাদের উল্টো দিক থেকে এগিয়ে এল কয়েকটি ট্রাক আর খননকাজের যন্ত্রসমেত গাড়ির বহর। আমরা ওদের পাশ কেটে এগিয়ে গেলাম পশ্চিম থেকে পূর্বে। মাঝেমধ্যে মনে হচ্ছিল বালুর উপত্যকা বেয়েই চলেছি! রাস্তার দুই পাশে বালু দিয়ে ভরাট করে প্রকল্পের বেজমেন্টকে সুমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩০ মিটার উঁচু করা হচ্ছে, যাতে সামুদ্রিক ঝড়-জলোচ্ছ্বাস প্রকল্পের কোনো ক্ষতি করতে না পারে। এর মধ্যেই আমরা এসে পড়লাম প্রকল্পের পূর্ব দিকের সীমানার কাছে। এখানেই প্রকল্পের প্রধান কার্যালয় অবস্থিত কোহালিয়া নদীর কোলঘেঁষে।

ছুটির দিনে (শুক্রবার) মনিরুল ইসলামকে অফিসে গিয়ে বিরক্ত করি। মনিরুল ইসলাম তড়িৎ প্রকৌশলী। পদবিতে সুপারিনটেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার, বর্তমানে এই প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী। পুরো প্রকল্পটি তাঁর নখদর্পণে! প্রতিটি জিজ্ঞাসার বিপরীতে মুহূর্তেই যথোপযুক্ত তথ্য এবং পরিসংখ্যান সহকারে দ্রুত উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর কাছেই জেনেছি, এই প্রকল্পে প্রায় চার হাজার শ্রমিক কাজ করে চলেছেন এখন। তাঁদের মধ্যে অদক্ষ শ্রমিক আছেন প্রায় ২ হাজার ৫০০ জন। বাকিরা দক্ষ। সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মাতারবাড়ী এবং ধলঘাটার প্রায় ১ হাজার ৭০০ শ্রমিক (অদক্ষ) এখন কাজ করছে এই প্রকল্পে। তিনি জানান, যে গতিতে কাজ এগিয়ে চলেছে, তাতে নির্ধারিত ২০২৪ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতেই এই প্রকল্পের উৎপাদন শুরু করা যাবে। মাতারবাড়ী কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত আছে দৈনিক ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট।

বর্তমানে বাংলাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা আছে দৈনিক ১০ হাজার মেগাওয়াট। চলমান অন্যান্য বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে সারা দেশে বিদ্যুতের এই চাহিদা কমবেশি পূরণ করা হচ্ছে। মনিরুল ইসলামের মতে, দেশে আগের মতো আর লোডশেডিং নেই (বাস্তবতাও কিন্তু সেটাই)। দেশের প্রায় প্রতিটি প্রত্যন্ত অঞ্চলেই এখন বিভিন্নভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে (কমবেশি)।

প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, দেশের প্রক্রিয়াধীন বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে ২০৩০ সাল নাগাদ ৩৬ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালে ৫০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

এর মধ্যে শুধু মাতারবাড়ী থেকেই উৎপাদিত হবে ৬ হাজার মেগাওয়াট। মহেশখালী এবং মাতারবাড়ীর প্রকল্পগুলো থেকে মোট উৎপাদন লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫ হাজার মেগাওয়াট। উল্লেখ্য, মাতারবাড়ী ধলঘাটা ছাড়াও মহেশখালীর ইউনুসখালী, কালারমারছড়া এবং শাপলাপুরে বেশ কয়েকটি কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন প্রক্রিয়াধীন। এই সমন্বিত উদ্যোগ থেকে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে, সেই পরিমাণ বিদ্যুৎ ২০৪১ সালের বাংলাদেশ নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে উল্টো রপ্তানি করতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে।

এই দ্বীপে, ‘মাতারবাড়ী কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প’ ছাড়াও ‘কোহেলিয়া ৭০০ মেগাওয়াট আলট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল কোল ফায়ার্ড পাওয়ার প্ল্যান্ট’ নামে আরও একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলেছে বেশ কিছুদিন ধরেই। স্থানীয়ভাবে ‘সিঙ্গাপুর প্রকল্প’ নামে পরিচিত এই প্রকল্পে কয়লা এবং এলএনজি দিয়ে দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে।

বর্তমানে দায়িত্বরত প্রকল্প পরিচালক মনিরুল ইসলাম বলেন, তাঁদের প্রকল্পের নির্মাণাধীন সময়ে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য একটি সাবস্টেশন স্থাপন করা হয়েছে মাতারবাড়ীতে। এই সাবস্টেশন থেকে প্রজেক্ট ছাড়াও মাতারবাড়ী, বদরখালী ও মহেশখালীর কিছু অংশে ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে।

মনিরুল ইসলামের কাছে জানা গেল, আগামী বছরের শুরু থেকেই আরম্ভ হবে গভীর সমুদ্রবন্দরের (মাতারবাড়ী-সোনাদিয়া) নির্মাণকাজ। চট্টগ্রাম পোর্ট অথরিটি এই কাজের কর্ণধার। তারাই এই বন্দরের সব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে।

উল্লেখ্য, এর মধ্যেই নবনির্মিত এলএনজি টার্মিনাল থেকে (সোনাদিয়ার উল্টো দিকে বঙ্গোপসাগরে) চট্টগ্রামের আনোয়ারায় এলএনজি সরবরাহের কাজ শুরু হয়ে গেছে। এটাই এই মেগা প্রজেক্টের সমাপ্ত হওয়া প্রথম প্রজেক্ট।

শুধু রাস্তার মেরামতের কাজই নয়, এলজিইডি এবং রোড অ্যান্ড হাই ওয়েজ মহেশখালীর চাইল্যাতলী বাজার থেকে ‘মহেশখালী- মাতারবাড়ীর’ সংযোগস্থল রাজঘাট পর্যন্ত ছয় কিলোমিটার, এবং রাজঘাট থেকে ধলঘাটা পর্যন্ত সাত কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে, যা শিগগিরই শুরু হতে যাচ্ছে। অন্যদিকে, বদরখালী থেকে মহেশখালীর চাইল্যাতলী হয়ে ইউনুসখালী পর্যন্ত আরও একটি বিস্তৃত সড়ক তৈরি হতে যাচ্ছে। ইউনুসখালী থেকে নাক বরাবর মাতারবাড়ী প্রজেক্ট পর্যন্ত আরও একটি ব্রিজ তৈরি হবে, যার কাজ এ বছরের শেষ নাগাদ শুরু হতে পারে!

সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, মাতারবাড়ী ধলঘাটার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মধ্যে যাঁরা শ্রমজীবী কিংবা স্বল্প আয়ের মানুষ, তাঁদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে। সে অনুযায়ী মাতারবাড়ী কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের তত্ত্বাবধানে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সহযোগিতায় ৩০০ জন মানুষের দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ সমাপ্ত হয়েছে সম্প্রতি।

ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি পরিবার থেকে একজন করে সদস্য নিয়ে ছয় মাস মেয়াদের এই দক্ষতা বৃদ্ধির কোর্সে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রধানত সেলাই শিক্ষা, কম্পিউটারের বনিয়াদি প্রশিক্ষণ, ইলেকট্রনিকস রিপেয়ার, ওয়াল্ডিং এবং হাঁস–মুরগি পালন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এই প্রশিক্ষণশেষে অংশগ্রহণকারীরা নিজেরাই পেশা বেছে নিয়ে যে কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে সক্ষম হবেন। তবে এদের মধ্যে থেকে একজনকে মাতারবাড়ী কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পে কম্পিউটার অপারেটরের চাকরি দেওয়া হয়েছে বলে জানালেন মনির সাহেব।

সুযোগ পেয়ে আমিও একটি দাবী জানিয়ে বসি প্রকল্প পরিচালকের কাছে। বলি, দেখুন ১৯৬৫ সালে এ গ্রামে কোনো হাইস্কুল ছিল না বলেই আমাকে চট্টগ্রাম শহরে গিয়ে পড়াশোনা করতে হয়েছে। আজ মাতারবাড়ীতে একটি হাইস্কুল কোনো রকমে হয়েছে বটে। কিন্তু আজও কোনো কলেজ নেই মাতারবাড়ীতে। আমাদের এত আত্মত্যাগের বিনিময়ে হলেও কি আপনারা পারেন না আমাদের গ্রামে একটি কলেজ এবং একটি হাসপাতাল স্থাপন করে দিতে?

মনিরুল ইসলাম বললেন, রাজঘাট থেকে এক নম্বর গেট পর্যন্ত প্রকল্পের যে জায়গাটি আছে, সেখানে স্কুল, কলেজ ও হাসপাতালের বিষয়গুলো বাস্তবায়নের পরিকল্পনা আছে। শুধু তা–ই নয়, ওখানে খেলার মাঠ এবং চিত্তবিনোদনেরও ব্যবস্থা থাকবে!

তাঁর কথা শুনে আমি অনেক পুলকিত হই এবং অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে বলি—স্যার দেখুন, ১৯৫৫ সালে এই মাতারবাড়ী গ্রামে আমার জন্ম। এরপরে সামান্য বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে শুনে আসছি চট্টগ্রামের লোহাগাড়া থেকে আমাদের কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইনটি হয়ে যাবে, কিংবা এই হয়ে গেল বলে! কিন্তু জীবনের ৬৫টি বছর কেটে গেল—কক্সবাজারে আজও রেললাইনের দেখা পেলাম না! একটিবারের জন্যও হুইসেল বাজাল না সাধের রেলগাড়ি! এই দুঃখ কোথায় রাখি বলুন!

মনিরুল ইসলাম স্মিত হেসে বললেন, রেললাইনের দায়িত্ব তো আমাদের নয়, তবে কলেজ এবং হাসপাতাল আপনার জীবদ্দশাতেই দেখে যেতে পারবেন আপনাদের এই মাতারবাড়ীতে। শুনে আমি আগাম তৃপ্তির ঢেকুর তুলি!

পরে জেনেছি, প্রকল্প পরিচালকের কথিত স্কুল, কলেজ ও হাসপাতাল নাকি নির্মিত হবে শুধু প্রকল্পের কর্মকর্তা–কর্মচারীদের সন্তান এবং পরিবারবর্গের ব্যবহারের জন্য! ...তাহলে কি ওই স্কুল, কলেজ ও হাসপাতালের সেবা আমাদের মাতারবাড়ীর ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ মানুষের ভাগ্যে জুটবে না? আফসোস!

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভীষণ স্বাপ্নিক মানুষ। স্বপ্ন দেখেন ঠিকই, তাই বলে বাস্তবতাবর্জিত নয়! পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংক বিমাতাসুলভ আচরণ করেছে বলে প্রধানমন্ত্রী নিজ দেশের অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারেন, সেই দেশে ‘কিছু ত্রুটিবিচ্যুতির’ জন্য বিদ্যুৎ প্রকল্প আটকে থাকবে, এমনটি ভাবাই যায় না! নিশ্চয়ই তিনি বিষয়টি সুবিবেচনায় নিয়ে সমস্যা সমাধানের নির্দেশনা প্রদান করবেন।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন বাস্তবায়নে শেখ হাসিনা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বঙ্গবন্ধুকন্যার কাছে দেশের ১৬ কোটি মানুষের সীমাহীন প্রত্যাশা। বঙ্গবন্ধু ‘দেশের দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর’ চেষ্টায় জীবন উৎসর্গ করেছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা তাঁরই উত্তরসূরি। এর মধ্যেই বঙ্গবন্ধুকন্যা বাংলাদেশকে বিশ্বসভায় সম্মানের আসনে আসীন করতে সমর্থ হয়েছেন। বাংলাদেশের উন্নয়ন এখন সারা বিশ্বে ‘উন্নয়নের’ একটি অনুসরণীয় মডেল! বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরির হাতেই বর্তমান সময়ে দেশের অন্যতম চাহিদা ‘বিদ্যুৎ খাত’ তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাবে, এটাই সবার প্রত্যাশা।

* কাওসার চৌধুরী: প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক