জীবন এক হাওয়াই মিঠাই

ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

কবি রফিক আজাদ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আড্ডা আমার রক্তে, কবিতা আমার শিরা–উপশিরায়।’ এভাবে বলা, চিন্তা করার যোগ্যতা আমার নেই। তবে আড্ডা আমায় বড্ড টানে। সেই ছোটবেলায় শব্দটির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আগেই তাঁর সঙ্গে আমার নিত্য যোগাযোগ। যেন একসঙ্গে বসত যুগ–যুগান্তরের। প্রাইমারি স্কুলের ছোট ক্লাসে পড়ার সময় থেকে বাবা চাইতেন তাঁর তথাকথিত ভালো ছাত্র ছেলেটি বিকেলবেলা আয়েশ করে ঘুমালে রাতে লেখাপড়া করে রাজ্য উদ্ধার করবে। আমার চিন্তায় তখন, বাবা কখন ঘুমাবে আর আমি খালেবিলে টইটই করে বেড়াব আর দলবল নিয়ে পাড়াময় হইহুল্লোড় করে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আনব। জোয়ারের সময় ভরা খালের পানিতে পাড়ে বসে পা দুলিয়ে জলের সঙ্গে জলকেলি কিংবা খেতের আইলে হেঁটে হেঁটে কী কথা বলেছিলাম, তা এত দিনে আজ বিস্মৃতপ্রায়। তবে অনর্গল গালভর্তি শব্দচয়নে প্রয়োজন–অপ্রয়োজনের যে বালাই ছিল না, তা হলফ করে বলতে পারি। তবে সেই বিস্মৃত হারানো সুরের মাঝে আড্ডাটা মনের গোপন আলমিরায় আজও সযতনে রাখা আছে। একটু সুযোগ পেলেই অ্যান্টিকের কাঁসার পাত্রের মতো মেজে–ঘষে আবার চকচকে করার অদম্য বাসনা আজও পুষে রাখি পরান পিঞ্জিরায়। এভাবেই শৈশব ফিরে ফিরে আসে, মনের বয়স আর বাড়ে না, প্রাইমারির ছোট ক্লাসের গণ্ডিতে আটকা পড়ে থাকে।

প্রাইমারীর গণ্ডি পেরিয়ে শুরু হলো আমার হোস্টেল জীবন। চারদিকে নতুনের আনাগোনা আর শহরের চাকচিক্যের মধ্যে আমার বড় প্রাপ্তি, আমার স্বাধীনতা। পারিবারিক সব বাঁধাধরা নিয়মের বেড়াজাল ছিন্ন করে আড্ডার এক চমৎকার পরিবেশ। লালমোহন হাইস্কুল হোস্টেলে আমার কক্ষ হয়ে ওঠে আড্ডাবাজদের অভয়ারণ্য। কখনো স্কুলমাঠের সবুজ ঘাসে কিংবা মাঠ পেরিয়ে গ্যালারিতে চলত বিকেলের আড্ডা। ডাকবাংলোর পুকুরঘাট অথবা ছাদের অজানা আড্ডা আজও মনের কোণে উঁকি দেয় নীরবে নিভৃতে। পড়াশোনার নির্দিষ্ট সময় ছাড়া সময়–অসময়ে চলত অনির্দিষ্ট আড্ডা। কত কথা সে আড্ডায়! সমসাময়িক রাজনীতি, সিনেমা, নায়ক নায়িকা, শিক্ষক, লেখাপড়া কী বাদ ছিল সে আড্ডায়! আড্ডার সভ্যরা ছিল স্কুলবন্ধু। মাদক কিংবা ধোঁয়ার ধোঁয়াশা পরিবেশ ছিল না, তবুও নেশা ছিল সর্বান্তকরণে। আজও সেই আড্ডা হয়। কখনো ঐকতানের ব্যানারে, প্রাণে প্রাণে মিশে যাই ভালোলাগার এক অপূর্ব অবগাহনে।

কুয়োর ব্যাঙের স্বভাব আমার। জগৎ দেখার সুযোগ কম। নতুনকে কাছে টানার অদৃশ্যশক্তি যে আমার নেই। তবু আড্ডা আমায় ছাড়েনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছায়াসঙ্গী হওয়া পুরাতন সভ্যদের নিয়ে শুরু হয় নতুন স্থানে পুরাতনদের আড্ডা। বরিশাল ব্রজমোহন (বিএম) কলেজের হোস্টেল থেকে টাউন হলের সামনে ঘড়ির কাঁটা আড্ডার নিয়মে রোজ হিসেবে চলে। সম্মুখ বাস্তবজীবনের নান্দনিক হাতছানি কিংবা ভয়ের শত কারণেও চলে নিয়মতান্ত্রিক আড্ডা। নতুন জুটেছে কেউ, নতুন ভাবে। ইরান-তুরান আর ববিতা-সকিনা, সবাই ছিল আমাদের আড্ডায়। কত ছোট কথায় বড় রকম হেসেছি, তার কী আর ইয়ত্তা আছে!

সময়ের স্রোতে কতটা কেটেছে সময়? সেদিনের সেই খেলার সাথিরা আজ কত্ত বড় হয়েছে। নিজেরা আলোকিত হয়েছেন, সে আলোয় দীপ্তি ছড়িয়েছে অন্যদেরও মাঝে। বন্ধুরা এখন দেশ, কাল, সমাজে এক একজন এক একটা প্রতিষ্ঠান। হিসাবের বয়সে আমিও যে বড্ড এগিয়েছি। তবু পুরোনো ভূত আমায় ছাড়ে না। প্রেয়সীর গভীর আবেগে সাজানো সংসারে সোনার টুকরা ছেলে দুটো। প্রাত্যহিক কাজের রোজনামচা আর হাতে বাজারের ব্যাগ, দায়িত্ববোধের হাজারো ব্যস্ততার মাঝেও অতীতের সেই আড্ডার ব্যামো ক্রনিক ডিজিজের মতোই বহন করি। এ নিয়ে পথচলা কণ্টকময় ছিল আজীবনই। মা–বাবার হাজারো শাসন সহনীয় হয়েছিল ধীরে ধীরে। অন্যরা হয়তো নিজেদের উদারতায় মেনে নিয়েছে।

ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

কাজের ফাঁকে সামান্য সময় পেলেই আবার মিশে যাই সেই আড্ডায়। পুরোনো সাথিদের সঙ্গে যোগ হলো সস্ত্রীক আড্ডা, দল আরও ভারী হতে লাগল। কোনো একদিন ঢাকায় এসেছি মাত্র তিন ঘণ্টার জন্য। সেখানেও আড্ডা বাদ যায়নি। একজন তো ট্রাফিক জ্যাম এড়াতে এক ঘণ্টা পায়ে হেঁটে যোগ দিয়েছিল সেই আড্ডায়। অবাক করার মতো ব্যাপার যে আড্ডা দিতে আসা মানুষগুলো চিরকাল এমনই ছিল, এখনো আছে। ধানমন্ডি লেকের পাড়ে পা দুলিয়ে না বসে আসলে ঢাকা যাওয়া আমার বৃথাই, তা স্বজনমাত্রই জানে। হবু ডাক্তার বন্ধুকে আড্ডায় শামিল না করতে পারার অপরাধে শাস্তি হিসেবে বাংলা গালি চিরকাল একই আছে।

আমার আড্ডার চিরসঙ্গী আব্বা যেন বয়সের সঙ্গে কিছুটা ম্রিয়মাণ। রাতের খাবার পাটিতে কত কথা হতো! পারিবারিক, সামাজিক রাজনৈতিক সবই থাকত। প্রতিদিনের খবরাখবর একে অপরকে এক্সচেঞ্জ করে বেশ সময় কাটত আমাদের। ছোটবোনদের স্কুলের গল্প, পড়শিদের নানা ঘটনাপ্রবাহ কিছুই বাদ যেত না। আব্বার বয়স হয়েছে, আমারও। আজও রাতের খাবারে আমার জন্য অপেক্ষা করে। কিন্তু কেন যেন এক ছন্দপতন।

সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন হয়েছে আড্ডার ধরনের। মুঠোফোনের বাটন চেপে বেশ চলছে। রাতদুপুরে ফোন দিয়ে বলি, ঘুমিয়েছিস? ঘুমের ঘোরে অন্য প্রান্ত থেকে উত্তর আসে, কী ব্যাপার? এত রাতে কী? ‘না, জানতে চাই ঘুমিয়েছিস কি না, কনফার্ম হচ্ছি’। এরপর চলে কথা, কথার পিঠে কথা। কোন একসময় এক রমণী বলে ওঠে, আপনার মুঠোফোনে পর্যাপ্ত...।

বুকের দক্ষিণ পাশে ব্যথাটা বেশ বেড়েছে। চিকিৎসক বেশ আগেই বলেছে, রাত জাগা যাবে না। গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা বলে বেশ স্বস্তিতে আছি। বউ বলেছে, আমার নাকি হার্ট নামক কিছুই নেই। এতে রক্ষা সম্মুখ বিপদের সম্ভাবনা থেকে। অব্যক্ত কষ্টগুলোও মাঝেমধ্যে হানা দেয়। বয়স তো ঢের হয়েছে। মিজান চলে গেছে বেশ আগে। জাকিরের যাওয়ার সময়ও কম হয়নি। নাজিমের যাওয়ার ক্ষতে এখনো রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আমারও একদিন যেতে হবে। সেদিন প্রিয় এক সুহৃদ যখন নিজের জন্য কবরের জায়গার বন্দোবস্তের কথা ভাবছিল, ভেতরটা তখন মোচড় দিয়ে ওঠে। তবে এই ক্ষণিক জীবনের শত শত অপূর্ণতায়ও হৃদয় যখন চুপসে যায়, আড্ডার ক্ষণগুলো তখন বেশ ফুয়েল জোগায়। আড়মোড়া ভেঙে আবার জেগে উঠি। সামনে তাকাই, জীবনের সুদীর্ঘ পথ, আড্ডারা মনের ভেতর জোনাক পোকার মতো জ্বলে, হাতছানি দেয়, জীবনের জয়গান করে।

* কামাল হোসেন শাহিন, প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ, নাজিউর রহমান কলেজ, ভোলা