'হে প্রিয় পেঁয়াজ এবং ভিক্ষা চাই না মা, কুত্তা সামলান'

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

আমরা সবাই তো পেঁয়াজের দাম নিয়ে মহাচিন্তিত। মোটামুটি সব্বাই। তাই না....!! কিন্তু আমরা চাইলেই পেঁয়াজের দামকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করতে পারি! কীভাবে! উপায় যে সহজ তা নয়, কিন্তু জনগণ চাইলে আবার খুবই সহজ।

চলুন কিছু উদাহরণের মাধ্যমে আমরা সহজ ব্যাপারটি বোঝার চেষ্টা করি—

সে বছর প্রচুর বৃষ্টি হলো, ফলে ধানের বাম্পার ফলন হলো। বাজারে ধানের জোগান বেড়ে গেল, মানুষ রুটি খাওয়া বাদ দিয়ে ভাত খাওয়া শুরু করল। আটা কেনার বদলে চাল কেনা শুরু করল। যেহেতু ধান সবার ভালো হয়েছে, তাই সবাই বাজারে ধান বিকাচ্ছে। আড়তদার জোতদার যেখানে কম মূল্যে পাচ্ছেন, সেখানে কিনতে শুরু করলেন। কৃষকের নগদ টাকা দরকার। তিনি প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য অনেক কম দামে ধান ছাড়তে লাগলেন। ফলে ধানের দাম শুধু কমতেই থাকল। আবার যেবার প্রচুর খরা হলো, ধানের ফলন কমে গেল। বাজারে ধানের জোগান কমে গেল। যাঁর কাছে কিছু ধান আছে, তাঁর কাছে বহুজন ধরনা দিতে লাগলেন। তিনি ধান ছাড়লেন না। তাঁকে দেখে আরেকজনও ছাড়লেন না। ফলে ধানের দাম বেড়ে গেল। পাবলিক ভাতের বদলে আবার রুটি খাওয়া বাড়িয়ে দিল।

যত বেশি গরম বাড়তে লাগল, ফ্যান, এসির বিক্রি বাড়তেই থাকল। চাহিদা বাড়ার কারণে এক ধাক্কায় এগুলোর দাম বেড়ে দ্বিগুণ হলো। একই সময় রুম হিটারের দাম অনেকাংশে কমে গেল। তিনি বুদ্ধিমান, তাঁর হাতে টাকা ছিল, কম দামে রুম হিটার কিনে স্টক করতে শুরু করলেন। আবার শীত এলে তিনি রমরমা ব্যবসা করলেন। ঠান্ডা বাড়ল, এসি, ফ্রিজের চাহিদা কমে গেল, দামও কমে গেল।

আপেলের দাম অনেক কমে গেল। পাবলিক পেয়ারা খাওয়া বাদ দিয়ে আপেল খাওয়া শুরু করল। এর মধ্যেই বাজারে আম চলে এল। মানুষ আপেল খাওয়া বাদ দিয়ে আম খাওয়া শুরু করল। আপেলের ইমপোর্টাররা আমদানি কমিয়ে দিলেন। আপেলের দাম আবার বাড়তে শুরু করল।

মানুষ যখন জুতা পরা কমিয়ে দেয়, লস খায় মোজা কোম্পানি। যখন চা খাওয়া শুরু করে, ব্যবসা কমে কফি কোম্পানির। যখন প্যাকেটজাত তরল দুধ সহজলভ্য হলো, বেকার হলো গোয়ালা। কাচের পণ্য কম দামে পেতে শুরু হলে ধরা খেল মেলামিন। মোবাইল ফোনে ভালো ক্যামেরা পেতে থাকলে বড় ক্যামেরার প্রচলন কমে গেল। মানুষ ল্যাবে ছবি প্রিন্ট করার থেকে ছবি স্টোরেজে বেশি আগ্রহী হলো। হার্ডড্রাইভ, পেনড্রাইভ, ডিজিটাল অ্যালবামের ব্যবসা শুরু করল। পেনড্রাইভে এত হিউজ মেমোরি রাখা যাচ্ছে, ফ্লপি ডিস্কের ব্যবসা মরে গেল। বেতন বেড়ে গেলে একটা ল্যাপটপ কেনার সাধ হলো। নতুন চাহিদা সৃষ্টি হলো। বাড়িভাড়া বেড়ে গেলে আপনি বাজারে যাওয়ার হার কমিয়ে দিলেন।

একজন লেওনার্দো দা ভিঞ্চি নির্দিষ্টসংখ্যক ছবি এঁকে মারা গেলেন। তাঁর সেই নির্দিষ্টসংখ্যক আর্টকে বহুসংখ্যক মানুষ কিনতে আগ্রহী হলো। মাইক্রোসফটের বিল গেটস একটা বহু দামে কিনেছেন, তাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সাহেবেরও সাধ হলো তিনিও ভিঞ্চির কাজ কিনবেন। ফলে ওনার হিজিবিজি আঁকা ছবির মূল্যও সাধারণের হাতের নাগালের বাইরে চলে গেল।

ব্যবসা করবেন ভালো কথা, আপনি এমন সময়ে আমের জুস বাজারে আনলেন, যখন বাজারে সুস্বাদু আমই পাওয়া যাচ্ছে। মানুষ আম না খেয়ে আমের জুস খেতে যাবে কোন দুঃখে! আমের জুস সে সময়ই ভালো বিক্রি হবে, যখন বাজার থেকে আম উঠে যাবে। আপনাকে ব্যবসা করতে হলে আমের সিজন চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে অথবা বাজারে আমের কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে হবে।

চলুন প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের সংজ্ঞার মতো করে আমরা একটা অবাস্তব ও অসম্ভব আদর্শ পৃথিবীর কথা কল্পনা করি। যেখানে পৃথিবীর প্রতিটি দেশে সুখ, শান্তি আর স্বাচ্ছন্দ্য। এটা বলছি অসম্ভব কিন্তু পৃথিবীর যে নিজস্ব সম্পদ ও এর মাটির উৎপাদনক্ষমতা, প্রকৃতভাবে এর কোনো দেশে অভাব অনটন যুদ্ধ হওয়ার কথা নয়। যেখানে কোনো হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি, সন্ত্রাস, উগ্র জাতীয়তাবাদ, ধর্মান্ধতা কিছুই নেই। সেখানে কেউ কারও শত্রু নয়, কেউ কারও অমঙ্গল কামনা করে না।

তাহলে কী হবে!

পৃথিবী থেকে ব্যবসা নামক শব্দটি চিরতরে বিদায় নেবে। প্রতিটি দেশে সাম্যাবস্থা বিরাজ করবে। দেশে দেশে কোনো বড় ভাই, ছোট ভাই, ধনী, দরিদ্র, হতদরিদ্র, শক্তিধর, দুর্বল বলে কোনো বিভাজন রেখা থাকবে না! কেউ কারও মুখাপেক্ষী হবে না। কেউ কারও কাছে হাত পাতবে না। দুই দেশের মধ্যবর্তী সীমারেখার প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে। কারও মাথায় সীমান্ত দখলের চিন্তা আসবেই না। ফালানীরা মরবে না। গফুর, নিতাই কেউই আহত হবে না। যুদ্ধ হারিয়ে যাবে। পৃথিবী ভালোবাসা আর ভালো বাসায় পরিপূর্ণ হবে।

লিটারালি সম্ভব হলেও বাস্তবতা হলো কস্মিনকালেও এটা সম্ভব নয়। কেন?

যুদ্ধ না হলে আমার অস্ত্র কিনবে কে? যুদ্ধ শেষ হলে আমার অস্ত্র কিনবে কে। ধর্মের নামে মতান্তর না বাধাতে পারলে আমি তো আগামীর পৃথিবীতে নতুন কোনো যুদ্ধের আশঙ্কা দেখি না।

তোমার অন্তরাত্মাকে চিরতরে নপুংসক বানাতে হলে তোমার সন্তান, তোমার ভাই, তোমার আপনজন দিয়েই আঘাত করতে হবে তোমাদের। তোমার মস্তিষ্ককে বিশাল একটা শূন্য না বানাতে পারলে আমার মন্ত্র তুমি কেনইবা গ্রহণ করবে! খাবারে ভেজাল না মেশালে ঘন ঘন জ্বর, ক্যানসার, আলসার হবে না। আমার ওষুধ তবে অমন আকাশচুম্বী দামে তুমি কিনবে কেন! আমার এত বড় বড় কারখানায় ওষুধ বানাচ্ছি, ব্যান্ডেজ বানাচ্ছি, করপোরেট হাসপাতাল ক্লিনিক, ক্রাচ, হুইলচেয়ার বানাচ্ছি, পৃথিবী থেকে যুদ্ধবিগ্রহ হানাহানি চলে গেলে কেউ আহত হবে না, কেউ পঙ্গু হবে না, কেউ আর অসুস্থ হবে না।

পেঁয়াজ। ফাইল ছবি
পেঁয়াজ। ফাইল ছবি

আমার ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখতে যেকোনো মূল্যে অস্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে। আমার এত এত অস্ত্র কারখানা, এগুলো তো বিকাতে হবে নাকি! আমি এত এত সাবান, শ্যাম্পু, প্রসাধনী, সুগন্ধি তৈরি করছি চাহিদা তৈরি না করতে পারলে বাপু বেচব কার কাছে? তাহলে আগে নাওমি ক্যাম্পবেল, রোনাল্ডোকে, ক্যাটরিনা কাইফদের দিয়ে কোটি কোটি টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপন দাও। পাবলিক তা দেখে খুঁজে পণ্য নিয়ে যাবে। তোমার দেশে আমার সেনাবাহিনীকে ঢোকাতে হবে, কারণ তোমার তেলে আমার চোখ পড়েছে। সেগুলো আমার চাই। ঢুকতে হলে কী করতে হবে, প্রপাগান্ডা চালাতে হবে। হিটলার মহাশয়ের প্রপাগান্ডা মাস্টার এটাকে তো শিল্পের পর্যায়ে নিয়েও গিয়েছিলেন। তাঁর নামে শেষমেশ এর নামকরণও হয় গোয়েবলস প্রপাগান্ডা। তিনি বলতেন, একটা মিথ্যা কথাকে বিভিন্নভাবে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বিভিন্ন জনপ্রিয় প্রচারমাধ্যমে বলতে থাকো, একসময় দেখবে সত্য হারিয়ে গেছে, মিথ্যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিষয়টি আসলেই তো তাই। পশ্চিমা গণমাধ্যম বারবার প্রচার না করত সেখানে জীবাণু অস্ত্র আছে, তাহলে পৃথিবীবাসীকে আক্রমণের কী জবাব দেওয়া হবে!

শুরুর কথায় ফিরে আসি, পেঁয়াজ। এই সামান্য বিষয়ের দাম বাড়ল বলে আজ তোমাদের কী টেনশন। সেই পেঁয়াজওয়ালাদের উপযুক্ত জবাব দিতে চাইলে সবাই পেঁয়াজ খাওয়া, কেনা বন্ধ করে দেন। বেশি দিন না, মাত্র দিন পনেরো। পেঁয়াজ গুদামে যখন পচতে শুরু করবে, তখন দেখবেন বাজার পেঁয়াজ আর পেঁয়াজুতে সয়লাব হয়ে গেছে। আর দাম! পেঁয়াজপতিরা তখন আপনার হাতে-পায়ে ধরে বলবে, ‘ভিক্ষা চাই না মা, কুত্তা খেদাও। তবু পেঁয়াজ কিনুন’।

*মেহেদী হাসান তামিম: কবি ও কথাসাহিত্যিক