শিশুদের ভালোবেসে চলেছেন তিনি...

লোকটির সঙ্গে প্রায়ই দেখা হয়। বাসায় ফেরার পথে। তিনিও তখন ঘরের পথে। কাঁধে কাপড়ের থলে ঝোলানো। হাতে একপ্রস্থ বাচ্চাদের বই। রংবেরঙের বর্ণের, ছড়ার, ছবির বই। বাংলা-ইংরেজি বই। আছে পাখি আর ফুলের বই। মাছ চেনার বইও আছে কয়েকটি।

আমার ছেলেটার বয়স এক বছর পুরো হয়নি। বসতে পারে। খেলনা নিয়ে খেলতে পারে। আর সুযোগ পেলে আমার বইও চলে যায় তার কবজায়। একবার বই নজরে পড়লে তখন খেলনা হয় অপাঙ্‌ক্তেয়। বই-ই তার চাই। কান্না জুড়ে দেয়। টেনে নিয়ে যায়। প্রথম কয়েক দিন তার হাতে বই দিয়েছিলাম দেখতে, কী করে। ওই তো আর সবাই যা করে, ভাবছেন পড়ে? না। ছিঁড়ে কুটি কুটি। মুক্তোর মতো দুটি দাঁত মুখের নরম ত্বক ফুঁড়ে উঠেছে। তা দিয়ে কামড়ে ধরে বইয়ের পাতা ছেঁড়ে। হাতে টেনে ছেঁড়ে।

বই কেড়ে নিলেও কাঁদে। ঘরের বইয়ের তাকগুলোর দিকে তার ঝোঁক। ভাবলাম, কী করা যায়। ওই ভাবনা থেকে একদিন দুটি ল্যামিনেটেড বই (প্লাস্টিকে মোড়ানো) কিনে আনলাম। স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণের। সেই থেকে পথে পরিচয় বই ফেরি করে বেড়ানো লোকটার সঙ্গে। ছেলে আমার বই হাতে পেয়ে তো খুব খুশি। পড়তে বসে গেল। বিস্ময়কর হচ্ছে, প্রথম দুদিনেই বই দুটি শেষ। কী, পড়ে? না না, তেমন কিছু না। প্রথমে টেনেটুনে ছিঁড়ে ফেলল। তারপর জলবিয়োগে শেষ হলো।

এর পরের দিন আবার সেই বই ফেরি করে বেড়ানো মানুষটার সঙ্গে দেখা। প্রথম দিন থেকে একটা ভাবনার সূচনা হয়েছিল মনে, বাচ্চাদের বই বেঁচে কয় টাকাইবা আয় করেন তিনি? তা দিয়ে কি চলে সংসার? স্ত্রী, ছেলেপুলে, আছে নিশ্চয়ই। বয়স তো মাঝগগনে। এ দিয়ে কী করে হয়? কয়েক দিন ভেবেছি, কথা বলব তাঁর সঙ্গে। সময়-সুযোগ কোনোটাই হয় না। সেদিন তাঁর কাছ থেকে সময় চাইলাম। বললাম, ‘বই বেচে কয় টাকা থাকে? সংসার চলে?’

তিনি মৃদু হাসলেন। হাতের বইগুলো গোছাতে গোছাতে বললেন, ‘এ দিয়ে কি হয়?’
‘তাহলে? এটা কেন করছেন?’
‘ভালো লাগে তাই।’
আশ্চর্য! এ যুগেও এমন মানুষ আছে নাকি? শুধু ভালো লাগা থেকে এমন কম আয়ের ব্যবসায় কেউ থাকে? বললাম, ‘বিয়েথা করেননি?’
হেসে বললেন, ‘জি, এক ছেলে, এক মেয়ে।’
‘বাহ্। বেশ। ওরা কি স্কুলে যায়?’
‘মেয়ে যায়। ক্লাস টুতে পড়ে। ছেলেটার বয়স তিন বছর। আগামী বছর বা তার পরের বছর দিব স্কুলে।’
জানতে চাইলাম, ‘থাকেন কোথায়?’
‘মিরপুরে।’
‘ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ কী করে চলে?’
বললেন, ‘সকালে একটা গার্মেন্টসের ওয়ার্কশপে সহকারী হিসেবে কাজ করি। কাজ করলে বেতন। না করলে নেই।’
এবার একটু আশ্বস্ত হলাম যে বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা তাঁর আছে। বললাম, ‘ভালো। শুধু বই বিক্রি করে তো আর কেউ চলতে পারে না।’
‘জি। তবে আমি কিছু না করলেও বই বিক্রি ছাড়তে পারব না।’
অবাক হয়ে বললাম, ‘কোনো বিশেষ কারণ আছে?’
বললেন, ‘জি।’

‘আমায় বলা যাবে?’

শুরু করলেন, ‘ছোটবেলায় আমাদের পারিবারিক অবস্থা ভালো ছিল না। নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। বাবা একা আয় করেন। নওগাঁয় আমাদের গ্রামের বাড়ি। আমরা সাত ভাইবোন। এত বড় সংসারে সবার পেটে খাবার জোগানোই তাঁর জন্য কষ্টের ছিল। পড়াশোনা ছিল বিলাসিতার মতো। ছোট সময় তো অত কিছু বুঝতাম না। দেখতাম, খেলার সাথিরা বই পড়ে। আমিও পড়তে চাই। একটা বই কিনে দেওয়ার জন্য বাবার পেছনে পেছনে ঘুরে বেড়াই। বাবা অসহায়। তিনি ছেলের আবদার রাখতেও পারছিলেন না। আবার না-ও করতে পারছিলেন। বারবারই বলতেন, দেব। কদিন যাক। হাতে টাকা আসুক। বাবার হাতে আর টাকা আসে না। আমারও আর বই কেনা হয় না। আমাদের এক প্রতিবেশীর বাড়ি ছিল রাস্তার পাশে। মাটির বাড়ি। রাস্তার পাশে জানালা। তার ওপাশে টেবিল। একদিন কাউকে কিছু না বলে জানালা দিয়ে একটা ছড়ার বই নিয়ে আসি। বাড়িতে এলে আমার হাতে বই দেখে মা বলেন, কী রে, বই পেলি কোথায়? আমি সত্যি কথা বলে দিই। চুরি করেছি শুনে মা আমায় সেদিন খুব পেটান। তারপর বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যাই। দীর্ঘদিন বাড়ি ফিরে যাইনি। তখন বয়স পাঁচ কি ছয় বছর হবে। আশপাশে বিভিন্ন জেলায় ঘুরেছি। একদিন বগুড়ায় আমাদের গ্রামের এক পরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে দেখা। তার সঙ্গে গ্রামে ফিরে যাই। সবাই আমাকে দেখে চমকে ওঠে। প্রায় তিন মাস আমি বাড়ির বাইরে ছিলাম। মা-বাবা আমায় খুঁজতে খুঁজতে একসময় আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। মা অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়েছিলেন। আমি বাড়ি ফিরলে তিনি কোনোমতে শরীর টেনে উঠে বসেন। আমার গা-হাত-পায়ে হাত বুলিয়ে দেন। তার চোখে সেদিন বেনোজলের মতো অশ্রু।’

লোকটির গলা ধরে এল। তিনি কিছুটা সময় নিলেন থিতু হওয়ার জন্য। তারপর বলতে লাগলেন, ‘যা–ই হোক, তার এক বছর পর বাবা আমায় স্কুলে দিয়েছিলেন। তবে পড়াশোনা বেশি দূর এগোয়নি। এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর বাবাকে হারালাম। ভাইবোনের মধ্যে আমার অবস্থা ছিল পঞ্চম। ওপরের চারজনের দুজন ভাই। দুজন বোন। বড় ভাই দুজন আগে থেকেই গ্রামে বিভিন্ন কাজকর্ম করতেন। খেতখামার নিয়ে থাকতেন। কম হলেও আমার ওপরও এল সংসারের বোঝা। কিছু তো করে খেতে হবে। গ্রামে চাষবাসে আমার মন টানছিল না। ঢাকায় এলাম কাজের খোঁজে।’

আমি বললাম, ‘ঢাকা এসে কি কাজের সন্ধান পেলেন?’
তিনি বললেন, ‘ঢাকায় তো কাজ পাওয়া সহজ নয়। কী করব ভাবতে ভাবতে একদিন দেখলাম, বাসে একজন বুড়ো মানুষ বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় বই বিক্রি করছেন। দু-একটি বিক্রিও হচ্ছে। আমিও চিন্তা করলাম, এমন কিছু করা যায় কি না। তখনই মাথায় এল শৈশবের সেই ছড়ার বইয়ের কথা। ভাবলাম বাচ্চাদের বই বিক্রি করলে কেমন হয়? একটি বই বিক্রি মানে একটি শিশুর হাতে বই পৌঁছে দেওয়া। এতে যেমন কিছুটা অর্থের চাহিদা মিটবে, তেমনি শিশুদের হাতে বই পৌঁছে দেওয়ার আনন্দটাও মিলবে। খুঁজে খুঁজে পৌঁছে গেলাম বাংলাবাজারে। ১০০ টাকা সঙ্গে ছিল। ১০০ টাকায় ১০টি বই কিনে যাত্রা হলো। বই থেকে সামান্য যা পেতাম, তা দিয়ে নিজের খাওয়া-পরা চলত। কিন্তু একটা সময় যখন বাড়ির জন্য পিছুটানটা বাড়ল, ছোট বোন দুটির বিয়ে দেওয়ার সময় হলো, মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন, তখন সিদ্ধান্ত নিলাম, পাশাপাশি কিছু করতে হবে। অন্য কাজ খুঁজে করতে লাগলাম। কিন্তু বই বিক্রি ছাড়িনি। এখনো যে সময় বই বিক্রিতে দিই, তা অন্য কোথাও দিলে মাসে ভালো টাকা আয় হতো। আমার কাছে মনে হয়, টাকা আয়ের চেয়ে মনের খোরাকটাও বড় ব্যাপার।’

মানুষটির জীবনের দীর্ঘ গল্প শোনার পর আমার চোখটাও কেমন চকচকে হয়ে উঠল। এই যুগেও এমন মানুষ আছে! তাঁর কাছ থেকে দুটি বই কিনে দাম মিটিয়ে বললাম, ‘শিশুদের জন্য আপনার এই ভালোবাসার কোনো প্রতিদান হয় না। জ্ঞানের আলো নিয়ে আপনি এগিয়ে যান। এখনো যে অনেক অন্ধকার পথ পাড়ি দেওয়া বাকি। আপনাদের মতো মানুষ আছে বলেই বাংলাদেশ নিয়ে আমরা গর্ব করি।’

তাকিয়ে দেখি লোকটির চোখের টলটলে জলে ল্যাম্পপোস্টের আলো পড়ে কেমন আভা ছড়াচ্ছে। তিনি কিছু বললেন না। বাড়ির পথে হাঁটতে লাগলেন।

*সম্প্রতি সুনামগঞ্জের শিশু তুহিন মিয়াকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। তার দুটি কান কেটে নিয়েছে হন্তারকেরা। এখানেই শেষ নয়। পেটে দুটো ছুরি গেঁথে দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছে গাছে। এই ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। গণমাধ্যমে খবর হয়েছে। শিশুদের প্রতি এমন নির্মমতার কোনো ভাষা নেই। অথচ বইয়ের ফেরিওয়ালা লোকটি শিশুদের ভালোবেসে বই ফেরি করে ফিরছেন। মানুষে মানুষে কত তফাত! লোকটিকে নিয়ে লিখতে চাই জানালে, তিনি বললেন, ছবি ও নাম প্রচারে তাঁর সম্মতি নেই।