'ক্লাস ফান্ড'-এর বন্ধুতা শেখাক মানবতা

সরকারি স্কুলের শিক্ষার্থীরা।
সরকারি স্কুলের শিক্ষার্থীরা।

ছেলেটার নাম ইব্রাহীম (ছদ্মনাম)। ঢাকার একটি সরকারি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। তার পরীক্ষার ফি ৩০ টাকা। শেষ দিনে ২০ টাকা নিয়ে ক্লাস শিক্ষকের কাছে যায়। কাঁদো কাঁদো চেহারা নিয়ে বলে, ‘ম্যাডাম, আমার বাবা বাড়িতে আসে না। মায়ের কাছে টাকা নাই। আমি প্যারাক (লোহার পেরেক) কুড়ায় এই ২০ টাকা আনছি। নিবেন ম্যাডাম?’

সেই ম্যাডাম মুখ দিয়ে কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে পারেননি। বাসায় এসে কষ্টটা হালকা করেছেন ছোট বোনকে সেই বাচ্চাটার কথা শুনিয়ে।

রুমিনা, পড়ে সপ্তম শ্রেণিতে। বয়স ১৪। বারা মারা গেছে গত বছর। মা অসুস্থ। কিছু করতে পারে না। দরিদ্র দুলাভাই মাসে ১ হাজার ৫০০ টাকা দেন। সেই টাকা দিয়েই চলে চারজনের সংসার। মেয়েটা শেষ পর্যন্ত পোশাক খাতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। ২ হাজার ৮০০ টাকা বেতন। হাড়ভাঙা খাটুনি‍। মা স্কুলে এসে তার কাছের শিক্ষকের কাছে কান্নাকাটি করেন। রুমিনার স্কুলে আসা বন্ধ হয়ে যায়। সৌভাগ্য বলতে এটাই যে ওর পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগটা হয়েছে!

জেএসসি পরীক্ষার্থী সুরাইয়ার বয়স ১৫। জেএসসির দোরগোড়া পর্যন্ত পৌঁছাতে গিয়ে অন্তত তিন–চারবার ওর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। একবার বিয়ে দেওয়ারও চেষ্টা হয়েছে। থাকে সৎমায়ের সংসারে। মেয়েটার গায়ে মাঝেমধ্যেই মারের দাগ পাওয়া যায়। কতটা কষ্টে ও পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে, দেখতে পারলে নিজের অবস্থার জন্য আপনি পরম করুণাময়ের কাছে শুকরিয়া আদায় করে শেষ করতে পারবেন না।

ক্লাসের শিক্ষার্থীদের টিফিনের অর্থ বাঁচিয়ে ‘ক্লাস ফান্ড’ গঠন করা হয়েছে।
ক্লাসের শিক্ষার্থীদের টিফিনের অর্থ বাঁচিয়ে ‘ক্লাস ফান্ড’ গঠন করা হয়েছে।

শেষে যে দুজন বাচ্চার কথা বললাম, এরা আমার স্কুলের শিক্ষার্থী। দেশের সরকারি স্কুলগুলোতে খোঁজ নিলে এমন অনেক শিক্ষার্থীর দেখা মিলবে। এদের মধ্যে যারা একটু বড় হয়ে গেছে, তাদের আত্মসম্মান জ্ঞান আপনাকে নাড়িয়ে দেবে। ওরা না খেয়ে স্কুলে আসবে আপনি জানবেন না। যেদিন লো প্রেশারে দুর্বল হয়ে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাবে অথবা প্রচণ্ড পেটব্যথা নিয়ে ছুটি চাইতে আসবে, তখন সেটা ধরা পড়বে!

এগুলো আমাদের সমস্যা। আমরা পুরোপুরি সমাধান করতে না পারলেও কিছুটা চেষ্টা তো চালাতে পারি! একটা কথা আছে, ‘somebody can't help everybody, but all together can help somebody।’ এ লক্ষ্যেই আমাদের এগিয়ে চলা। বিদ্যালয়ের নামটা এখানে গৌণ। কাজটাই মুখ্য। আমরা একটা প্রোগ্রাম করেছি। নাম ‘ক্লাস ফান্ড’। এখানে একটা ক্লাসের শিক্ষার্থীরা যতজন পারে স্বচ্ছায় মাসের যেকোনো এক দিন (২৫ তারিখের মধ্যে, এর মধ্যে অপারগ হলে যে মাসে পারবে সে মাসে দেবে, না পারলে দেবে না, সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছা)। ওদের এক দিন টিফিন করার টাকাটা ক্লাস ক্যাপ্টেনের হাতে তুলে দেবে। এরপর সেই টাকাটা দিয়ে ওদের ক্লাসেরই কোনো বন্ধুকে কিনে দেওয়া হবে বই, খাতা বা প্রয়োজনীয় কোনো জিনিস, যেটা পড়ালেখায় কাজে লাগবে। পরীক্ষামূলকভাবে সপ্তম শ্রেণির দুটি ক্লাসে আমরা এটা শুরু করি। ‘ক’ শাখা থেকে ওঠে প্রায় ৫০০ এবং ‘খ’ শাখা থেকে ওঠে প্রায় ৭০০ টাকা। এই টাকা দিয়ে ক্লাসের দুজন করে মোট চারজন শিক্ষার্থীকে কিনে দেওয়া হয় গ্রামার বই আর খাতা।

‘ক্লাস ফান্ড’–এর অর্থে দারিদ্র্য শিক্ষার্থীদের সহায়তা দেওয়া হয়।
‘ক্লাস ফান্ড’–এর অর্থে দারিদ্র্য শিক্ষার্থীদের সহায়তা দেওয়া হয়।

শিক্ষার্থীদের সেই অনুভূতি আমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। আমরা শুধু ওদের বলি, ভালো কাজ করো, ভালোভাবে চলো ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু ভালো কাজ করলে কেমন অনুভূতি হয়, সেটা ওদের বোঝানোর সুযোগ করে দিতে কতটুকু পেরেছি, তা ওরাই ভালো বলতে পারবে। ওদের অনুভূতি অবর্ণনীয়। হই হই করে হাততালি দিয়ে যে বই–খাতা পেল তাকে ওরা অভিনন্দন জানাল। এ যেন সহায়তার হাত বাড়ানো নয় বরং পুরস্কার! আর যে পেল, তার কৃতজ্ঞতা মাখানো হাসিমুখটাও ছবিতে বাঁধাই করে রাখার মতো। শিক্ষক হিসেবে এটাই প্রার্থনা—ওরা এভাবেই মানবতার পথে এগিয়ে চলুক!

বাংলাদেশের অন্তত এক হাজার বিদ্যালয়েও যদি এমন ক্লাস ফান্ডের ব্যবস্থা থাকে, তবে প্রতি মাসে কম করে হলেও এক হাজার দরিদ্র শিক্ষার্থী ওদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে কিছুটা হলেও সহায়তা পাবে। আর যারা এ কাজে শামিল হবে, তারা পাবে ভালো কিছু করার অনুপ্রেরণা। এভাবেই গড়ে উঠবে আসল বন্ধুত্ব। জয় হবে মানবতার। এগিয়ে যাবে দেশ।

*লেখক: সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক