সাংস্কৃতিক অর্থনীতিতে টিভি চ্যানেলের ভূমিকা

‘সুলতান সুলেমান’ সিরিয়াল বাংলা ডাব করে দেখানো হয়। বেশ জনপ্রিয়তাও পায় সিরিয়ালটি। ছবি: সংগৃহীত
‘সুলতান সুলেমান’ সিরিয়াল বাংলা ডাব করে দেখানো হয়। বেশ জনপ্রিয়তাও পায় সিরিয়ালটি। ছবি: সংগৃহীত

‘সুলতান সুলেমান’, ‘ইউসুফ জুলেখা’ ইত্যাদি টিভি সিরিয়ালসহ বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল সম্প্রচার করছে। এসব আমাদের দেশের দর্শকমহলে জনপ্রিয়তাও পেয়েছে বেশ, এমনকি জাতীয় দৈনিকগুলো এর কিছু পর্ব নিয়ে সংবাদ বা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিল ‘ম্যাকগাইভার’ও। ছবি: সংগৃহীত
জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিল ‘ম্যাকগাইভার’ও। ছবি: সংগৃহীত

সাম্প্রতিক সময়ে লক্ষণীয় যে ভিনদেশি সিরিয়াল বা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র প্রচারের ভয়ংকর প্রতিযোগিতায় নেমেছে টিভি চ্যানেলগুলো! আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির বিকাশ এবং সাংস্কৃতিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে এটি ঋণাত্মক প্রভাব ফেলছে। যদিও বিশ্বায়নের এই যুগে দর্শক-শ্রোতা কী দেখবেন বা শুনবেন তা নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব প্রায়। তবুও টিভি চ্যানেলগুলোর কিছু দায়িত্ব–কর্তব্য রয়েছে অনুষ্ঠানগুলো নির্ণয়ের ক্ষেত্রে, যা তারা প্রচার করতে চায়। সে দৃষ্টিকোণ থেকেই এ বিষয়ে কিছু বক্তব্য তুলে ধরা যেতে পারে।

‘সুলতান সুলেমান’ বা ‘ইউসুফ জুলেখা’ বা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্রের আগেও আমাদের দেশের দর্শক-শ্রোতা ভিনদেশি অনেক সিরিয়াল বা চলচ্চিত্র টিভির পর্দায় দেখেছেন যেমন ‘আলিফ লায়লা’, ‘ম্যাকগাইভার’, ‘টাইটানিক’ ইত্যাদি। কিন্তু বর্তমানে এসব প্রচার করার প্রবণতা আমরা টিভি চ্যানেলগুলোর মাঝে যেভাবে দেখছি তা কোমর বেঁধে নেমে পড়ার মতোই। এ ক্ষেত্রে সমস্যাটি হলো, সাংস্কৃতিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার ভয়াবহতা!

‘সুলতান সুলেমান’–এর জনপ্রিয়তা এতই বেশি ছিল যে পরে আবার প্রচার শুরু করে বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো। ছবি: সংগৃহীত
‘সুলতান সুলেমান’–এর জনপ্রিয়তা এতই বেশি ছিল যে পরে আবার প্রচার শুরু করে বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো। ছবি: সংগৃহীত

প্রথমত, সাংস্কৃতিক অর্থনীতি সমৃদ্ধ করতে হলে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির যথাযথ বিকাশ করতে হবে। আর এসব তাই আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং বিকাশের জন্য অন্যতম প্রতিবন্ধক। তবু কেন আমরা এগুলো প্রচার এমনকি প্রসারে ভূমিকা রাখছি? দর্শকের কাছে জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য! এটি ভুল ব্যাখ্যা। কারণ, আপনারা নিশ্চয় ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘রূপনগর’ ইত্যাদিসহ পুরোনো দিনের বিভিন্ন বাংলা ছবির কথা ভুলে যাননি। আসলে বিষয়টি মানের সঙ্গে সম্পর্কিত। মানসম্পন্ন সব অনুষ্ঠানই দর্শকপ্রিয়তা পায় এবং সংগত কারণে সেই চ্যানেলটির জনপ্রিয়তাও বেড়ে যায়। সুতরাং নির্মাতাদের মানসম্পন্ন অনুষ্ঠান নির্মাণ করতে হবে। এখন হয়তো অনেকে বলতে পারেন, মানসম্পন্ন অনুষ্ঠান নির্মিত হচ্ছে না বলেই এসব চ্যানেলে ভিনদেশি অনুষ্ঠান দর্শকপ্রিয়তা পাচ্ছে। এটিও আংশিক মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু এভাবেই যদি চলতে থাকে, তাহলে তো কিছুদিন পর আর কোনো দেশি অনুষ্ঠানই খুঁজে পাওয়া যাবে না! সুতরাং প্রতিযোগিতা হওয়া উচিত দেশীয় অনুষ্ঠান নির্মাণের মানোন্নয়ন এবং দেশীয় কলাকৌশলীদের উৎসাহ দেওয়ার ব্যাপারে। আর চ্যানেলগুলোই এর প্রধান পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকা পালন করবে এটাই কাম্য।

‘কোথাও কেউ নেই’ নাটক প্রচারের সময় বাকের ভাই চরিত্রটি নিয়ে আলোচনা ছিল সব সময়। ছবি: সংগৃহীত
‘কোথাও কেউ নেই’ নাটক প্রচারের সময় বাকের ভাই চরিত্রটি নিয়ে আলোচনা ছিল সব সময়। ছবি: সংগৃহীত

আরেকটি বিষয় হলো, সংস্কৃতির সঙ্গে সরাসরি অর্থনৈতিক সম্পর্ক। দেশীয় অনুষ্ঠানগুলোতে হয়তো তারা বিজ্ঞাপন কম পায় বা বিনিয়োগ কম হয়, যা চ্যানেলগুলোর জন্য লাভজনক নয়। এ জন্য কি মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া উচিত হবে? বরং ভিনদেশি অনুষ্ঠানগুলোর পেছনে ব্যয় হয়তো কম নয় এবং এসব আমদানি করতে গিয়ে দেশের অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে। চূড়ান্ত হিসেবে সাংস্কৃতিক অর্থনীতির জন্য এটি লোকসানই বটে! আমাদের প্রতিবেশী ভারতের দিকে তাকালে দেখা যায়, তাদের সাংস্কৃতিক অর্থনীতি বেশ সমৃদ্ধ। তারা বিভিন্ন দেশে তাদের সংস্কৃতি রপ্তানি করছে। এই অর্জনে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা এবং নিজস্ব সংস্কৃতির ব্যাপক মানোন্নয়নসহ তাদের টিভি চ্যানেলগুলোর ভূমিকা অনস্বীকার্য।

ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় সিরিয়াল ‘কাহানি ঘর ঘর কি’। ছবি: সংগৃহীত
ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় সিরিয়াল ‘কাহানি ঘর ঘর কি’। ছবি: সংগৃহীত

সুতরাং, আমাদের সাংস্কৃতিক অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে ভিনদেশি সংস্কৃতি প্রচারের ভয়ংকর প্রতিযোগিতা থেকে সরে আসতে হবে টিভি চ্যানেলগুলোকে। নিজস্ব সংস্কৃতির মানোন্নয়ন, প্রচার এবং প্রসারে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবেই বলতে পারি, এ কাজে দেশের দর্শক-শ্রোতারা অবশ্যই আপনাদের সঙ্গে থাকবে সব সময়।