হারাতে বসেছে শত বছরের ঐতিহ্য: প্রসঙ্গ 'লাঠিখেলা'

ফুলবাড়িয়ার কুশমাইল গ্রামে সম্প্রতি হওয়া একটি লাঠিখেলার দৃশ্য। ছবি: লেখক
ফুলবাড়িয়ার কুশমাইল গ্রামে সম্প্রতি হওয়া একটি লাঠিখেলার দৃশ্য। ছবি: লেখক

বাঙালিয়ানার শিকড় অনুসন্ধান করতে গেলে আমাদের জীবনে লোকসংস্কৃতির এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব লক্ষ করা যায়। সেই সংস্কৃতির বড় এক অংশজুড়ে আছে খেলাধুলা। যার মধ্যে গ্রামগঞ্জে অন্যতম জনপ্রিয় একটি—লাঠিখেলা। তবে কালের বিবর্তনে নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের লোকজ সংস্কৃতির এই অমূল্য সম্পদটি ক্রমেই হারাতে বসেছে। মাঠ বিদেশি খেলার দখলে যাওয়ায় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এই খেলা থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লাঠিয়ালেরাও।

এই লাঠিখেলা প্রায় দেড় শ বছর ধরে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে চলে আসছে। সাধারণ মানুষ তার চিত্তবিনোদনের খোরাক হিসেবে বেছে নিয়েছিল এই অনুষঙ্গকে। যা কিনা কালের গর্ভে আজ প্রায় বিলীনের পথে। লাঠিখেলা জানা থাকলে জীবনে নানা প্রতিকূল পরিবেশ থেকে বেঁচে আসা যায়—এমনটাই দাবি লাঠিয়ালদের।

জানা যায়, আমন ধান কাটার পর কৃষকের ঘরে তেমন কোনো কাজ থাকে না। এই অবসরে পবিত্র আশুরাকে ঘিরে লাঠিখেলার মহড়া চালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তাঁরা। ফুলবাড়িয়ার বিভিন্ন এলাকায় এখনো টুকটাক এই খেলার আয়োজন হয়ে থাকে। খেলার দিন রংবেরঙের পোশাক পরে শারীরিক কসরত দেখিয়ে লাঠিয়ালেরা দর্শকদের বিনোদন দিয়ে থাকেন।

বৈশালী, পাশের বাড়ি, মৃত্যু বাড়ি, পিরি পাইট, বেনিয়ম, শেয়াল ধরা ইত্যাদি ধরনের খেলা দেখান লাঠিয়ালেরা।

লাঠিখেলা দেখানোর জন্য লাঠিয়াল দলের মধ্যে থাকেন একজন করে ওস্তাদ। এমনি এক লাঠিয়াল ওস্তাদের খোঁজ মেলে উপজেলার পুটিজানা ইউনিয়নের বিড়াল শাহ খামার বাড়িতে। তাঁর নাম শামছুল হক (৭০)। তিনি ১৩ বছর বয়স থেকে লাঠিখেলা শুরু করেন। এর আগে তাঁর বাপ-দাদা, এমনকি তাঁর দাদার দাদারা পর্যন্ত এই খেলা খেলে আসছেন বলে তিনি জানান। তাঁদের পরম্পরার শেষ বংশধর হিসেবে শামছুল হক এই বৃদ্ধ বয়সে এসেও খেলাটি ধরে রেখেছেন। শামছুল হকের রয়েছে ৩০ সদস্যের একটি লাঠিয়াল দল।

লাঠিখেলার নিয়ম সম্পর্কে শামছুল হক বলেন, লাঠিখেলায় সাধারণত ২৫ থেকে ৩০ জন লাঠিয়াল প্রয়োজন। জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে খেলাটির সূচনা হয়। মূলত নয়টি ধাপে খেলাটিকে ভাগ করা হয়।

শামছুল হক বলেন, লাঠিখেলার প্রথম ধাপ হলো, দুজন খেলোয়াড় (এক গ্রুপ) আড়াই হাত লম্বা একটি করে লাঠি নিয়ে খেলেন। দ্বিতীয় ধাপে দুজন খেলোয়াড় একই মাপের পাঁচটি করে লাঠি নিয়ে খেলা দেখান। তৃতীয় ধাপে চারজন (দুই গ্রুপ) একটি করে লাঠি নিয়ে খেলা দেখান। চতুর্থ ধাপে চার থেকে সাড়ে চার হাত লম্বা একটি করে লাঠি নিয়ে দুই গ্রুপের চারজনকে খেলতে হয়। পঞ্চম ধাপে প্রতি খেলোয়াড় দুই হাতে দুটি করে লাঠি নিয়ে বিভিন্ন অঙ্গ ভঙ্গিমায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খেলা দেখান।

শামছুল হক জানান, লাঠিখেলার বিশেষ আকর্ষণ থাকে ষষ্ঠ ধাপে; একজন খেলোয়াড় দুই হাতে দুটি রামদা নিয়ে এলোপাতাড়ি ঘোরাতে থাকবেন। একই লাঠিয়াল আরও একটি খেলা দেখান, যার নাম চরকা বানডি; যেখানে চারটি ধারালো চাকু কাঠির সাহায্যে বেঁধে একই ভঙ্গিমায় ঘোরাতে থাকেন। সর্বশেষ ধাপে সব লাঠিয়াল একত্র হয়ে বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে নৃত্যের মাধ্যমে যে যাঁর মতো করে খেলা প্রদর্শন করেন।

লাঠিখেলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বাজানো দুর্লভ বাদ্যযন্ত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে রোম, কাড়া, জয়ঢাক, কনেট এবং পাতার বাঁশি।

শামছুল হকের ভাষ্য, ‘আগে প্রতিটি গ্রামে চেয়ারম্যানদের উদ্যোগে লাঠিখেলা প্রতিযোগিতার আয়োজন হতো। আমরা খেলে নানা ধরনের পুরস্কার আনতাম। মানুষ খেলা দেখে আনন্দ পেত। কিন্তু এখন দু-তিন বছর পরপর এক-আধটা ইউনিয়নে প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়। তাই আমার দলের অনেক লাঠিয়াল খেলা ছেড়ে দিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে কাজ করতে চলে গেছেন।’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, ব্যক্তিগত উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারের উচিত দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়ে অমূল্য সম্পদ লোকসংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখা।