স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহ্যবাহী কুমারখালী

মূল কুঠিবাড়ির প্রবেশদ্বার। ছবি: তৌহিদী হাসান
মূল কুঠিবাড়ির প্রবেশদ্বার। ছবি: তৌহিদী হাসান

বাংলাদেশের ইতিহাসে কুমারখালীর কথা উল্লেখ না করলে দেশের ইতিহাস অপূর্ণ থাকবে। কুমারখালীর গড়াই নদের ওপর অবস্থান। ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ থেকে শহর অথবা রাজধানী নদীকেন্দ্রিক। শহর অথবা রাজধানীর সভ্যতা গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পদ্মা ও গড়াই পাবনা ও কুমারখালীর মধ্যে সেতুবন্ধ ছিল বললে অত্যুক্তি করা হবে না। এ সময় স্টিমার চলাচল করত। পদ্মা ও গড়াই কুমারখালীর মিলনস্থল ছিল। পদ্মা ও গড়াই অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। সেই গড়াই নদ এখন অবলুপ্ত হতে চলেছে।

কুষ্টিয়ার কুমারখালীর ইতিহাস অতি পুরোনো। ১৮৭১ সালে পর্যন্ত কুমারখালী পাবনা জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৮৭২ সালে নদীয়া জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। কুমারখালী ঐতিহ্যবাহী শহর বললে মোটেও অত্যুক্তি করা হবে না। বহু মানসীর জন্মস্থান এখানে। আবার বহু মনীষী এখানে এসেছেন। এখন তা ইতিহাস।

কুমারখালীর পৌরসভা কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। ১৮৬৯ সালে কুমারখালী মিউনিসিপ্যালটি প্রতিষ্ঠা হয়। বাংলাদেশে মেহেরপুর মিউনিসিপ্যালটি বহু পুরোনো। ১৮৮৪ সালে কুমারখালী মিউনিসিপ্যালটির নির্বাচন শুরু হয়। ১০ জন কমিশনার নির্বাচিত হতেন ১৫ জন কমিশনারদের মধ্যে। এই নির্বাচনপদ্ধতি ব্রিটিশ ইন্ডিয়া ভাগ করা পর্যন্ত প্রচলিত ছিল।

পাকিস্তান আমলে ১৯৫০ সালে চেয়ারম্যান, ভাইস-চেয়ারম্যান ও কমিশনার নির্বাচিত হতেন। পাকিস্তান আমলে প্রথম চেয়ারম্যান চিকিৎসক রেবতী মোহন সাহা। ১৯৫২ সালে চিকিৎসক মুজাফ্ফর আহমদ চেয়ারম্যান এবং মোহাম্মদ আকবর হোসেন (লেখকের পিতা) ভাইস-চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ভাইস-চেয়ারম্যান পোস্ট অবলুপ্ত করা হয় দুই বছর পর। কুমারখালী বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত লাভ করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সময়। কুমারখালী ব্রিটিশ নীলকরদের চারণভূমি ছিল। অত্যাচার কাহিনিতে ব্রিটিশ নীলকররা হার মানিয়ে ছিল। কুমারখালী রেলস্টেশন-সংলগ্ন গেটের পাশে ব্রিটিশ নীলকর ১২ জনের কবর ছিল। এই ঐতিহাসিক কবরস্থান কেন ভেঙে ফেলা হয়েছে, আমার জানা নেই। সম্প্রতি কবরস্থানে ফুলের চাষের প্রচলন দেখেছি। এবার কুমারখালী রেলওয়ে স্টেশনের ভগ্ন অবস্থা দেখে মন খারাপ হলো।

কুমারখালী ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পুরোধা ছিল, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। কাজী মুরাদ সিপাই বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, যে বিদ্রোহের শুরু ১৮৫৭ সালে মীরাটে। বাঙালি মুসলিম ও হিন্দু ও শিখ সিপাইরা এই বিদ্রোহীর সঙ্গে জড়িত ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছিল ব্রিটিশদের। এদের আর্মি সংগ্রহ করা হয় বেঙ্গল, মাদ্রাজ ও বোম্বাই (বর্তমান মুম্বাই) থেকে। কিন্তু বেঙ্গল আর্মির সংখ্যা বড় ছিল। কাজী মুরাদ বেঙ্গল আর্মির সদস্য ছিলেন। কাজী মুরাদকে ফাঁসি দেওয়া হয়। কাজী মুরাদের বড় মেয়ের সঙ্গে আমার দাদা মুন্সি মোহাম্মদ ইয়াসিনের বিয়ে হয়। আমার প্রপিতামহ মুন্সী মেহেরুল্লাহর বিশাল চামড়ার আড়ত ছিল। সম্ভবত মুন্সী মেহেরুল্লাহ কুমারখালীর প্রথম হাজি। হেঁটে হজ করেছিলেন। সম্ভবত হেঁটে বোম্বে যান এবং সেখান থেকে জাহাজে জেদ্দা পৌঁছান এবং হেঁটে হজ করেন। কাজী মুরাদের চাচাতো ভাই কাজী মিয়াজান ওহাবি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বাংলাদেশে ওহাবি আন্দোলনের হোতা ছিলেন রায়বেরেলির সাইদ আহমদ এবং সৈয়দ নিসার হুসাইন ব্রিটিশ আন্দোলন শুরু করেন বেঙ্গল থেকে। কাজী মিয়াজান ও ফাঁসিকাষ্ঠে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।

মৌলভি শামসুদ্দিন আহমদ কুমারখালীর কয়া গ্রামে ১৮৮৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যায় থেকে মাস্টার করেন। সেখান থেকে আইন পাস করেন। ১৯২০ সালে রাজনীতি শুরু করেন। খেলাফত আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। খেলাফত আন্দোলনের অদম্য সংগঠক হন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগদানের জন্য কারাবরণ করেন। ১৯২২ সালে কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর বাংলার খেলাফত কমিটির সভাপতি এবং বাংলার কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। বিবাহের সূত্রে মৌলভি শামসুদ্দিন আহমদ ফরিদপুরের হাজি শরীয়তুল্লাহর ফরায়েজি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯২৩ সালে চিত্তরঞ্জন দাসের নেতৃত্বে গঠিত ঐতিহাসিক বঙ্গচুক্তির সঙ্গে মৌলভি শামসুদ্দিন আহমদ জড়িত ছিলেন। ১৯৩০ সালে মহাত্মা গান্ধীর আইন অমান্য আন্দোলনে যোগদানের জন্য বঙ্গীয় পার্লামেন্ট থেকে পদত্যাগ করেন। নির্যাতিত কৃষক সমাজের কল্যাণে এবং জমিদারি প্রথা বিলোপ করার জন্য মৌলভি শামসুদ্দিন আহমদের অবদান অনস্বীকার্য।

যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৮৮৩ সালে কুমারখালীর কয়া গ্রামে। বাঘা যতীন নামে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। আলীপুর কন্সপিরেসি কেস অকৃতকার্য হলে বাঘা যতীনের সাহায্যে যুগান্তর দল ব্রিটিশ বিদ্রোহী দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। বালাশোরের যুদ্ধ বাঘা যতীনের যুগান্তর দল ও ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ ইতিহাসে ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে লিপিবদ্ধ। বাঘা যতীন বুলেটের আঘাত পান যুদ্ধের সময় কিন্তু ব্রিটিশের সাহায্য নেননি। বাঘা যতীন বারাবতী গার্লস স্কুলে প্রাথমিক চিকিৎসা পান এবং পরে ডিস্ট্রিক্ট হসপিটালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ১৯১৫ সালে ১০ সেপ্টেম্বর। ২০১১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর বারাবতী গার্লস স্কুলে বাঘা যতীনের ওপর শ্রদ্ধা জানানো হয়। বাঘা যতীনের নাতি ধীরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য এখন আছেন ফ্রান্সের প্যারিসে।

কুমারখালীর সাধু মনীষীরা
হজরত শাহ মূলক খোরশেদ ফকিরের কুমারখালীর অন্তর্গত খোরশেদপুর বসবাস করতেন। হজরত শাহ মূলক অনেক অলৌকিক কাহিনির জন্ম দিয়েছিলেন। কথিত আছে, এ মনীষী একবার পদ্মা থেকে গড়াই নদ পার হচ্ছিলেন। নৌকার মালিক নদী পারাপারের জন্য ভাড়া চেয়েছিলেন কিন্তু খোরশেদ ফকির বলেছিলেন তিনি গরিব মানুষ। তাঁর কাছে টাকা নেই। নৌকার মাঝি টাকা দাবি করলে শাহ মূলক নদীর মধ্যে নেমে পড়েন একটি দ্বীপে। নৌকার মাঝি ও যাত্রীরা অবাক। এ দ্বীপ খোরশেদপুর নামে পরিচিতি লাভ করে। শাহ মূলকের কবর বাঁধিয়ে দেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৯০৮ সালে জমিদারি দেখার সময়। খোরশেদপুর শিলাইদাহ এর পাশের গ্রাম।

সোনাবন্ধু ফকিরের জন্ম কুমারখালীতে। এর কবরস্থান কুমারখালীর বাজার সংলগ্ন। এর জন্মবৃত্তান্ত জানা যায়নি। কথিত আছে, সোনাবন্ধু হিন্দু ছিলেন কিন্তু মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং অলৌকিক শক্তি লাভ করেন। সোনাবন্ধু হিন্দু ও মুসলিম মধ্যে সেতুবন্ধ সৃষ্টি করেছিলেন।

দ্বিজাতা সন্ন্যাসী আধ্যাত্মিক জগতের মানুষ ছিলেন। কুমারখালীর বাটিকামারা আশ্রমে ধ্যান করতেন। আশ্রম রক্ষা করা হচ্ছে।

পণ্ডিত শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণব ১৮৬০ সালে কুমারখালীতে জন্মগ্রহণ করেন। তান্ত্রিক বিষয় সম্বন্ধে জ্ঞান আহরণ এবং তান্ত্রিকবিদ্যায় খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর তন্ত্রশাস্ত্র দেশে ও বিদেশে প্রচুর খ্যাতি অর্জন করে। কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি স্যার জন উড্রপ, কবি মুকুন্দ দাস, জার্মান কবি ম্যুলার ও কলকাতা আর্ট কলেজের প্রিন্সিপাল ই ভি হাভেল কুমারখালী এসেছিলেন শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণবের সঙ্গে দেখা করতে। বিচারপতি জন উড্রপ শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। পণ্ডিত শিবচন্দ্র ১৯১১ ও ১৯১৩ সালে লন্ডন সফরে যান এবং সেখানে তন্ত্রশাস্ত্র সম্বন্ধে বক্তৃতা করেন। তিনি ১৯১৯ সালে মারা যান।

সংবাদ জগৎ
হরিনাথ মজুমদার। যিনি কাঙাল হরিনাথ নাম প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন, তিনি ১৮৩৩ সালে কুমারখালীতে জন্মগ্রহণ করেন। গরিবদের দুঃখ দুর্দশা এবং ব্রিটিশ সরকারের অত্যাচার তুলে ধরার জন্য ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ নামে সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। গ্রামবার্তা পত্রিকা প্রথমে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হতো। পরবর্তী সময়ে ইতিহাসবিদ অক্ষয় কুমার মৈত্রের পিতা মথুরানাথ মৈত্র প্রিন্টিং প্রেস উপহার দেন কাঙাল হরিনাথ মজুমদারকে। সুতরাং কুমারখালী থেকে ১৮৫৩ সালে ‘গ্রামবার্তা পত্রিকা’ প্রকাশনা শুরু হয়। ব্রিটিশদের অনুমতি ছাড়াই জমিদার দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময় এর অত্যাচার কাহিনি প্রকাশ করেছেন। এ জন্য রবীন্দ্রনাথকে জমিদারি তদারক করার জন্য শিলাইদহ ঠাকুর এস্টেটে পাঠিয়েছিলেন। হরিনাথ মজুমদার জমিদারের অত্যাচারের কাহিনি ছাপতেন। হরিনাথ মজুমদার তাঁর দিনলিপিতে জমিদারের বিরুদ্ধে কিছু অপ্রিয় বক্তব্য লিপিবদ্ধ করতেন। কবি রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে দিনলিপি প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকেন। হরিনাথ মজুমদার পাঁচটি বই প্রকাশ করেন। ফকির চাঁদ ছদ্ম নামে ইমমর্টাল গান প্রকাশ করেন।

মথুরানাথ মৈত্র, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ান ছিলেন। তিনি জেএন হাইস্কুল প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৮৫৬ সালে এ স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২৮ সালে জে এন হাইস্কুল স্থাপিত হয়।

কাঙাল হরিনাথের মুদ্রণযন্ত্র দেখাচ্ছেন প্রপৌত্র অশোক মজুমদার। ছবি: জাহিদুল করিম
কাঙাল হরিনাথের মুদ্রণযন্ত্র দেখাচ্ছেন প্রপৌত্র অশোক মজুমদার। ছবি: জাহিদুল করিম



রায় বাহাদুর জলধর সেন ১৮৬০ সালে কুমারখালীতে জন্মগ্রহণ করেন। নামকরা সাহিত্যিক ছাড়া জলধর সেন সাংবাদিক হিসেবে ব্রিটিশ ইন্ডিয়াতে নাম করেছিলেন। ১৮৯৯ সালে ‘সাপ্তাহিক বঙ্গবাসী’র সম্পাদনা করেন। ওই বছরের এপ্রিল মাসে অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর হিসেবে কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক বসুমতি’তে কাজ করেন। জলধর সেন হিতবাদী ও সুলভ সমাচার সঙ্গে কাজ করেছেন। কিন্তু ১৯১৪ সাল থেকে একনাগাড়ে ১৬ বছর ভারতবর্ষ সম্পাদনা করেন। কবি রবীন্দ্রনাথ এ পত্রিকায় লিখতেন। জলধর সেন ৩৬ বই লিখেছেন। এর মধ্যে ৯টা বই ভ্রমণকাহিনি। ১৮৪৭ সালে আরও একজন মহারথীর আবির্ভাব কুমারখালীতে। তিনি হলেন ‘বিষাদসিন্ধু’ প্রণেতা মীর মশাররফ হোসেন। কুমারখালীর লাহিড়ীপাড়ায় জন্ম ১৮৪৭ সালে। বাংলা সাহিত্যে ‘জমিদার দর্পণ’ ও ‘বসন্তকুমারী’ উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।

এ ছাড়া প্রথম সম্পাদক ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র প্রফুল্ল কুমারের জন্ম কুমারখালীতে। জন্মতারিখ জানা নেই। কুহিনুর নামে আরও একটা পত্রিকা বের হতো ১৮৯৭ সালে। সম্পাদক ছিলেন কচি-কাঁচার মেলার প্রতিষ্ঠাতা রোকনুজ্জামান খানের মাতামহ রওশন আলী চৌধুরী। এটা মাসিক পত্রিকা ছিল।

কুষ্টিয়াতে প্রথম কাপড়ের মিল স্থাপন করেন কুমারখালীর মোহিনী মোহন চক্রবর্তী। বহু লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। এই মিল ১৯০৮ সালে ৩৩ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়।

লালন শাহ ফকির কুমারখালীর ছেঁউড়িয়ায় মারা যান ১৮৯০ সালে। তাঁর জন্ম সম্বন্ধে মতবিরোধ আছে। বাউল সংগীতের রাজা লালন শাহ ফকির। ১৮৮৯ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর লালন শাহের স্কেচ এঁকেছিলেন, সেই স্কেচ এখনো আছে। ছেঁউড়িয়াতে লালন জাদুঘর করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালনের চিন্তাধারা ও গানের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালনের গান সংগ্রহ করে বাংলা ক্যালেন্ডার ১৩৩২ সালে ছেপেছিলেন।

গগন চন্দ্রা দাম নামে কুমারখালীর একজন ডাকপিয়ন ছিলেন। তিনি গ্রাম্য কবি ছিলেন। গগন হরকারা গান গাইতে কুমারখালী ও শিলাইদহের মধ্যে চিঠি বিতরণ করতেন। তাঁর গানগুলো সংগ্রহ করে রবীন্দ্রনাথ হারমনিতে লিপিবদ্ধ করে প্রবাসীতে ছেপেছিলেন।

ডক্টরেট প্রতাব চন্দ্রা মজুমদার অনেক প্রবন্ধ ও বক্তৃতা দিয়েছেন, যা ইউরোপে সমাদৃত হয়েছে। প্রতাব চন্দ্র মজুমদার জন্মগ্রহণ কুমারখালীর চাপড়া গ্রামে।

খন্দকার মোহাম্মদ আজহারুল ইসলাম কুমারখালীর বালিয়াকান্দি গ্রামে ১৮৮৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। স্কুল ইন্সপেক্টর হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। উপন্যাস লিখেছেন। তার কন্যা জোবেদা খানম বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী। উনি একই গ্রামে ১৯২০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। জেবেদা খানম বেশ কয়েকটি উপন্যাস লিখেছেন। আইয়ুব খান আমলে ব্যুরো অব ন্যাশনাল রিকনস্ট্রাকশনের ঢাকায় অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর ছিলেন। বাংলাদেশে শিশু একাডেমির প্রথম ডিরেক্টর ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে। মেজর জেনারেল মান্নাফ জোবেদা খানমের একমাত্র পুত্র। আমার অনুরোধে আজিমপুর কচি-কাঁচার মেলার উপদেষ্টা হয়েছিলেন ১৯৬১ সালে।

আরও একজন ঔপন্যাসিকের জন্ম কুমারখালীর কায়া গ্রামে ১৯১৭ সালে। তিনি হলেন আকবর হোসেন। ‘অবাঞ্ছিতা’, ‘কি পায়নি’ ও ‘দুই দিনের খেলাঘর’ ইত্যাদি উপন্যাসের লেখক আকবর হোসেন। ‘সন্ধানী’, ‘নবযুগ’ ও ‘আজাদ’ পত্রিকায় লিখতেন। ১৯৮১ সালে মৃত্যুবরণ করেন। কুমারখালীর দুর্গাপুরের আমার বড়ো চাচা মমতাজ হোসাইন প্রথম গ্র্যাজুয়েট, আন্ডার পাবনা জেলা। কুমারখালী ১৮৭১ সাল পর্যন্ত পাবনার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ব্রিটিশ সরকারের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত হয়েছিলেন। যক্ষ্মায় অল্প বয়সে মাদ্রাজে মারা যান। আমার পিতা আকবর হোসেন রাজশাহী গভর্নমেন্ট কলেজের প্রথম গ্র্যাজুয়েট ছিলেন। ব্রিটিশ সরকারের চাকরিতে যোগদান করেন বার্মার অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল অফিসে ১৯২০ সালে। মিয়ানমার জাপান দখল করলে প্রথমে সিমলায় বদলি হন এবং পরে এলাহাবাদে চাকরি করেন। ভালো ফুটবল খেলতেন। জাদুকর নামে প্রখ্যাত ফুটবলার সামাদের সঙ্গে খেলেছেন। চাকরি শেষে কুমারখালী মিউনিসিপ্যালটির ১৯৫২সালে ভাইস -চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং স্কুলের উন্নতির জন্য চেষ্টা করেন। তিনি কুমারখালী জে এন প্রাথমিক স্কুলের বহুদিন স্কুল কমিটির সেক্রেটারি ছিলেন এবং কুমারখালীর গার্লস হাই স্কুলের ভাইস-চেয়ারম্যান ছিলেন। জে এন স্কুলকে হাই স্কুলে উন্নীতের জন্য আকবর হোসেনের অবদান অনস্বীকার্য। আমার ছোট চাচা ওয়াহিদ হোসেনও ভালো ফুটবল খেলতেন। তিনি পাবনার জিলা গভর্নমেন্ট কলেজের ছাত্র ছিলেন। প্রথমে বর্মায় বড় ভাই আকবর হোসেনের কাছে যান চাকরির জন্য কিন্তু বার্মার পোস্ট অফিসে চাকরি করেন এবং পরে কলকাতায় স্যানেটারি ইন্সপেক্টর হন। কলকাতায় অবস্থানকালে ওয়াহিদ হোসেন নদীয়া মুসলিম অ্যাসোসিয়েশনের জেনারেল সেক্রেটারি হন এবং চিকিৎসক আবদুল মালিক প্রেসিডেন্ট হন। মুসলিম গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তির ব্যবস্থা করেন। পাকিস্তান আমলে তেজগাঁও সেন্ট্রাল প্রিন্টিং প্রেসের অ্যাসিস্ট্যান্ট কন্ট্রোলার ছিলেন। সেন্ট্রাল প্রিন্টিং প্রেসের ফুটবল টিম তিনি তৈরি করেন। তিনি তেজগাঁও বসবাস করতেন।

সিডান আলতাফ হোসেন সম্পর্কে না লিখলে কুমারখালীর ইতিহাস অসম্পূর্ণ। কুমারখালীর বিষ্ণুদিয়া গ্রামে ১৯২৩ সালের ১৬ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ও ল ডিগ্রি লাভ করেন। ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময় তিনি কলকাতা থেকে জন হলওয়েল মনুমেন্ট তুলে ফেলার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। জন হলওয়েল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কলকাতার প্রধান ছিলেন। উনি নবাব সিরাজুদ্দৌলার আমলে ক্যাপটিভ ইংলিশ ম্যানদের একটা রুমে বন্ধ করে মৃত্যু দেওয়া হয় বলে মিথ্যা প্রচার করেছিলেন। এ মিথ্যা প্রচারকে ব্রিটিশ লেখকেরা ব্ল্যাক হোল বলে প্রচার করেছিলেন। আধুনিক ইতিহাসবিদেরা একে মিথ্যা প্রচার বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইতিহাসবিদ অক্ষয় কুমার মৈত্র মিথ্যা প্রচার বলেছেন। সৈয়দ আলতাফ হোসেন ডিগ্রি পাস করে কলকাতা ‘মর্নিং নিউজ’-এ এডিটোরিয়াল বিভাগে কাজ শুরু করেন। পাকিস্তান আমলে ‘ঢাকা মর্নিং নিউজ’-এ কাজ করেন। ইতিমধ্যে ‘পাকিস্তান অবজারভার’-এ নিউজ ডিপার্টমেন্ট ১৯৪৯ সালে কাজ শুরু করেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দেন ১৯৪৯ সালে। ন্যাপ পার্টি থেকে একতা পার্টিতে যোগদান করেন। ১৯৯২ সালের ১২ নভেম্বর আলতাফ হোসাইন মারা যান।

*মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন, সাবেক কূটনীতিক