কফির পেপার কাপ সম্পর্কে কী জানি

প্রতিবছর বিশ্বে ২ কোটির বেশি গাছ কাটা হয় পেপারের কাপ তৈরির জন্য। ছবি: সংগৃহীত
প্রতিবছর বিশ্বে ২ কোটির বেশি গাছ কাটা হয় পেপারের কাপ তৈরির জন্য। ছবি: সংগৃহীত

বর্তমানে কফি খেতে পছন্দ করেন না এমন মানুষ পাওয়া বেশ দুষ্কর। আমারও সবচেয়ে পছন্দের পানীয় হচ্ছে কফি। এককথায় বলতে গেলে বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয়গুলোর মধ্যে কফি হচ্ছে অন্যতম। সারা বিশ্বে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ কোটির বেশি কাপ কফি পান করা হয়ে থাকে।

বর্তমানে কফি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিক্রিত পণ্য (জ্বালানি তেলের পরে)। কফির উৎপত্তিস্থল ইথিওপিয়া হলেও বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কফি উৎপাদন করা হয় ব্রাজিলে, যা প্রতিবছর প্রায় ২২ লাখ ৪৯ হাজার ১০ মেট্রিক টন পর্যন্ত হয়ে থাকে। জেনে অবাক হবেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর ২৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় কফি দিবস পালন করা হয়। এ তো গেল কফির কথা, এবার মূল কথায় আসা যাক।

বর্তমানে সাধারণ রাস্তার ধারে, ফুটপাতে, রেলস্টেশনে, স্কুল-কলেজের সামনে এমনকি প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলেও কফি পাওয়া যায়। আর এসব কফি বিক্রি করা হয়ে থাকে এক ধরনের কাগজের তৈরি কাপে, যা শুধু একবারের জন্য ব্যবহারযোগ্য। বলা বাহুল্য, বড় বড় রেস্তোরাঁ, কফিশপ এবং পাঁচতারা হোটেলে পর্যন্ত এ ধরনের কাপে কফি দেওয়া হয়ে থাকে।

এবার চলুন জেনে নেওয়া যাক যে ওয়ান টাইম কফি কাপ আসলে কী?

ওয়ান টাইম কফি কাপ কাগজের তৈরি পাত্র। এই পাত্র ব্যবহারের পরে ফেলে দিলে মাটির সঙ্গে মিশে জৈবসার তৈরি করে। অর্থাৎ পরিবেশের কোনো ক্ষতি করে না। এ ধারণার ওপর দিনকে দিন এর ব্যবহার বাড়ছে। ছবি: সংগৃহীত
ওয়ান টাইম কফি কাপ কাগজের তৈরি পাত্র। এই পাত্র ব্যবহারের পরে ফেলে দিলে মাটির সঙ্গে মিশে জৈবসার তৈরি করে। অর্থাৎ পরিবেশের কোনো ক্ষতি করে না। এ ধারণার ওপর দিনকে দিন এর ব্যবহার বাড়ছে। ছবি: সংগৃহীত

ওয়ান টাইম কফি কাপ হচ্ছে একধরনের কাগজের তৈরি পাত্র, যা পরিবেশবান্ধব, এ পাত্র ব্যবহারের পরে ফেলে দিলে তা মাটির সঙ্গে মিশে জৈবসার তৈরি করে। অর্থাৎ এই পাত্র পরিবেশের কোনো ক্ষতি করে না। আর এই ধারণার ওপর দিনকে দিন এর ব্যবহার বেড়েই চলেছে। বর্তমানে শুধু কফির জন্য কাপ নয়, কাগজের তৈরি থালা, বাটি এবং খাবার বহনের জন্য একধরনের বক্সও পাওয়া যায়, যা শুধু একবারের জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এবার হয়তো ভাবছেন, যদি এটা পরিবেশবান্ধব হয়ে থাকে, তবে কেন এটাকে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বলছি?

প্রশ্নটা সাধারণ, উত্তরটাও সোজা। এই কাগজের তৈরি পাত্রগুলো উৎপাদন করতে যে পরিমাণ শক্তি এবং পণ্যের ব্যবহার করা হয়, সে পরিমাণ এর ব্যবহার করা হয় না। কেননা, একটি কাপে আপনি শুধু একবারের জন্য কফি খেয়ে সেটি ফেলে দিচ্ছেন, একটি বাটিতে একবার স্যুপ খেয়ে সেটি ফেলে দিচ্ছেন, থালার ক্ষেত্রেও তাই। জেনে অবাক হবেন, শুধু আমেরিকাতেই প্রতিবছর ৫৮ বিলিয়ন কফির কাপ এদিক–সেদিক থেকে জড়ো করা হয়। ৫৮ বিলিয়ন কফির কাপ তৈরি এবং ধ্বংস করতে যে পরিমাণ শক্তি ব্যবহার হয় তা দিয়ে প্রায় ৫৩ হাজার আবাসস্থলে এক বছরের বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো যেত। প্রতিবছর বিশ্বে ২ কোটির বেশি গাছ কাটা হয়, এই পেপারের কাপ তৈরি করার জন্য। প্রতিবছর ১২ বিলিয়ন গ্যালন পানি ব্যবহার করা হয় এসব কাপ তৈরিতে। প্রতি চারটি কাপ তৈরি করতে ১ পাউন্ডের মতো Co2 বায়ুমণ্ডলে নির্গত করতে হয়। যদি আপনি প্রতিদিন একটি করে কাগজের কাপ কম ব্যবহার করেন, তবে ৪০ বছরে আপনি ২৪টি বড় গাছের জীবন বাঁচিয়েছেন।

বর্তমানে অনেক কাগজের কাপে প্লাস্টিকের আবরণ দেওয়া থাকে, ফলে সেগুলোকে আর ধ্বংস করা সম্ভব হয় না, ঘুরেফিরে সেই পরিবেশের ক্ষতি। বর্তমানে পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় বিপদের বিষয় হচ্ছে বৃক্ষনিধন, মানুষ বুঝে না–বুঝেই গাছ কাটছে। তার ওপর আবার প্লাস্টিকের ব্যবহার, এ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। প্লাস্টিকের ভয়ে আমরা কাগজের ওপর নির্ভরশীল হচ্ছি, আবার সেই কাগজের জন্য গাছ কেটে ফেলছি, এ তো সেই গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজার মতো।

বর্তমানে শুধু কফির জন্য কাপ নয়, কাগজের তৈরি থালা, বাটি এবং খাবার বহনের জন্য এক ধরনের বক্সও পাওয়া যায়। ছবি: সংগৃহীত
বর্তমানে শুধু কফির জন্য কাপ নয়, কাগজের তৈরি থালা, বাটি এবং খাবার বহনের জন্য এক ধরনের বক্সও পাওয়া যায়। ছবি: সংগৃহীত

যাই হোক, চলুন একটা হিসাব দেখা যাক। কাগজের কাপ তৈরি করার জন্য বিশ্বে প্রতিবছর ২ কোটি গাছ কেটে ফেলা হয়। আবার এই কাপগুলো একবারের জন্য ব্যবহার করা হয়। তো এই কাপগুলোকে যদি একবারের জায়গায় দুবার ব্যবহার করা হয় তবে গাছের পরিমাণ ২ কোটির জায়গায় ১ কোটিতে নেমে আসবে। এভাবে যদি কাপের ব্যবহার আরও বাড়ানো যায়, তবে গাছ কাটার পরিমাণ আরও কমে আসবে।

আমরা জানি, টাকা আদান–প্রদানের সঠিক নিয়ম হচ্ছে সমপরিমাণ শ্রম বা পণ্যের মাধ্যমে আদান–প্রদান করা। অর্থাৎ ধরুন, আমি আপনাকে ১০ টাকা দেব, আপনাকে আমার সেই ১০ টাকা পরিমাণ শ্রম বা পণ্য দিতে হবে, তবেই টাকার সঠিক ব্যবহার করা হবে। কিন্তু আমি যখন রাস্তার ধারে কোনো কফির দোকান থেকে এক কাপ কফি কিনে খাচ্ছি, তখন সেই দোকানদার আমার কাছে কফির দামের সঙ্গে সেই কাপের দামও রেখে দিচ্ছেন, যদিও সেটা আপনার–আমার অগোচরে।

সম্প্রতি আমি এক কফির দোকানের মালিককে প্রশ্ন করলাম আপনারা এই ওয়ান টাইম কফি কাপগুলো কত করে কেনেন। তিনি বললেন, প্রতি কাপ তিন টাকা করে। তো আমার কাছে প্রতিটি কফির কাপ নেওয়া হচ্ছে ২০ টাকা করে। একটি কাপে ১৭ টাকার কফি দেওয়া হচ্ছে আর তিন টাকা কাপ বাবদ নেওয়া হচ্ছে। আবার সেই কাপ আমি মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য ব্যবহার করছি। তো ব্যাপার দাঁড়াল যে মাত্র ৫ মিনিটের জন্য আমার গচ্ছা তিন টাকা। অনেকের কাছে হয়তো এই ৩ টাকা কোনো ব্যাপার নয় বা ভাবছেন এ আর এমন কী?

কিন্তু আপনার এই পাঁচ মিনিটের ব্যবহারের জন্য একটি গাছ হয়তো কাটা হচ্ছে। আমরা আমাদের মানসিকতার একটু পরিবর্তন করলেই কিন্তু এই বিষয়গুলো অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এই যেমন যেখানে ওয়ান টাইম কাপ বা থালাবাটি ব্যবহার করা হয়, সেখানে পুনর্ব্যবহারযোগ্য জিনিসের ব্যবহার করা। যেমন কাচের বা স্টিলের তৈরি মগ বা বাটির ব্যবহার করা। বর্তমান বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ এই বিষয়ে সচেতন হচ্ছে, অনেক দেশ গাছের ওপর চাপ কমাতে কাগজের তৈরি পাত্র ব্যবহারে বেশ চিন্তাভাবনা করছে। মনে রাখবেন, প্লাস্টিক যেমন আমাদের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর, ঠিক তেমনি গাছ কাটাও আমাদের পরিবেশের জন্য আরও বেশি ক্ষতিকর।

এই ছোট ছোট বিষয়গুলো আমাদের নজরে আসুক, ভাবনায় আসুক।

*আরিফ হাসান, সিনিয়র ইলেকট্রিশিয়ান, ডার্ড ফেল্ট লিমিটেড, রাজেন্দ্রপুর, গাজীপুর