দক্ষিণবঙ্গ: প্রকৃতি, জল আর মানুষের গল্প

ঘন সবুজ জঙ্গল আর সৈকতের কারণে পর্যটকেরা কক্সবাজার ছোটেন। ছবি: সংগৃহীত
ঘন সবুজ জঙ্গল আর সৈকতের কারণে পর্যটকেরা কক্সবাজার ছোটেন। ছবি: সংগৃহীত

দক্ষিণবঙ্গের প্রকৃতি, জল আর মানুষের গল্প নিয়ে তিন পর্বের প্রথমটি পড়ুন আজ।

আমার কন্যা প্রমিতি যখন প্রথম কক্সবাজার গেছে, তখন তার বয়স এক বছরও হয়নি। এরপর ওকে নিয়ে আর ওদিকে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। আমার বাড়ি চট্টগ্রাম হওয়ায় পতেঙ্গা বিচে প্রমিতি গেছে কিন্তু সমুদ্রদর্শন আর সমুদ্র অবগাহন তো আর এক জিনিস নয়! এ বছর প্রমিতির সপ্তম জন্মদিনের উপহার হিসেবে তাই সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা কক্সবাজার বেড়াতে যাব। দুই রাত থাকব। অফিস থেকে নেওয়া ছুটি আর অফসিজন—দুটো মিলিয়ে কক্সবাজারে হয়তো ভিড় একটু কম থাকবে।

রাতের বাসে কক্সবাজার রওনা হলাম। খুব ভোরে সমতলভূমি আর ধানখেত ছেড়ে আমাদের বাস যখন লালমাটির পাহাড়ি এলাকায় ঢুকল, তখন থেকে আমার চোখে ঘুম নেই। এই পথ যে আমার শৈশবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। কৈশোরে কত অসংখ্যবার বাসের জানালা দিয়ে এর দুপাশের ঘন সবুজ জঙ্গলের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কক্সবাজার পৌঁছে গেছি। সালমান শাহ আর মৌসুমী অভিনীত কেয়ামত থেকে কেয়ামত সিনেমার শুটিং হয়েছে এই জঙ্গলে। এখানে বুনো হাতিসহ নানা রকম প্রাণী ছিল। এখান দিয়ে যাওয়ার সময় মনে মনে তাই ভাবতাম—আহা, একটা হাতির দলের যদি দেখা পেতাম! এখন পথ পাকা ও মসৃণ হয়েছে। কিন্তু সেই সৌন্দর্য আর নেই। জঙ্গলের ভগ্নাংশ কোনোমতে টিকে আছে। পাহাড় আর গাছ কেটে মানুষ বসতি গড়েছে। এখানে হাতি আর না থাকলে একটুও অবাক হব না।

কক্সবাজারে আমি অফিসের কাজে গত বছরও গিয়েছিলাম। তবে প্রমিতি সঙ্গে থাকার কারণেই বোধ হয়, কক্সবাজার পৌঁছে পুরোনো স্মৃতিগুলো বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল। কোথায় গেল আমার কৈশোরের সেই প্রিয় শহর। নব্বইয়ের দশকে, আমি যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি, তখন আমার মেজ মামা কক্সবাজার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিচালক পদে যোগ দেন। সেই থেকে শুরু। পরবর্তী সময়ে প্রায় ১০ বছরে এমনও হয়েছে, মাসে দুবার কক্সবাজার গেছি। ঢাকা থেকে যেকোনো আত্মীয়স্বজন চট্টগ্রামে আমাদের বাসায় বেড়াতে এলেই আমরা কক্সবাজার ট্যুর দিতাম। সেই কক্সবাজার আর তার পায়ের ওপর আছড়ে পড়া সমুদ্র ছিল সৌন্দর্যের রানি। সাগরের জল ছিল পরিষ্কার আর নীল। প্রতিটি ঢেউয়ের সঙ্গে ঝিনুক ভেসে আসত। আমরা ভাইবোনের দল হুড়োহুড়ি করে সেগুলো কুড়োতাম। ভাগ্যবান হলে কেউ কেউ পেয়ে যেতাম আস্ত একটা স্টার ফিশ। লাবণী বিচে ঢোকার মুখে সুন্দর লেক ছিল। তাতে সারা বছর শাপলা ফুটে থাকত। কক্সবাজার ছিল কোলাহলমুক্ত, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, ছিমছাম একটা শহর। মামার বাসাটা বেশ দূরে হলেও আমরা হেঁটেই সমুদ্র¯স্নানে যেতাম। পর্যটকেরাও হোটেল থেকে হেঁটে সৈকতে যেত। পাহাড় আর সমুদ্র মিলিয়ে পরিবেশটা এত সুন্দর ছিল যে হাঁটতেই মানুষ বেশি পছন্দ করত। বিকেলবেলা সমুদ্রে পা ছুঁইয়ে কলাতলী বিচ থেকে হাঁটতে হাঁটতে আমরা লাবণী পয়েন্টে চলে যেতাম। সেখানে সূর্যাস্ত দেখতাম। রাতের বেলা ভাইবোনের দল জমিয়ে আড্ডা দিতাম। মামার বদৌলতে কক্সবাজারের সব বিচ দেখা হয়েছে, যত পাহাড়ে চড়া যায় সব পাহাড়েই টইটই করে ঘুরে বেড়িয়েছি। হায়, সেই কক্সবাজারের আজ কী হাল! রাস্তাঘাট সব ভাঙা। যানবাহন, মানুষ আর হোটেলের ভিড়ে সমুদ্র ঢাকা পড়েছে। ঢেউয়ের সঙ্গে আর ঝিনুক ভেসে আসে না। পানির রং পাল্টে কেমন যেন বিবর্ণ হয়ে গেছে। সৈকতজুড়ে এলোমেলো দোকানপাট আর ময়লার স্তূপ।

পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতে মানুষ। ফাইল ছবি
পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতে মানুষ। ফাইল ছবি

তারপরও কেমন কেমন করে যেন আমাদের দুই দিনের কক্সবাজার ট্যুরটা অসাধারণ হলো। আসলে আনন্দ আমাদের চারপাশেই লুকিয়ে থাকে, তাকে খুঁজে নিতে হয়। আমাদের হোটেলটা শহরের একদম কেন্দ্রে হলেও সমুদ্রসংলগ্ন আর বেশ নিরিবিলি ছিল। রাস্তার উল্টো দিকেই হোটেলের নিজস্ব সৈকত, তাতে মানুষের ভিড় তুলনামূলকভাবে কম। কক্সবাজারে পৌঁছে কোনোমতে নাশতা সেরেই আমরা সরাসরি সৈকতে চলে গেলাম। প্রমিতির জন্য সমুদ্র¯স্নান ছিল প্রথম অভিজ্ঞতা। তাই পানিতে লাফালাফি, ঝাঁপাঝাঁপি করে প্রমিতি ভীষণ মজা পেল। ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম থেকে আব্বু-আম্মু এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিল। দুটো দিন কেটে গেল ইচ্ছেমতো সমুদ্র আর সুইমিংপুলে ঝাঁপাঝাঁপি করে, বিকেল আর সন্ধ্যায় কখনো কফি হাতে আবার কখনো সৈকতে বিছানো বিচ চেয়ারে হেলান দিয়ে অকারণ বসে থাকায়। রাতের বেলা মার্কেটে ঘোরাঘুরি আর দুবেলা বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে ঢুঁ মারাটাও মন্দ ছিল না। আমাদের বেড়ানোতে বাড়তি আনন্দ যোগ করেছিল বৃষ্টিতে সমুদ্র স্নান আর রেডিয়েন্ট ফিশ ওয়ার্ল্ড পরিদর্শন। আগেই বলেছি, আমি অসংখ্যবার কক্সবাজার এসেছি। কিন্তু এত বৃষ্টিতে সমুদ্র¯স্নান করার সুযোগ তেমন একটা হয়নি। বৃষ্টি আর সমুদ্রের ঢেউয়ের মিতালি আমার নিজেরই অসম্ভব ভালো লাগল। প্রমিতি আর তার বাবার কথা তো বলাই বাহুল্য। অন্যদিকে, রেডিয়েন্ট ফিশ ওয়ার্ল্ড আকারে বেশ বড়। মাত্র কয়েক বছর হলো চালু হয়েছে। ভেতরে বেশ সুন্দরভাবে সমুদ্রের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। আলো-আঁধারির মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে দুপাশে কাচের দেয়ালের ওপাশে অ্যাকুরিয়ামে নানা প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ এবং জলজ প্রাণী দেখলাম। বিচিত্র তাদের রং, আকার ও আচরণ। একটা জায়গা সবচেয়ে ভালো লাগল। সেখানে দুপাশের দেয়াল ও ছাদ সবই কাচের তৈরি। আমাদের মাথার ওপর এবং দুপাশে শুধু পানি আর পানি, তার মধ্যে বড় বড় মাছ স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মনে হচ্ছিল আমরা সত্যি সত্যি সমুদ্রের নিচে আছি।

কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতে সারা বছর এমন ব্যবস্থা থাকে। ফাইল ছবি
কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতে সারা বছর এমন ব্যবস্থা থাকে। ফাইল ছবি

কক্সবাজারের বেশ কয়েকজন পরিচিত মানুষের সঙ্গেও দেখা হলো। রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে কেন্দ্র করে দেশি–বিদেশি প্রচুর মানুষ কক্সবাজারে কাজ করছে। একজন জানাল, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সবার নাভিশ্বাস অবস্থা হয়ে যাচ্ছে। তিন–চার গুণ বেশি বাড়িভাড়া দিতে হয়। কোনো ধরনের সমস্যার কথা বাড়ির মালিকদের বলা যায় না। ভাড়াটের অভাব না থাকায় সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা বাড়ি ছেড়ে দিতে বলেন। আমি নিজে উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করি। গত বছর উখিয়াতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গেছি। সেখানে সরকার এবং উন্নয়ন সংস্থা অনেক কাজ করছে সত্য। কিন্তু ক্যাম্পের জীবন আসলে মানুষের জীবন নয়। শরণার্থীদের চোখের দিকে তাকালে তাতে সুখ-দুঃখ-আনন্দ-বেদনা কোনো অনুভূতিই দেখতে পাওয়া যায় না। তারা শুধু বেঁচে থাকার জন্য বেঁচে আছে। আমার মনে হয়, কক্সবাজারে স্থানীয় মানুষ এবং শরণার্থী কেউই আসলে ভালো নেই। পর্যটক, উন্নয়নকর্মী আর যানবাহনের অতিরিক্ত চাপে ভালো নেই সমুদ্র এবং সবুজ বনভূমিও। এমনকি কক্সবাজারে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা যে বিপুলসংখ্যক মানুষ কাজ করছেন, তাঁরাও ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। কেউ জানে না কবে রোহিঙ্গারা হাসিমুখে বাড়ি ফিরে যাবে, তাদের আর মানবিক সহায়তা লাগবে না।

তারপরও জানি, কিছুদিন পার হতে না–হতেই আবারও কক্সবাজার যাওয়ার জন্য প্রাণ আকুল হবে। পৃথিবীর দীর্ঘতম সৈকতের এই সমুদ্র কেমন করে এত মোহ তৈরি করে কে জানে! শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ডের বিচে গিয়ে ছোট্ট এক টুকরো সৈকতকে ঘিরে পর্যটকদের উচ্ছ্বাস দেখে মনে মনে হেসেছি। চেন্নাইতে বিচে গিয়ে মনে হয়েছে বঙ্গোপসাগর তো এই মহাসাগরের অংশ। একটু ভালো করে তাকালেই হয়তো দূরে তার তটরেখা দেখা যাবে। আবারও ফিরে আসতেই হবে এই কথা ভাবতে ভাবতে তাই কক্সবাজারকে বিদায় জানালাম। আমাদের যে বারবার ডেকে চলেছে আমার জন্মস্থান, পাহাড়সুন্দরী চট্টগ্রাম। কক্সবাজার আসব আর তার কাছে যাব না, তা কী কখনো হয়!

* উপমা মাহবুব: কলামিস্ট এবং উন্নয়ন পেশাজীবী