ভিপি নুরুলের ওপর হামলা সভ্য সমাজে অচিন্তনীয়

আহত ডাকসু ভিপি নুরুল হককে মারধরের পর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রথম আলো ফাইল ছবি
আহত ডাকসু ভিপি নুরুল হককে মারধরের পর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রথম আলো ফাইল ছবি

‘এইটা একটা বিশ্ববিদ্যালয়? আর আমিও একজন শিক্ষক? ছিঃ ছিঃ ছিঃ...।’ যে বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কর্মকাণ্ড নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। সে বিশ্ববিদ্যালয় কেন বিশ্বের এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে নেই, তা নিয়ে আমাদের বুদ্ধিজীবী মহলের কত কান্না!

ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত বুয়েট ছাত্র আবরারের কথা জাতি এখনো ভুলতে পারেনি। আবরারকে পিটিয়ে মারা হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহসভাপতি (ভিপি) নুরুল হক নূর ও তাঁর সহযোগীদের পিটিয়েছেন ছাত্রলীগ ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতা-কর্মীরা। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ভিপি নুর বহিরাহতদের নিয়ে ডাকসু ভবনের কী করছিলেন। বহিরাগত থাকলেই হামলা করা, ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া কি বৈধ? আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া দেশের প্রচলিত আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো নয় কী?

তাহলে ছাত্রলীগ কেন বহিরাগতদের নিয়ে ডাকসুতে মারামারি করল। ক্যাম্পাসে কী কখনো বহিরাগত আসে না? শুধুই আসা-যাওয়া নয়, ছাত্র হলগুলোতে বহিরাগতরা তো সব সময়ই থাকছে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের ‘অতিথি’ হিসেবে। বুয়েটের ঘটনায় একজন শিক্ষার্থীর মৃত্যু হলেও আরও ২০ ছাত্রের জীবন নষ্ট হয়ে গেছে। তাঁরা সবাই মেধাবী ছিলেন। এই মেধাবী ছাত্ররা রাজনীতির ছত্রচ্ছায়ায় এসে একসময় দানবে পরিণত হয়েছেন। এসব মেধাবীরা ঠিক কোন প্রক্রিয়ায় দানবে পরিণত হচ্ছেন, তা চিহ্নিত করে সেই প্রক্রিয়া বন্ধ করা দরকার।

নুরুল হক ডাকসুর নির্বাচিত ভিপি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাঁকে নির্বাচিত করে নেতা বানিয়েছেন। নুরের কার্যালয়ে আলো নিভিয়ে (নিজেদের আড়াল করতে) যেভাবে হামলা হয়েছে, যা সভ্য সমাজে অচিন্তনীয়। এমনকি হামলাকারীদের নির্দয় আঘাতে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের এক নেতাকে লাইফ সাপোর্টে পর্যন্ত নিতে হয়েছে। একজন নির্বাচিত ভিপির ওপর দাঙ্গাবাজি কায়দায় বারবার এবং প্রকাশ্যে হামলা হচ্ছে? ঢাকার বাইরেও আক্রমণের শিকার হয়েছেন এই ভিপি। এভাবে বারবার হামলা হচ্ছে, অথচ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, পুলিশ কিংবা সরকার কেউ তাঁকে ক্যাম্পাসে কিংবা ক্যাম্পাসের বাইরে ন্যূনতম নিরাপত্তাও দিতে পারছে না? প্রশাসন এবং ছাত্রলীগ থেকে বলা হয়েছে, সেখানে ডাকসু ভবনে নুরুর সঙ্গে বহিরাগতরা ছিলেন। নুরু তা স্বীকার করেই বলছেন, তিনি অনিরাপত্তাজনিত কারণে একা চলাফেরা করেন না। যদি প্রশাসন বহিরাগত বিষয়টিকেই জোর দেয় তাহলে প্রশ্ন, নুরুর নিরাপত্তার জন্য প্রশাসন কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিল?

হামলার প্রতিবাদে চরম ব্যথিত ও মর্মাহত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক রুশাদ ফরিদি নিজের ফেসবুক পেজে আবেগঘন স্ট্যাটাস দেন, যা লেখার শুরুতে উল্লেখ করেছি। ভিপি নুরের ওপর হামলার ঘটনায় রুশাদ ফরিদির স্ট্যাটাসটি ছিল এমন—শিক্ষকতা ছেড়ে দেওয়ার সময় হয়েছে। চোখের সামনে ডাকসু ভিপি নুরু আর অন্য ছাত্রদের মারা হলো। কিছুই করতে পারলাম না। নিজেদের ছাত্রদের রক্ষা করতে পারি না, এই শিক্ষকতার কী দাম আছে? লাইট নিভিয়ে লোহার রড দিয়ে এলোপাতাড়ি পেটানো হয়েছে। এটা একটা বিশ্ববিদ্যালয়? আর আমিও একজন শিক্ষক? ছিঃ ছিঃ ছিঃ।

‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ সংগঠনটির কর্মী পরিচয়ে এর আগেও নুরুলসহ একাধিক ছাত্রনেতার ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। তাদের খুঁটির জোর কোথায়? হামলার ঘটনায় ছাত্রলীগ ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতারা জড়িত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামের সংগঠনের নেতারা নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করার কথা নয়। কিন্তু তাঁরা করেছে। এটা নিছকই গুন্ডামি। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সবচেয়ে পবিত্র বিষয়। এ নাম নিয়ে সংগঠন বানিয়ে এমন কর্মকাণ্ড জঘন্য কাজ। কারা এসব কাজ ঘটাচ্ছে, তাদের চিহ্নিত করা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পক্ষে কোনো কঠিন কাজ নয়। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নাম দিয়ে কেউ এ ধরনের কাজ করলে তা সমর্থনযোগ্য নয়।

ডাকসু ভবনে গত রোববার হামলার নেতৃত্ব দেওয়া ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চে’র দায়িত্ব এখন কেউই নিতে চাইছেন না। সবাই এখন এই সংগঠনের সঙ্গে নিজেদের সংশ্লিষ্টতা পাশ কাটাতে চাইছে। কারা এই ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ চালাচ্ছেন, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এরা আসলে মুক্তিযুদ্ধকে কলঙ্কিত করে বর্তমান সরকারকেও বিব্রত করছে চাইছে কি না, ভাবতে হবে তা নিয়েও। মুক্তিযুদ্ধ প্রতিটি দেশপ্রেমিক বাংলাদেশির হৃদয়ে মিশে আছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান আকাশসম। যারা মুক্তিযোদ্ধাদের, মুক্তিযুদ্ধের নামকে ব্যবহার করে মানুষকে পেটানোর প্রয়াশ করে, তারা আর যা–ই হোক কোনো দেশপ্রেমিক নয়। তারা প্রকৃতপক্ষেই দেশদ্রোহী, হিংস্র। বাংলাদেশের মানুষের শ্রেষ্ঠ অহংকার মুক্তিযুদ্ধ। ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ নামীয় সংগঠনটিকে মুক্তিযুদ্ধ শব্দটি ব্যবহার করে করে অন্যকে পেটানোর অধিকার কে দিয়েছে?

হামলার পর ডাকসুর সব সিসিটিভি ফুটেজ গায়েব করে ফেলারও অভিযোগ উঠেছে। ডাকসু ভবনের ভেতরে-বাইরে মিলিয়ে মোট নয়টি ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা থাকলেও হামলার পর থেকে সিসিটিভি ফুটেজ সংরক্ষণ করার কম্পিউটারটি নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিয়াশীল বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতা–কর্মী এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা প্রশাসনের এই দায়িত্বহীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও প্রক্টরের পদত্যাগের দাবি তুলেছেন। এখন বোঝা গেল, কেন আবরার ফাহাদকে হত্যার পর বুয়েটের ছাত্ররা ফুটেজ অক্ষত অবস্থায় হাতে নিয়েছিলেন? আজকে যদি সিসিটিভি ফুটেজ না থাকত, তাহলে আবরারকে ছাত্রশিবির বানাতে বা বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হতো না।

ভিপি নুরুকে এভাবে বারবার পিটিয়ে আর লাঞ্ছিত করে ছাত্রলীগ তাঁকে আরও জনপ্রিয় করে তুলেছে। এখন তিনি অধিকাংশ সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সহানুভূতি পাচ্ছেন। চলনে-বলনে ফ্যাশনেবল না হয়েও নুর তাঁর সাধারণ স্বাভাবিকতা নিয়ে তাঁদের কাছে চলে যেতে পেরেছেন, যাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ তরুণ। একদল ছেলেমেয়ের মনের জোরে ভর করে নুর আজ বড় ছাত্রনেতা। গত কয়েক বছরে যে নির্দলীয় ছাত্র অধিকার আন্দোলন চলে আসছে, তার শিকড় অবশ্যই সমাজের গভীরে। নুর ব্যক্তি হিসেবে কে! কী! কেমন? তার চেয়ে বড় তিনি যাঁদের প্রতিনিধিত্ব করেন, তাঁরা বিরাট, বিপুল ও সংগ্রামী মনোভাবসম্পন্ন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলেন, শুধু ছাত্রলীগের জন্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের খুব কঠিন সময় অপেক্ষা করছে। সরকারের ভালো কাজগুলো আজ চোখে পড়ে না কেবল ছাত্রলীগের নানা কর্মকাণ্ডের জন্য। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও সরকারের সব অর্জন ধুলায় মিশিয়ে দিতে ছাত্রলীগ একাই যথেষ্ট। আমরা উগ্রতা বা সন্ত্রাসের জায়গায় বারবার ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনকে দেখেছি। তারা কেন এটা করে? ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনটির বেপরোয়া হতে এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কী হতে পারে! ভুলে গেলে চলবে না, ঢাকার রাজপথে দরজি যুবক খুন হওয়ার ঘটনার দায়ও ছাত্রলীগের। বর্তমান সরকারের মন্ত্রীদের কথাবার্তায় বোঝা যায়, তাঁরা ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড সমর্থন করেন না। ছাত্রলীগ কি তাহলে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে? পেশিশক্তি ব্যবহার করে সব নিয়ন্ত্রণের এই সহিংস পথ যেকোনো সময় চরম অরাজকতার কারণ হয়ে যেতে পারে। সংশ্লিষ্টদের হুশ হওয়া জরুরি। যাঁরা রক্ত ঝরাচ্ছেন, তাঁরা যদি পরিস্থিতি অনুধাবন না করেন, আগামীর বাংলাদেশ তাঁদের ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে।

*মোহাম্মদ আবু নোমান: কদমতলী, ঢাকা
[email protected]