গ্রামীণ নারীদের অন্যতম আশ্রয়স্থল তথ্য আপারা

গ্রামের নারীরা তথ্য আপার কাছে নানা সেবার জন্য আসেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তথ্য যোগাযোগপ্রযুক্তির মাধ্যমে নারীদের ক্ষমতায়ন প্রকল্প তথ্যকেন্দ্রের তথ্য আপা। ছবি: সংগৃহীত
গ্রামের নারীরা তথ্য আপার কাছে নানা সেবার জন্য আসেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তথ্য যোগাযোগপ্রযুক্তির মাধ্যমে নারীদের ক্ষমতায়ন প্রকল্প তথ্যকেন্দ্রের তথ্য আপা। ছবি: সংগৃহীত

পরীবানু। বয়স ৭০। বাড়ি পটুয়াখালী সদর উপজেলার বদরপুর ইউনিয়নের উত্তর বদরপুর গ্রামে। তাঁর একমাত্র ছেলে মো. মিজানুর রহমান মৃধা স্ত্রী–সন্তান নিয়ে থাকেন ঢাকায়। গ্রামের বাড়িতে তিনি একাই থাকেন। নবজাতক নাতিকে দেখার জন্য ব্যাকুল তিনি। ইচ্ছে করলেই তো তিনি নাতিকে দেখতে পারেন না, কারণ তাঁর তো স্মার্টফোন নেই। তাই নাতিকে সরাসরি দেখতে তথ্য আপা প্রকল্পের পটুয়াখালী সদরের তথ্যকেন্দ্রে আসেন। এখানে তিনি স্কাইপেতে মন ভরে নাতিকে দেখেন এবং ছেলের সঙ্গে কথা বলেন।

শুধু পরীবানু একা নন প্রতিদিন গ্রামের অসংখ্য নারী সেবা নেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়াধীন জাতীয় মহিলা সংস্থা কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন তথ্য আপা: ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তথ্য যোগাযোগপ্রযুক্তির মাধ্যমে নারীদের ক্ষমতায়ন প্রকল্পের তথ্যকেন্দ্রে।

তথ্যকেন্দ্র থেকেই শুধু নয়, প্রকল্পের তথ্য আপারা বাড়িতে বাড়িতে গিয়েও গ্রামের দরিদ্র নারীদের তথ্য প্রযুক্তিবিষয়ক বিভিন্ন সেবা প্রদান করে আসছেন। এ ছাড়াও তথ্য আপারা প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে উঠান বৈঠক করে নারীদের বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন করে তুলছেন। ইতিমধ্যে এই তথ্যকেন্দ্রটি অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিত নারীদের কাছে ভরসাস্থল হয়ে উঠছে। গ্রামের নারীরা তাঁদের যেকোনো সমস্যা তথ্যকেন্দ্রের তথ্য আপাদের কাছে বলছেন নির্দ্বিধায়। এ কেন্দ্রের তথ্য আপারা তাঁদের সাধ্যমত সেবাগ্রহীতার সমস্যা সমাধান করে দিচ্ছেন। আর যেটা তাঁদের আওতায় পড়ে না সেটা তারা উপজেলার বিভিন্ন দপ্তরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। পাঠিয়েই থেমে থাকেন না, সেবা না পাওয়া পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে তাঁরা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করেন। ফলে সহজেই একজন নারী কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছেন তথ্যকেন্দ্রে।

তথ্যকেন্দ্রের কার্যক্রম দেখতে সম্প্রতি গিয়েছিলাম পটুয়াখালী সদর তথ্যকেন্দ্রে। জনগণের দোরগোড়ায় প্রকল্পের সেবা পৌঁছে দিতে উপজেলা সদর থেকে আট কিলোমিটার উত্তরে উত্তর বদরপুর গ্রামে তথ্যকেন্দ্রটি স্থাপন করা হয়েছে। তথ্যকেন্দ্রে যখন পৌঁছালাম তখন বেলা আড়াইটা। তথ্যসেবা কর্মকর্তা পলি বেগম আমাদের স্বাগত জানিয়ে তাঁর কক্ষে নিয়ে গেলেন। কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, ইন্টারনেট কানেকশনসমৃদ্ধ একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ অফিস এই তথ্যকেন্দ্র। সহকর্মী তথ্যসেবা সহকারী নাসরিন সুলতানা ও সাবিনা আক্তারের সঙ্গেও পরিচিত হলাম। তথ্যকেন্দ্রে আরও রয়েছেন একজন পুরুষ অফিস সহায়ক।

সবার সঙ্গে আলোচনায় জানা যায়, গ্রামের দরিদ্র, অসহায় সুবিধাবঞ্চিত নারীদের ইন্টারনেট ব্যবহার করে চাকরির খবর, বিভিন্ন পরীক্ষার ফলাফল, সরকারি বিভিন্ন সেবাগুলোর তথ্য সরবরাহ করা হয়। এসব সেবা সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে প্রদান করা হয়। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, ব্যবসা, জেন্ডার ও আইন—এই ছয়টি বিষয়ে তথ্য দেওয়ার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ ছাড়া ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, যেমন ব্লাড প্রেসার পরীক্ষা, ওজন পরিমাপ ও ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা হয়। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য আপারা ইন্টারনেটের মাধ্যমে নারীদের বিভিন্ন সমস্যা আলোচনা করে এর সমাধানের চেষ্টা করেন।

পলি বেগম জানান, তথ্য আপা প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি কাজ হলো উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে উঠান বৈঠক করে গ্রামীণ নারীদের তাঁদের জীবন–জীবিকাসম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য প্রদান। স্বাস্থ্যগত সমস্যা, বাল্যবিবাহ, ফতোয়া, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা, জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ, চাকরি–সংক্রান্ত তথ্য, আইনি সহায়তা বিষয়ে উঠান বৈঠকগুলোতে নারীদের সচেতন করে তোলা হয়।

পটুয়াখালী সদর তথ্যকেন্দ্র থেকে গত চার মাসে প্রায় ৩ হাজার নারীকে সেবা প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে তথ্যকেন্দ্রে সেবা প্রদান করা হয় ৪৬৫ জনকে, ডোর টু ডোর সেবা দেওয়া হয় ১ হাজার ৩৫৮ জনকে, ২০টি ভিডিও প্রদর্শনীর মাধ্যমে ৮০০ এবং ২০টি উঠান বৈঠকে ৩০১ জন নারীকে বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন করা হয়। নিয়মিত কার্যক্রমের বাইরেও এই কেন্দ্রের উদ্যোগে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের পরিচালনায় ব্লক–বাটিকবিষয়ক ভ্রাম্যমাণ প্রশিক্ষণ আয়োজন করা হয়। এই প্রশিক্ষণে ৪০ জন নারী অংশ নেন। এসব কাজের মাধ্যমে তথ্যসেবা কর্মকর্তা পলি বেগম পটুয়াখালী সদর উপজেলায় ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছেন। সেই সঙ্গে তাঁর দুজন সহকর্মীর কাজের দক্ষতা ও আন্তরিকতা সেবা প্রদানের কার্যক্রমকে সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

পরীবানুর মতো হাজারো নারী সেবা নিতে আসেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়াধীন জাতীয় মহিলা সংস্থা কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন তথ্যকেন্দ্রে। ছবি: লেখক
পরীবানুর মতো হাজারো নারী সেবা নিতে আসেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়াধীন জাতীয় মহিলা সংস্থা কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন তথ্যকেন্দ্রে। ছবি: লেখক

পটুয়াখালী সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লতিফা জান্নাতীর সার্বিক নির্দেশনা ও মনিটরিংয়ে তথ্যকেন্দ্রের সব কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে। তিনি অনেক উঠান বৈঠকে উপস্থিত থেকে নারীর অধিকার ও বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা ও তার সমাধানের বিষয়টি আলোচনা করেন।

পটুয়াখালী সদর তথ্যকেন্দ্রের তথ্যসেবা কর্মকর্তা পলি বেগম বলেন, তথ্য আপা প্রকল্প এসডিজির লক্ষ্যমাত্রায় নারীর ক্ষমতায়ন ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর সমান ভূমিকা নিশ্চিতকরণে কাজ করছেন। গ্রামের অসহায়, দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত কিংবা কম সুবিধাপ্রাপ্ত নারীদের তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে তাঁদের সাবলম্বী হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করছেন তথ্য আপারা।

আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। এদের অনেকেই বসবাস করেন গ্রামে। গ্রামের অনেক নারীকে এখনো মূলস্রোতে আনা যায়নি। তাই এসব নারীকে তথ্যপ্রযুক্তির মহাসড়কে আনতে তথ্য আপা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তথ্য যোগাযোগপ্রযুক্তির মাধ্যমে নারীদের ক্ষমতায়ন প্রকল্পের (দ্বিতীয় পর্যায়) কার্যক্রম চলছে। সুবিধাবঞ্চিত নারীদের তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ করতে পারলে ডিজিটাল বাংলাদেশ টেকসই ও মজবুত হবে বলেই প্রকল্পসংশিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন।

*লায়ন মো: শামীম সিকদার: কলামিষ্ট ও শিক্ষক