তিস্তায় বারবার ফেলেও মাছ উঠছে না জালে

তিস্তা নদীকে ঘিরে উত্তরাঞ্চলের কয়েক জেলার মানুষ জীবিকা নির্বাহ করত। কিন্তু এখন আর সেই অবস্থা নেই। ছবি: লেখক
তিস্তা নদীকে ঘিরে উত্তরাঞ্চলের কয়েক জেলার মানুষ জীবিকা নির্বাহ করত। কিন্তু এখন আর সেই অবস্থা নেই। ছবি: লেখক

নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার সীমানা থেকে ১ কিলোমিটার দূরে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার দোয়ানীতে তিস্তা ব্যারাজ অবস্থিত। এই তিস্তাকে ঘিরেই উত্তরাঞ্চলের কয়েক জেলার মানুষের জীবন-জীবিকা নির্বাহ হতো মাছ ধরে। তাদের পরিবার–পরিজনের ভরণপোষণের ব্যবস্থা হতো এই নদী থেকেই। বাস্তব অবস্থা এখন আর তেমন নেই।

কিন্তু এখন এই এলাকার জনগোষ্ঠীর জীবনে নেমে এসেছে হতাশা। তিস্তা এখন ধু ধু বালুচরে পরিণত হয়েছে। একসময়ে যাঁরা এই তিস্তাকে ঘিরে সংসার চালাতেন, এখন তাঁরা অন্য পেশায় চলে গেছেন। কেউবা পরিবহনে, কেউ পোশাকে, কেউ রিকশা চালিয়ে জীবনের খোরাক জোগাচ্ছেন।

তিস্তা ব্যারাজের নিচে পশ্চিম দিকে ছোট নৌকায় চড়ে জাল দিয়ে মাছ ধরছিলেন করিম ইসলাম (৫৬)। তিনি বলেন, মাছ ধরেই সংসার চলেছিল আগে। কিন্তু এখন আর চলে না। চাষাবাদের জমি এমনকি নিজের বাড়িটুকুও নেই। জমিজমা আগে যা ছিল তিস্তার বুকে সব বালুচরে পরিণত হয়েছে। কোনো কিছুর চাষ হয় না। থাকেন অন্যের জায়গায়।

তিস্তায় এই শুকনা মৌসুমে কেজিখানেক মাছ পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। ছবি: লেখক
তিস্তায় এই শুকনা মৌসুমে কেজিখানেক মাছ পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। ছবি: লেখক

করিম ইসলামের এক ভাই কাঠমিস্ত্রির কাজ করেন। ৬ সদস্যের পরিবারে এ দুজনের আয় দিয়ে কোনোভাবে সংসার চলে।

কথা হলো সাগরের সঙ্গে। নৌকার ভেতরে রাখা মাছগুলো একটি পাত্রে করে তীরে এলেন তিনি। ট্যাংরা, পুঁটি, বেলে ছাড়াও আরও কয়েক পদের মাছ। তিনি জানান, আগের দিন সন্ধ্যা থেকে সকাল সাড়ে ৭টা পর্যন্ত মাছগুলো ধরেছেন। তা বিক্রি করেই চাল কিনতে হবে। হাফ কেজির একটু বেশি হবে। দাম এক শর বেশি হবে না।

তিস্তাপারের আরেক বাসিন্দা জাহিদ বলেন, ‘নদীতে পানি নেই মাছ আর থাকবে কোনখানে। ৬ মাস পানি থাকে, আর ৬ মাস এভাবে শুকনা থাকে নদী। বর্ষার সময় বেশ ভালোই চলে দিন। মাছ বেচে সংসার চলে ভালোই। বাকি ৬ মাসের জন্য কিছু জমিয়ে রাখি। জমানো টাকা আর মাছ ধরে যা কিছু আসে তাই দিয়েই কোনোরকমে সংসার চলছে। তিনি বলেন, সামনে বৈশাখের পর নদীতে আবার জোয়ার আসবে। তখন মাছ পাওয়া যাবে। এখন নদীতে পানি নেই, মাছও নেই। কোনোমতে সংসার চলছে, ছেলেমেয়ে দুইটারেই আবার ইস্কুলে (স্কুলে) দিছি। খরচ জোগানে খুব কষ্টই হইছে।’

তিস্তার ওপর নির্ভরশীল মৎস্যজীবীরা অনেকেই পেশা বদলে ফেলেছেন। ছবি: লেখক
তিস্তার ওপর নির্ভরশীল মৎস্যজীবীরা অনেকেই পেশা বদলে ফেলেছেন। ছবি: লেখক

তিস্তাসংলগ্ন দোয়ানী গ্রামের রশিদুল ইসলামের (২৪) সংসারে তাঁরা তিন ভাই। অন্য দুজন হলেন সফি আলী ও তপু রহমান। তিস্তার প্রসঙ্গ উঠতেই তিনি কেঁদে উঠলেন। ফিরে যেতে চাইলেন সেই কৈশোর ও যৌবনে। তিনি বলেন, ‘এই তিস্তাই আমাদের সব। পেশায় কৃষক রশিদুল ইসলাম বলেন, একসময় উত্তরাঞ্চলে একটি প্রবাদ ছিল, গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ, মাঠ ভরা ধান। কিন্তু এখন হারিয়ে গেছে। আজ মাঠে ফসল নেই। পুকুরে মাছ নেই।’
তিনি জানান, আগে কমপক্ষে দুই মৌসুম ধান হতো। এখন মাত্র এক মৌসুমে ধান করা যায়।

তিস্তায় পানি নেই। তারপরও তিস্তার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে কিছু ছোট–বড় নৌকা পড়ে আছে চিকচিক বালুকণার ওপর। স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, এসব নৌকায় একসময় জেলেরা নদীতে জাল ফেলে মাছ ধরার প্রতিযোগিতা করতেন। দিন-রাত জেলে ও মাঝিদের কর্মব্যস্ত সময় কাটত। আশপাশের জেলা শহর এমনকি ঢাকা থেকেও পাইকারেরা মাছ কিনতে এসে বসে থাকতেন নদীর পাড়ে। সেই নদী এখন বালুতে চিকচিক করছে। মাছ ধরার নৌকাগুলো পড়ে আছে এলোমেলোভাবে। এলাকার মৎস্যজীবীদের দিন কাটছে দারুণ কষ্টে।