স্টামফোর্ড ডিবেট ফোরামের পথচলার ১৬ বছর

সেই গ্রিক সভ্যতার সময় থেকেই বিতর্কের শুরু। বিতর্ককে অনেকে অনেক ভাবে দেখেন। তবে বেশির ভাগ মানুষই বিতার্কিকদের ঝগড়াটে উপাধি দেন। কিন্তু এই বিতার্কিকেরাই জীবনের জটিল সময়গুলোয় যুক্তিতর্ক দিয়ে মুক্তি খুঁজে আনেন। দেশের, দেশের বাইরের সমসাময়িক বিষয়গুলো—রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক, আন্তর্জাতিক, বিনোদন, সব বিষয়—নিয়ে আলোচনা করেন এ বিতার্কিকেরা। খুঁজে আনেন সমাধান।

স্টামফোর্ড ডিবেট ফোরাম (এসডিএফ ক্লাব) স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ক্লাব। ক্লাবটি ১৭ বছরে পদার্পণ করল ১৫ জানুয়ারি। এই ক্লাব থেকে তৈরি হয়েছেন এমন সব বিতার্কিক, যাঁরা এখনো দেশের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। এখন পর্যন্ত সুনামের সঙ্গে সব বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করছেন। কিন্তু স্টামফোর্ড ডিবেট ফোরাম আজ এমনি এমনি এত দূর পৌঁছে যায়নি, আছে এক গল্প।

সময়টা ২০০৪ সাল। আবদুল্লাহ মো. শুকরানার উদ্যোগে ঢাকার প্রায় সব বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করত এসডিএফ ক্লাব। চার বন্ধুর যৌথ উদ্যোগে স্টামফোর্ড ডিবেট ক্লাবের যাত্রা শুরু। সেই দলে ছিলেন আবদুল্লাহ শুকরানা, হাসিব মোর্শেদসহ আরও দুজন। তাঁদের মনে হলো শুধু নিজেরা বিতর্কে দক্ষ হলে চলবে না। ভাবলেন, তাঁরা চারজন মিলে বিতর্ক করবেন না, বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও অনেক ছোট ভাইবোন আছেন, যাঁরা বিতর্ক করতে আগ্রহী, কিন্তু সুযোগ পায় না এবং সব বিভাগের ছেলেমেয়েকে নিয়ে বিতর্ক করার উদ্দেশ্যে স্টামফোর্ড ডিবেট ফোরাম নাম দিয়ে ক্লাব খুলে ফেলেন।

ক্লাব খোলার পর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। এখন ২০২০ সালে এসে সবাই চেনেন এই এসডিএফ নামক ক্লাবটিকে (স্টামফোর্ড ডিবেট ফোরাম)। শুরুতে সদস্যসংখ্যা চার থাকলেও বর্তমানে সদস্য প্রায় হাজারজন। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ক্লাবের সদস্যসংখ্যা।

তাঁদের মধ্যে অনেকে নিজেকে তৈরি করেছেন তুখোড় বিতার্কিক হিসেবে। জাতীয় পর্যায়ের বেশ কিছু বিতর্ক টুর্নামেন্টেও ক্লাব পেয়েছে পুরস্কার। এর মধ্যে আছে থার্ড এআইইউবি ডিবেট উইক-২০০৮, বাংলা ডিবেট কমপিটিশনে রানারআপ, ইউনিভার্সিটি ডিবেট কমপিটিশন রানারআপ, অষ্টম ইন্টার ইউনিভার্সিটি ডিবেট কমপিটিশন, দৃষ্টি চিটাগং রানারআপ, মাদকবিরোধী আন্তবিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক প্রতিযোগিতা-২০১১ রানারআপ, যুগপূর্তি বিতর্ক উৎসব-২০১০ রানারআপ, প্রাইম ব্যাংক এনডিডিসি ২২তম জাতীয় বিতর্ক প্রতিযোগিতা-২০১০ রানারআপ, ইউল্যাব প্রথম ইন্টার ইউনিভার্সিটি বিতর্ক প্রতিযোগিতা-২০০৯, রানারআপ ইংরেজি বিতর্ক, স্যান্ডালিনা–প্রথম আলো ভিকারুননিসা নূন ১৫তম আন্তক্লাব বিতর্ক প্রতিযোগিতা-২০১২ রানারআপ, ডিবেট কমপিটিশন অন রোহিঙ্গা ইস্যু-২০১৭ রানারআপ। এমন অনেক পুরস্কার আছে ক্লাবটির ঝুড়িতে।

ক্লাবটি এ পর্যন্ত আয়োজন করেছে বেশ কিছু বিতর্ক টুর্নামেন্টের। ১১টি আন্তবিভাগ, ১১টি ফেশার্স ও ৯টি জাতীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন। স্টামফোর্ড ডিবেট ফোরামের ৩টি দল ২টা বাংলা ও ১টা ইংরেজি প্রায় প্রতিদিন ক্লাস শেষে নিজেদের মধ্যে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়।

নতুনদের জন্য আয়োজন করা হয় বিভিন্ন কর্মশালার। ক্লাবের বর্তমান কনভেনর আল মামুন বলেন, ‘বিতর্ক করতে গেলে শিক্ষার্থীদের খুঁটিনাটি জানতে হয় এবং সাধারণ জ্ঞানে যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করতে হয়। আর বিতার্কিকেরা যেহেতু বিভিন্ন বিষয়ে ধারণা রাখেন, তাই তাঁদের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলোতে সুবিধা হয়।’

ক্লাবের সাবেক সভাপতি মো. সাইফ উদ্দিন বলেন, বিতর্কে একজন মানুষকে অনেকভাবেই সমৃদ্ধ করে। নিজেকে উপস্থাপন করার কৌশল শেখায়। নিজের বক্তব্যকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে শেখায়। নানা ধরনের অর্গানাইজিং দক্ষতা বাড়ায়। সর্বোপরি এটা কমিউনিকেশন স্কিল বাড়ায়। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই কোথাও না কোথাও বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন হচ্ছে। ঘুরেফিরে কিছু মানুষই বিতর্ক করে। দেখা যায় এদের সঙ্গে বেশ ভালো একটা সম্পর্ক হয়ে যায়। এমন সব বিষয় কর্মজীবন থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটি ধাপেই কাজে লাগে।

সময়ের সঙ্গে সবকিছুরই পরিবর্তন হবে। তবে মূল ব্যাপারটি একই রকম থাকে। এখানেও তাই। বিতর্কের মূল ব্যাপারটি ঠিক আছে, তবে অনেক কিছুই পরিবর্তন, পরিমার্জন হয়েছে। এখন প্রায় প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই বিতর্কের সংগঠন রয়েছে। তাই চর্চাটাও বেশি। তবে আগে সম্প্রীতির জায়গাটা বেশি ছিল, এখন যেটা কিছুটা কম। অনেক বেশি পরিমাণে বিতর্ক হচ্ছে, সেটা আবার বিতর্কের মানে প্রভাব ফেলছে।

ক্লাবের সাবেক বিতার্কিকদের মধ্যে আবদুল্লাহ মোহাম্মদ শুকরানা স্টামফোর্ড ডিবেট ক্লাবের প্রথম প্রেসিডেন্ট এবং বর্তমানে বাংলাদেশ ডিবেট ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট, রাইসুল এইচ চৌধুরী বর্তমানে এনটিভিতে নিউজ প্রেজেন্টার হিসেবে কর্মরত, শুভ্র প্রামাণিক ঢাকা জর্জ কোর্ট, আমিমুল হাসান নাগরিক টেলিভিশন। এ ছাড়া জাকিয়া রহমান প্রিয়া, সোহান মোহাইমিনুল, মো. সাইফ উদ্দীন, মহিউদ্দীন শ্যামল, লুৎফর রহমান, মিরাজুল ইসলাম, মাহমুদুল হাসান, মহিউদ্দিন সিফাত, রাকিব জোহা, মহিউদ্দীন মধু নিজ নিজ কর্মক্ষেত্র সফলতার স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছেন।

ক্লাবের বর্তমান প্রেসিডেন্ট সজিবুর রহমান বলেন, ‘বিতর্ক এমন কিছু শেখায়, যা বাস্তব জীবনে প্রয়োজন। প্রথমত, একটি বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানতে হয় বা পড়তে হয়, সেটি নিয়ে চিন্তা করতে হয় দুই দিকে, এরপর তা উপস্থাপন করতে হয় যুক্তি আর উদাহরণ দিয়ে। আবার বিতর্ক করতে গিয়ে আপনাকে অনেক ভিন্নমত শুনতে হয়, সেগুলো কীভাবে ঠিক বা ভুল তা ভাবতে হয় এবং তার বিপরীতে নিজের মতো যুক্তি দিয়ে প্রকাশ করতে হয় কিছু নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে। আরেকটি হলো সাংগঠনিক দিক, যেখানে আমরা কোনো একটি বিতর্ক ক্লাবের সদস্য হিসেবে অনেকের সঙ্গে মেশার সুযোগ পাই, সেটিও কিছু নিয়মের মধ্যে, যা কর্মজীবনে সহায়তা করতে পারে বলে আমি মনে করি।’

ডিবেট ক্লাবের সদস্য রায়সা খাইরুম বলেন, ‘স্টামফোর্ড ডিবেট ফোরামে এসে আমার প্রেজেন্টেশন স্কিল ভালো হয়েছে, কমিউনিকেশন স্কিল ডেভেলপ হয়েছে, আগের চেয়ে বেশি বিবেক–বিবেচনাসম্পন্ন মানুষে পরিণত হয়েছি।’

স্টামফোর্ড ডিবেট ফোরামের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এই বছর আমরা মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে বিশেষ কিছু আয়োজন করব। এই বছর একটি সোনালি বছর হিসেবে আমরা পার করতে চাই।’

স্ট্যামফোর্ড ডিবেট ক্লাবের বর্তমান কমিটি
সভাপতি: সজিবুর রহমান খান
সহসভাপতি: ফাতেমা সুলতানা
সাধারণ সম্পাদক: শফিকুল ইসলাম
ট্রেজারার: মো. সামিরুল হক
সাংগঠনিক সম্পাদক: মো. রায়হান দেওয়ান
যুগ্ম-সাংগঠনিক সম্পাদক: রাজিব আহমেদ ও ইফতেখার উদ্দিন ভূইয়ান
প্রোগ্রাম সেক্রেটারি: মম তারিন খানম
কমিউনিকেশনে সেক্রেটারি: ইব্রাহিম খলিল
জয়েন্ট কমিউনিকেশনে সেক্রেটারি: রায়সা খাইররুম
অফিস সেক্রেটারি: সানজিদা ইসলাম
জয়েন্ট অফিস সেক্রেটারি: মো. মাযহারুল ইসলাম
পাবলিকেশন সেক্রেটারি: আবদুল্লাহ নাঈম
জয়েন্ট পাবলিকেশন সেক্রেটারি: হৃদয় সম্রাট ও খাদিজা খাতুন
ইভেন্ট সেক্রেটারি: রাশফিয়া ইসলাম
জয়েন্ট ইভেন্ট সেক্রেটারি: গৌরী ভট্টাচার্য
রিফ্রেশমেন্ট সেক্রেটারি: তানভীর আহমেদ
জয়েন্ট রিফ্রেশমেন্ট সেক্রেটারি: সাদনান ইবনে সাদ
এক্সিকিউটিভ মেম্বার: মুরসালীন বাপ্পি ও জাবেদ হাসান


খাদিজা খাতুন: শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়