রহস্যেঘেরা রায়েরকাঠি জমিদারবাড়ি

রায়েরকাঠি জমিদারবাড়ির ধ্বংসাবশেষ। ছবি: লেখক
রায়েরকাঠি জমিদারবাড়ির ধ্বংসাবশেষ। ছবি: লেখক

ইতিহাস সব সময়ই মানুষের কাছে বিস্ময়ের জন্ম দেয়। পুরোনো জিনিসের মাঝে মানুষ খোঁজে নতুনত্ব। পুরোনো ঐতিহ্য, ঐতিহাসিক স্থানের মাঝে মানুষ মূলত তার অস্তিত্ব খুঁজে বেড়ায়। যুগ যুগ ধরে মানুষ তার অস্তিত্ব এবং ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতেই স্থাপনা তৈরি করেছে। সভ্যতার শুরু থেকেই তৈরি এসব স্থাপনার সৌন্দর্য ও অভূতপূর্ব নির্মাণশৈলী মানুষের দৃষ্টি কেড়ে নিচ্ছে প্রতিনিয়ত। সে রকমই একটি নিদর্শন রায়েরকাঠি জমিদারবাড়ি।

পিরোজপুর জেলা থেকে ৩ কিলোমিটার দূরত্বে রায়েরকাঠি গ্রামে অবস্থিত ঐতিহাসিক রায়েরকাঠি জমিদারবাড়ি।

জমিদারবাড়ির মন্দিরের ফটক। ছবি: লেখক
জমিদারবাড়ির মন্দিরের ফটক। ছবি: লেখক

রায়েরকাঠি জমিদারবাড়ি
পিরোজপুরের ইতিহাস থেকে জানা যায়, সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে যুবরাজ সেলিম বিদ্রোহ করে বাংলায় আসেন। এরপর তিনি ঝালকাঠি, পিরোজপুর ও বাগেরহাট জেলার কিছু অংশ নিয়ে একটি পরগণার সৃষ্টি করেন। নিজের নামে পরগণার নাম রাখেন সেলিমাবাদ।

১৭১৮ সালে সেলিমাবাদ পরগনার রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব পান মদনমোহন। ১৬২৮ সালে মদনমোহন তাঁর ছেলে শ্রীনাথের নামে সেলিমাবাদ পরগনার কিছু জমি নেন। পরবর্তী সময় মোগল সম্রাট শ্রীনাথকে রাজা উপাধি দেন। ১৭৫৮ সালে রাজা শ্রীনাথ রায়ের ছেলে রুদ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী পিরোজপুরের অদূরে বসবাস শুরু করেন। বনজঙ্গল কেটে রাজবাড়ি ও মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এ থেকে এর নামকরণ হয় রায়েরকাঠি।

রায়েরকাঠি জমিদারবাড়ির কালীমন্দির। ছবি: লেখক
রায়েরকাঠি জমিদারবাড়ির কালীমন্দির। ছবি: লেখক

রায়েরকাঠি কালীমন্দির কীভাবে তৈরি
রুদ্র নারায়ণ চৌধুরী রায়েরকাঠি এলাকায় বিশাল এলাকার বনজঙ্গল পরিষ্কার করে জমিদারবাড়ি প্রতিষ্ঠা করার সময় কালীমন্দিরও তৈরি করেন। কথিত রয়েছে, মন্দির তৈরি করতে গিয়ে তিনি মানুষের মুণ্ডু কেটে মূর্তি স্থাপন করেন। জানা যায়, তাঁর এই নিষ্ঠুর অপকর্মের কারণে সুবেদার শাহবাজ খান তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেন। সহস্রাধিক মানুষের সামনে তাঁকে বাঘের খাঁচায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি বাঘের সঙ্গে লড়াই করে বাঘকে মেরে ফেলেন। পরবর্তী সময় সুবেদার তাঁর মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করে দেন। কিন্তু এখানেই তিনি প্রতিষ্ঠা করে যান কালীমন্দির।

প্রায় ২০০ একর জমিতে তৈরি করা হয়েছিল ছোট-বড় ২০০টি ভবন। ১১টি মঠ তৈরি করা হয়েছিল এবং প্রতিটি মঠেই ছিল শিবলিঙ্গ। এখন একটি মঠে একটি মাত্র শিবলিঙ্গ আছে, যেটির ওজন প্রায় ২৫ মণ। এ ছাড়া ছিল ৪০-৫০টি গগনচুম্বী অট্টালিকা, যা রাজবাড়ির শোভাবর্ধন করত।

এখন মন্দিরের তদারকির দায়িত্বে আছে ইসকন। ছবি: লেখক
এখন মন্দিরের তদারকির দায়িত্বে আছে ইসকন। ছবি: লেখক

জমিদারবাড়ির রহস্যময় ইতিহাস
আগে বছরে একবার মহোৎসব হতো কালীমন্দিরে। লোকমুখে প্রচলিত আছে, এ উৎসব এলেই পুকুর থেকে আপনাআপনি রান্নার জন্য পাত্র উঠত। রান্নার আয়োজন হতো সহস্রাধিক মানুষের জন্য। উৎসব শেষে পুকুরে ফিরিয়ে দেওয়া হতো পাত্র। কিন্তু কোনো একবার এক ব্যক্তি একটি পাত্র ফিরিয়ে না দিয়ে লুকিয়ে রেখেছিলেন। সেই থেকে আর কখনো পুকুর থেকে রান্নার পাত্র উঠত না।

রায়েরকাঠি জমিদারবাড়ির অস্তিত্ব তেমন একটা নেই বললেই চলে। কিন্তু ৩০০ বছরের অধিক সময়ব্যাপী তৈরি কালীমন্দির, শিবমন্দির ও রাধাগোবিন্দ মন্দির এখনো টিকে আছে তার ঐতিহ্য নিয়ে। লোকজনের আনাগোনা তেমন একটা নেই। রাজবাড়ি পড়ে ছিল অবহেলায়। এই মন্দিরের তদারকি করছেন ইসকন। পিরোজপুর সদর হাসপাতালের ড. দীপক হালদার মন্দিরের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মন্দিরে সেক্রেটারি হিসেবে নিযুক্ত আছেন গোপীনাথ দাশ।
প্রতিবছর ভূমি একাদশী পালিত হয় মাঘ মাসের শেষে এবং শিব চতুর্দশী পালিত হয় চৈত্র মাসের শেষে। প্রায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার মানুষের আগমন ঘটে এ উৎসবে।

রায়েরকাঠি জমিদারবাড়ির ধ্বংসাবশেষ। ছবি: লেখক
রায়েরকাঠি জমিদারবাড়ির ধ্বংসাবশেষ। ছবি: লেখক

জমিদার বংশধরেরা কোথায়
রাজা রুদ্র নারায়ণ চৌধুরীর একমাত্র বংশধর বলতে আছেন গৌড় রায় চৌধুরী এবং গৌতম নারায়ণ চৌধুরী। রায়েরকাঠি শিব ও কালীমন্দির ব্যবস্থাপনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক এবং রাজবংশের ২৯তম ও শেষ পুরুষ গৌতম নারায়ণ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘রাজবাড়ি ও মঠগুলো সংরক্ষণ করা খুবই ব্যয়বহুল।’ গৌড় রায় চৌধুরী সাংসারিক কাজকর্মে ব্যস্ত এবং জায়গা-জমির দেখাশোনা করেন।

রায়েরকাঠি জমিদারবাড়ির দুর্গা মন্দির। ছবি: লেখক
রায়েরকাঠি জমিদারবাড়ির দুর্গা মন্দির। ছবি: লেখক

কীভাবে যাবেন রায়েরকাঠি জমিদারবাড়ি
সড়ক বা নৌপথে পিরোজপুর যাওয়া যায়। ঢাকা বা যেকোনো স্থান থেকে বাসে করে পিরোজপুর শহর থেকে অটোরিকশার বা রিকশা করে যাওয়া যাবে ‘রায়েরকাঠি জমিদারবাড়ি’।
নৌপথে যেতে চাইলে প্রথমে সদরঘাট থেকে লঞ্চে করে পিরোজপুর যেতে হবে। হুলারহাট ঘাট থেকে রিকশা বা অটোরিকশা নিয়ে রায়েরকাঠি জমিদারবাড়ি যাওয়া যায়।

ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার। সেই ইতিহাস টিকিয়ে রাখতে হলে তার অবহেলা না করে যত্ন করতে হবে। কারণ ইতিহাসকে ঘিরেই মানুষের অস্তিত্বের বসবাস!

লেখক: শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ।